পাহাড়ঘেরা নৈসর্গিক কাঠমান্ডু



নেপাল ভ্রমণ - শেষ পর্ব

ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। কাঠমান্ডু শহরে শেষরাতের দিকে বেশ ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। উঠে দেখি আটটা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত চলে গেলাম ওপরে ডাইনিং এরিয়ায়। সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের রেস্ট হাউজের মালিক জোনাকিদা ব্রেকফাস্টের আয়োজন করতে ব্যস্ত। আমাদের দেখেই ওয়েলকাম জানালেন, সাথে শুভ সকালও। উনি নিজেই নাশতা রেডি করে আমাদের দিচ্ছিলেন। আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম। সেই সাথে গল্প জুড়ে দিলাম ভদ্রলোকের সাথে। অন্যান্য নেপালিদের তুলনায় বেশ ভালো ইংরেজি জানেন উনি। তাই আমার সাথে গল্পটা জমে উঠল। নেপাল, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ওনার পরিবারের গল্পও চলছিল। নাশতা শেষে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ওনাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানালাম। কক্সবাজারের কথা বললাম। পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত আমাদের দেশে জানতেন না উনি। অবাক হলেন। ১০টা বেজে গেলো এভাবেই। আর দেরি না করে কাঠমান্ডু শহর ভ্রমণের একটা রোডম্যাপ নিয়ে নিলাম দাদার কাছ থেকে। এরপর বেরিয়ে পড়লাম কাঠমান্ডুকে আবিস্কার করতে।

আনুষ্ঠানিকভাবে কাঠমান্ডু একটি মেট্রোপলিটন সিটি, যা প্রায় ৩ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে নেপালের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। কাঠমান্ডু মেট্রোপলিটন অঞ্চল, যারমধ্যে ললিতপুর, ভক্তপুর, কীর্তিপুর এবং আরও কয়েকটি শহর রয়েছে। অঞ্চলগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৬ মিলিয়ন। কাঠমান্ডু হিমালয় পর্বত অঞ্চলের বৃহত্তম মহানগরও। নেপালি এবং নেওয়ারি এই শহরে সর্বাধিক কথ্য ভাষা। কাঠমান্ডু মন্দিরের শহর নামেও পরিচিত। মধ্যনেপালের বাটি আকারের কাঠমান্ডু উপত্যকায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। ঐতিহাসিকভাবে "নেপাল মন্ডালা" হিসাবে অভিহিত করা হয়। এটি নেয়ার সংস্কৃতির আবাসস্থল এবং হিমালয়ের পাদদেশের এক বিশ্বব্যাপী নগরসভ্যতা।

কাঠমান্ডু সিটি ট্যুরের জন্য ট্যাক্সি রিজার্ভ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এজন্য চলে এলাম থামেল এলাকায়। কাঠমান্ডুর সবচেয়ে অভিজাত ও ট্যুরিস্ট এলাকা হলো থামেল। এখানে মোটামুটি সবকিছুই পাওয়া যায়। আমরা থামেলে এসে একটা ট্যাক্সি রিজার্ভ নিলাম তিন হাজার নেপালি রুপিতে। আমাদের চারটা জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবে, এরপর দরবার স্কয়ারের সামনে গিয়ে নামিয়ে দেবে। ট্যাক্সি চালকের নাম সোনম লামা। বয়স ষাটের কাছাকাছি, কিন্তু দেখতে এখনও তরুণ মনে হয়। নেপালিরা পরিশ্রমী, তাই বয়স বোঝা যায় না। লামাদার সাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলাম। ওনার ভাইকে নিয়ে ১৯৯৩ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন আমেরিকান দূতাবাসে ইন্টারিভিউ দিতে। এসে পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে ৮০০ টাকা জরিমানা দিয়েছিলেন। সেই গল্প শুনতে শুনতে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য পশুপতিনাথ মন্দিরে।

পশুপতিনাথ মন্দির হলো একটি বিখ্যাত এবং পবিত্র হিন্দু মন্দির কমপ্লেক্স। সনাতন ধর্মমতে এটি ভগবান (শিব) পশুপতিকে উৎসর্গ করা এবং এটি নেপালের কাঠমান্ডুতে পবিত্র বাগমতী নদীর তীরে অবস্থিত। এই মন্দির কমপ্লেক্সটি ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় তালিকাভুক্ত করা হয়। এটি ২৪৬ হেক্টর জায়গার উপর নির্মিত এবং এতে ৫১৮টি ছোট মন্দির রয়েছে। মন্দিরের নির্মাণের সঠিক তারিখ অনিশ্চিত। তবে মন্দিরের বর্তমান রূপটি ১৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে, দোতলা মন্দিরের চারপাশে আরও অনেক মন্দির তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৪ শতাব্দীর রাম মন্দিরসহ বৈষ্ণব মন্দির কমপ্লেক্স এবং ১১ শতকের একটি পাণ্ডুলিপিতে উল্লিখিত গুহ্যেশ্বরী মন্দির।

আমরা মন্দিরের চারপাশটা ঘুরে দেখছিলাম। এরমধ্যে ছোটভাই রাজিব ভেতরে গিয়ে তার প্রণাম সেরে এলো। ভেতরে ছবি ও ভিডিওর অনুমতি না থাকায় আমি আর ঢুকলাম না। তবে জায়গাটি বেশ সুন্দর, পরিপাটি। ফুরফুরে হাওয়া আসছিল চারদিক থেকে। অসংখ্য পর্যটক, পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটেছে। আমরা বেরিয়ে এলাম পরবর্তী গন্তব্যের জন্য। এবার গন্তব্য বুদ্ধনাথ মন্দির।

কাঠমান্ডু শহরের অন্যতম জনপ্রিয় বুদ্ধনাথ স্তুপা ও মন্দির; ছবিঃ লেখক



বুদ্ধনাথ এরিয়ায় প্রবেশ ফি আছে। সার্কভুক্ত দেশের জন্য ১০০ নেপালি রুপি ও অন্যান্য বিদেশিদের জন্য ৪০০ রুপি। আমরা চারজন চারটে টিকেট নিয়ে ঢুকলাম। বুদ্ধনাথ মন্দির নেপালের বৃহত্তম গোলাকার স্তুপা। এরকম স্তুপা শুধু নেপালে নয়, সারা পৃথিবীতেই বিরল। এজন্য ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো এটাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত করে। তাছাড়া এটি সারা পৃথিবীর বৌদ্ধদের জন্য পবিত্র একটি তীর্থস্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। কাঠমান্ডুর থামেল থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থির এই মন্দিরের চারপাশে গড়ে উঠে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, আর্ট স্কুল, আর্ট কলেজ, স্যুভেনির শপসহ নানা ধরনের মার্কেট। অসংখ্য পুণ্যার্থী আর পর্যটকে মুখরিত থাকে এটি। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম অদ্ভুত সুন্দর এই স্থাপনা। বেশ উঁচু এর চূড়া। বিভিন্ন রঙের পতাকা দেখছিলাম চূড়ায় বাঁধা। আর অসংখ্য কবুতর পুরো এলাকাজুড়েই। ভেতরে আধঘন্টার মতো সময় কাটিয়ে আবারও চলে এলাম আমাদের গাড়িতে। এখন যাব পাহাড়ের একদম ওপরে একটা বিখ্যাত মনেস্ট্রিতে।

একদম পাহাড়ের চুড়ায়, নিরিবিলি ও নির্জন একটি জায়গা হলো কোপান মনেস্ট্রি। এটি মূলত তিব্বতিদের ধ্যান ও মেডিটেশনের জন্য নির্মিত হয়েছি। একসময় এই জায়গাটা সম্পর্কে পর্যটকেরা জানত না। এখন এটি দিনে-দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে। আমরাও গুগলের সাহায্যে জানতে পেরে এসেছি। এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটা ইনস্টিটিউটও আছে। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার এখানকার ওপর থেকে কাঠমান্ডু শহরের ১৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলের একটি দারুণ ও নান্দনিক ভিউ পাওয়া যায়, যা মুগ্ধ করল আমাদের ভীষণভাবে। তাছাড়া এখানকার ভিক্ষুরা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। আমাদের সাথে ছবি উঠলেন তারা। বেশ শান্তিপূর্ণ জায়গা। সাথে চমৎকার হাওয়ায় ভেতরটা একদম শীতল হয়ে যায়। জায়গাটি থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু সময়-স্বল্পতায় বের হয়ে রওনা দিলাম স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরের দিকে।

নেপালের রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ড্রাইভার লামা দা আমাদের দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সবকিছু। রাজপ্রাসাদও দেখে নিলাম। রাজতন্ত্র নেই এখন নেপালে, তবে রয়ে গেছে রাজপ্রাসাদ। পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছুটে চলছিলাম। কাঠমান্ডু শহর যেন মুগ্ধতার এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। দেখতে দেখতে আমরা মাংকি টেম্পলখ্যাত স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে চলে এলাম।

পাহাড়ের ওপর থেকে কাঠমান্ডু শহর; ছবিঃ লেখক



স্বয়ম্ভুনাথ হলো কাঠমান্ডু শহরের পশ্চিমে কাঠমান্ডু উপত্যকার একটি টিলার চূড়ায় অবস্থিত প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মীয় কমপ্লেক্স। এখানে একটি স্তুপা, বিভিন্ন মঠ এবং মন্দির রয়েছে, যেগুলোর কিছু তৈরি হয়েছিল লিচাভি যুগের সময়ে। সাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে একটি তিব্বতি বিহার, জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার। স্তুপায় বুদ্ধের চোখ এবং ভ্রু আঁকা আছে। তাদের মধ্যে এক নাম্বারে একটি নাকের ছবি আঁকা আছে। এখানে দোকান, রেস্তোঁরা এবং হোস্টেলও রয়েছে। কমপ্লেক্সটির দুটি প্রবেশপথ, একটি দীর্ঘ সিঁড়ি যা সরাসরি মন্দিরের মূল প্ল্যাটফর্মের দিকে যায়, যা পাহাড়ের শীর্ষ থেকে পূর্ব দিকে; এবং দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রবেশপথে পাহাড়ের চারদিকে একটি গাড়ি রাস্তা। কমপ্লেক্সটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং এটি হিন্দুদেরও শ্রদ্ধার স্থান। মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম অংশে ‘পবিত্র’ বানরের দল বসবাস করে। এজন্য এটিকে মাংকি টেম্পলও বলা হয়।

এখানেও বিভিন্ন ভিউ পয়েন্ট আছে, যেসব জায়গা থেকে কাঠমান্ডু শহর দেখা যায় পুরোটাই। আছে নানা ধরনের ধর্মীয় স্যুভেনির শপও। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম শপগুলো। এক জায়গায় দেখলাম মিক্সড ফ্রুট বিক্রি হচ্ছে। প্লেটভর্তি নানা ধরনের ফল ১০০ নেপালি রুপি। আবার নারকেল, শসাও কেটে কেটে বিক্রি হচ্ছে। আমরা মিক্সড ফল নিলাম। খেয়ে বেশ শান্তি পেলাম। ফলগুলো তাজা ছিল। এরপর বেশ কিছুক্ষণ এখানেই কাটিয়ে দিলাম। এরিয়াটা অনেক বড় হওয়ায় সময়ও লাগল বেশ। ঘড়িতে সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। বেরিয়ে এলাম। এবার সোজ চলে যাব দরবার স্কয়ারে। সেখানেই লাঞ্চটা সেরে নেব।

দরবার স্কয়ারের সামনে আমাদের নামিয়ে দিলেন লামা দা। ওনাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে গেলাম। ইতোমধ্যে সবার ক্ষুধা চাগিয়ে উঠেছে। দরবার স্কয়ারের পেছনের দিকে বেশকিছু রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা খুঁজে বের করলাম একটা নান ও তান্দুরির জন্য বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট। সেখানেই লাঞ্চ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিকেল হয়ে এসেছে। লাঞ্চ সেরে নিলাম গার্লিক নান ও চিকেন মাসালা দিয়ে। আমাদের দেশের মতোই স্বাদ ছিল খাবারের। এখানে খেয়ে সবাই তৃপ্তি পেলো। কারণ নেপালে এসে মনমতো খাবার পাওয়া যাচ্ছিল না খুব একটা। খেয়েদেয়ে শেষ বিকেলটা দরবার স্কয়ারে কাটানোর জন্য মনস্থির করলাম।

দেশি-বিদেশি পর্যটকে ভরপুর দরবার স্কয়ার; ছবিঃ লেখক



কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার সাবেক কাঠমান্ডু রাজ্যের রাজকীয় বাসভবনের প্লাজা। এটি কাঠমান্ডু উপত্যকায় অবস্থিত তিনটি দরবারক্ষেত্রের একটি। এই তিনটি দরবারক্ষেত্রই ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ারের চারপাশে দর্শনীয় স্থাপত্য নিদর্শন ছিল। কয়েক শতাব্দীকালধরে নির্মিত নেওয়ার শিল্পীদের শিল্পকর্ম এই স্থাপত্যকর্মগুলোতে শোভা পাচ্ছিল। এই দরবারক্ষেত্রের বেশ কয়েকটি দালান ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজকীয় ভবনটি মূলত আগে দত্তরয়াক্ষেত্রে অবস্থিত ছিল, পরে এটিকে দরবারক্ষেত্রে স্থানান্তরিত করা হয়। কাঠমান্ডু দরবারক্ষেত্রে মল্ল ও শাহ রাজাদের প্রাসাদ ছিল। এছাড়া এই ক্ষেত্রে বেশকিছু চতুর্ভুজাকৃতির উঠোন এবং মন্দির রয়েছে। এটি হনুমান ধোকা দরবারক্ষেত্র নামেও পরিচিত। নামটি হনুমানের মূর্তি থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। ক্ষেত্রের প্রবেশপথে হনুমান মূর্তিটি অবস্থিত। রাজা প্রতাপমল্ল-এর সময়ে কাঠমান্ডু দরবারক্ষেত্র ব্যাপকভাবে নির্মিত হয়। রাজা প্রতাপমল্ল ছিলেন ধার্মিক ও পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি শিল্পের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তিনি নিজেকে কভিন্দ্র বলতেন, যার অর্থ কবিদের রাজা। এছাড়া তিনি পনেরোটি ভাষা জানায় নিজেকে নিয়ে গর্ব করতেন। প্রতাপমল্ল স্থাপনা নির্মাণের প্রতিও আগ্রহী ছিলেন। একারণে রাজা হিসেবে অভিষেকের পরেই তিনি তার প্রাসাদের সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন।

দরবার স্কয়ার এত জমজমাট এলাকা যে লোকে-লোকারণ্য হয়ে থাকে। এত এত দেশ থেকে ট্যুরিস্ট আসে এখানে, দেখলে মনে হবে এ যেন বৈশ্বিক এক মিলনমেলা। কাঠমান্ডুর একদম গুরুত্বপূর্ণ লোকেশনে জায়গাটি হওয়ায় মানুষের সমাগম লেগেই থাকে। আমরা এখানে পুরো বিকেলটা কাটিয়ে দিলাম। একের পর অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর ভবনগুলো দেখে দারুণ মুগ্ধ হচ্ছিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এলো, তবু মানুষের ভিড় কমছিল না। আমরা সারাদিন ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত, তাই আমাদের গেস্ট হাউজের দিকে রওনা দিলাম। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার বের হবো রাতের থামেল দেখতে এবং কিছু কেনাকাটা করতে।

নৈসর্গিক কাঠমান্ডু মুগ্ধ করে সবাইকে; ছবিঃ লেখক



রাতের থামেল

থামেল। কাঠমান্ডু শহরের প্রাণকেন্দ্র। আমাদের পুরান ঢাকার আদলে তৈরি এলাকাটা সারাবছর পর্যটকে গিজগিজ করে। বিদেশি পর্যটকদের বেশিরভাগই থামেলের হোটেলগুলোতে থাকেন। এই এলাকাটা শপিং, বার, স্পাসহ নানা বিনোদন অনুষঙ্গের জন্য সবসময় মুখরিত হয়ে থাকে। তবে রাতের থামেল অনেক বেশি সুন্দর আলোকসজ্জায় সেজে ওঠে। বারগুলো থেকে মিউজিকের শব্দ ভেসে আসে। কর্মব্যস্ত নগরবাসী আর ঘুরতে আসা বিদেশিরা মেতে ওঠেন আনন্দ-ফুর্তিতে।

আমরা রাত আটটায় বের হলাম গেস্ট হাউজ থেকে। থামেল হেঁটে আসতে ১০ মিনিট লাগে আমাদের। আজকেই যেহেতু নেপালে শেষরাত, কিছু কেনাকাটা প্রয়োজন। থামেলে সারি সারি দোকান। নেপালি, ভারতীয়, কাশ্মিরি পণ্যের দোকানই বেশি। জামাকাপড়, ট্রেকিংয়ের জিনিসপত্র, পশমিনা ও কাশমিরি শাল, স্যুভেনির, তামা, পিতল, কাঁসা, কাঠ ও লোহার নানা জিনিসে ভরপুর একেকটি দোকান। আমরা কিছু কেনাকাটা করছিলাম আর ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম পুরো থামেল। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বার ও স্পা সেন্টার থেকে আমাদের আহবান করছিল। আগ্রহী না থাকায় যাইনি। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আসা লোকদের আনাগোনা রাতের থামেলে অনেক বেশি দেখা যায়। তাদের নাইটলাইফ উপভোগ করার জন্যই তারা থামেলকে বেছে নেন।

কেনাকাটা শেষ করতে রাত ১২টা বেজে গেলো। খিদে চাগিয়ে উঠেছে বেশ। এবার খেতে যাব। কিন্তু গতকাল থামেলে যে রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে একটি বাঙালি তথা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট খোলা পেলাম। সেখানে গিয়ে খেয়ে নিলাম, যদিও খাবার খুব একটা ভালো ছিল না। শুধু বাঙালি খাবার হওয়ায় খেতে বাধ্য হলাম এখানে। খেয়েদেয়ে ভীষণ ক্লান্ত শরীরটাকে বয়ে নিয়ে গেলাম রুম পর্যন্ত। ততক্ষণে রাত প্রায় একটা। সকালে উঠে আমাদের এয়ারপোর্টে যেতে হবে। তাই ঘুমিয়ে পড়লাম দ্রুতই।

দরবার স্কয়ারের একটি নান্দনিক ভবন; ছবিঃ লেখক



বিদায়ের সুর

আজ ৮ই অক্টোবর ২০২৪। ঘুম ভাঙল সকাল ৯টায়। রাতে ব্যাপক ক্লান্ত ছিলাম সবাই। দ্রুত ফেশ হয়ে তাই ডাইনিংয়ে চলে গেলাম। দেখি জোনাকিদা অপেক্ষা করছেন আমাদের। আজ আমাদের কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় ফ্লাইট বেলা ১.৪৫ টায়। ১০টার দিকে বের হতে হবে। দ্রুত নাশতা সেরে নিলাম। জোনাকিদার আপ্যায়নে মুগ্ধ হলাম। বিএনবি রয়্যাল ট্যুরিস্ট গেস্ট হাউজের দুটো রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা সারাজীবন মনে থাকবে। রুমে এসে দেরি না করে দ্রুত সব গোছগাছ অরে নিলাম। জোনাকিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম মূল রাস্তায়। ট্যাক্সি কল করে সেটা নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যাব।

নেপালে রাইড শেয়ারিং অ্যাপের মধ্যে পাঠাও আর ইনড্রাইভ অ্যাপ বেশি জনপ্রিয়। আমাদের কাছে নেপালের সিম থাকায় ইনড্রাইভ অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছিলাম। সেখান থেকে ট্যাক্সি কল করে নিলাম। হোটেলের সামনে থেকে ৪৩২ নেপালি রুপি ভাড়া দেখাচ্ছিল এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। ট্যাক্সিতে উঠতেই মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। এয়ারপোর্টের দিকে যত এগোচ্ছিলাম, নান্দনিক রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিলাম ততই মনখারাপ হচ্ছিল। এত অসাধারণ একটি দেশ ছেড়ে যাচ্ছি বলে খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু যাওয়া তো লাগবেই। গান শুনছিলাম ‘সময় হয়েছে ফিরে যাওয়ার, মন কেন যেতে চায় না/আরও কিছুক্ষণ থাকতে এ মন, কেন যে বারেবারে ধরে বায় না’।

আধঘন্টার মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। শেষবেলায় এসে নেপালের প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল আমাদের সাথে। ইনড্রাউভের ড্রাইভারকে ৫০০ রুপির নোট দিলাম। তিনি আমাদেরকে বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে জোর করে পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন, টিপসও চাইলেন না। অথচ আমরা টিপস দিতে প্রস্তুত ছিলাম। এভাবে টাকা নিয়ে যাবেন ভাবিনি। কী আর করা, শেষবেলায় এসে ঝামেলা করতে চাইলাম না। অ্যাপে রিভিউতে কথাগুলো লিখে সাবমিট অরে দিলাম, সেইসাথে ড্রাইভারকে মাত্র এক স্টার রেটিংস দিলাম। এটাই একমাত্র প্রতিকার ছিল।

এয়ারপোর্টে গিয়ে দ্রুত বোর্ডিংপাস নিয়ে, ইমিগ্রেশন শেষ করে, ফাইনাল সিকিউরিটি চেকইন সম্পন্ন করে ফেললাম। হাতে তখনও দুইঘন্টা বাকি ফ্লাইটের। বসে বসে সময় কাটাচ্ছিলাম এয়ারপোর্টের ফ্রি ওয়াইফাইয়ে ব্রাউজিং করে। কিছু নেপালি রুপি রয়ে গেছিল। এয়ারপোর্ট থেকে জুস কিনে খেলাম। কিন্তু দুইঘন্টা পরও আমাদেরকে বোর্ডিং করানো হলো না। আরও আধঘন্টা দেরি হলো। এরপর ডাক পড়ল আমাদের। বাসে করে ফ্লাইটে চলে গেলাম। ফ্লাইটে ওঠার পর শুধু সময় বয়ে চলছিল, কিন্তু আমাদের ফ্লাইট টেইকঅফ করছিল না। এয়ার হোস্টেস জানালেন এয়ার ট্রাফিকের কারণে দেরি হচ্ছে। ১.৪৫-এর ফ্লাইট ছাড়ল ৩.৪৫ মিনিটে প্রায়। আবার উড়ে চললাম আকাশে। পাহাড়েঘেরা কাঠমান্ডু ছেড়ে প্রিয় মাতৃভূমির দিকে ছুটে চললাম আমাদের এয়ারবাস ৩২০ সিরিজের উড়োজাহাজটি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ