রেমা-কালেঙ্গার অবাক অরণ্যে



বিশ্বখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনকে কে না চেনে! ভ্রমণ নিয়ে তার একটা উক্তি আমার খুব ভালো লাগে। তিনি বলেছিলেন, “আজ থেকে বিশ বছর পর আপনি এই ভেবে হতাশ হবেন যে আপনার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল তা করতে পারেননি। তাই নিরাপদ আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ুন। আবিষ্কারের জন্য যাত্রা করুন, স্বপ্ন দেখুন আর শেষমেশ আবিষ্কার করুন”।

হবিগঞ্জ আমার পাশের জেলা। সিলেট বিভাগের চার জেলার একটি। হবিগঞ্জের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও পর্যটন বিকশিত হয়নি খুব একটা। ২০১৭ সালে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে গিয়েছিলাম একটা গ্রুপের সাথে। সেটা ছিল মূলত বনভোজন। এরপর নানা গল্পে, লেখা ও ভ্রমণ ভিডিও কনটেন্টে নাম জানতে ও দেখতে পারছিলাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন রেমা-কালেঙ্গার কথা। যাওয়ার একটা সুতীব্র ইচ্ছে জাগছিল মনে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ালেও চুনারুঘাটে যাওয়ার সুযোগ হচ্ছিল না। সে সুযোগ এলো হঠাৎ বন্ধু জাকারিয়ার কল্যাণে।

বন্ধুবর জাকারিয়া কবির চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। গত বছর তিনি বদলি হয়ে যান চুনারুঘাটে। তারপর থেকে আমাকে বলছিলেন চুনারুঘাটে ঘুরতে যেতে। যেহেতু তিনি আমার দীর্ঘদিনের ভ্রমণসঙ্গী, আমারও ইচ্ছে ছিল যাওয়ার। কিছুদিন আগে তাই আমার আরেক ভ্রমণসঙ্গী হেলালকে নিয়ে ঘুরে এলাম চুনারুঘাটের বিস্ময়ারণ্য রেমা-কালেঙ্গা বণ্যপ্রাণি অভয়ারণ্য থেকে। যেখানে আবিষ্কার করেছিলাম জীবনের এক অন্য মানে। সেই গল্পই বলছি আজ।

২৫শে মে, ২০২৪। সকাল নয়টা। ইতোমধ্যেই সূর্যটা বেশ চড়া। কয়েকদিন ধরেই তীব্র গরম। উত্তপ্ত দেশ। চারদিকে হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু একজন ভ্রমণপ্রেমী সব ঋতু আর আবহাওয়াকে জয় করেই এগিয়ে যায় গন্তব্যের দিকে। গরম, শীত, বৃষ্টি, রোদে ভয় পেলে ভ্রমণ হয় না। হেলালের বাইকে করে তাই রওনা দিলাম চুনারুঘাটের দিকে। সিলেটের চার জেলার মিলনস্থল শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।

রেমা-কালেঙ্গার মূল প্রবেশপথ; ছবিঃ লেখক



ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সকালের এই সময়টাতে যানবাহন অনেক কম থাকে। আমরা রাস্তা ফ্রি পেয়ে মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলছি। পথিমধ্যে আউশকান্দি নামক জায়গায় ব্রেকফাস্ট করার জন্য থামলাম। নাশতা খেয়ে আর সাথে পর্যাপ্ত পানি নিয়ে আবারও ছুটে চললাম। বেশকিছু রাস্তা যাওয়ার পর বাইকে ফুয়েল নিতে একটা পেট্রল পাম্পে ঢুকলাম। ইতোমধ্যেই গরম বাড়তে শুরু করেছে, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি অতিক্রম করে ফেলেছে সকালবেলাতেই। আবারও পানি খেয়ে দেবপাড়া বাজার, পানিউমদা, মিরপুর হয়ে শায়েস্তাগঞ্জ চলে গেলাম। শায়েস্তাগঞ্জে নতুন ব্রিজ এলাকায় সকল বাস থামে। সেখান থেকে বাঁ-দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে চুনারুঘাটে। শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার গেলেই চুনারুঘাট বাজার বা উপজেলা শহর। আমরা বাঁ-দিকের রাস্তা ধরতেই অদ্ভুত এক শান্তি এসে ভর করল মনে, দেহে। মসৃণ রাস্তার দু-পাশে গাছের সারি, যা রাস্তাকে দিয়েছে নান্দনিক একটি রূপ। এই রাস্তাটাতে রোদ লাগে না, তাই গরমও কম। বাইকের বাতাসে বেশ ফুরফুরে লাগছিল। মাত্র ১৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম চুনারুঘাট বাজার।

চুনারুঘাটে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন জাকারিয়া ভাই। আমরা এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব ভাবেননি। সকাল সাড়ে ১১টায় আমরা চুনারুঘাটে চলে এসেছি। জাকারিয়া ভাই একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। ওনার এক বন্ধু সাতছড়ি এলাকা থেকে আসবে বাইক নিয়ে। তারপর আমরা চারজন যাব রেমা-কালেঙ্গা। যেহেতু তীব্র গরম, আমি চা না খেয়ে প্রথমে ঐ দোকানের নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি দই অর্ডার করলাম। হেলাল ও জাকারিয়া ভাইও সেইম অর্ডার দিলেন। দইটা খুব মজাদার ও অন্যরকম স্বাদের ছিল। খেয়ে বেশ ভালো লাগল। কিছুটা ঠাণ্ডা হওয়ার পর চাও খেয়ে নিলাম।

সাতছড়ি থেকে মুশতাক ভাই এলেন ১২টার দিকে। আমরা দুটো বাইকে করে রওনা দিলাম রেমা-কালেঙ্গার দিকে। একদম গ্রামীণ রাস্তা ধরে, চারপাশের চমৎকার সব দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। রেমা-কালেঙ্গায় যাওয়ার পথ ৯০ভাগ পিচঢালা হলেও শেষদিকে কিছু রাস্তা মাটির। সে মাটির রাস্তা দিয়ে চলার সময় একটা প্রকৃত গাঁয়ের পথে চলার অনুভূতি হচ্ছিল। একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম। কৃষকরা ধান কেটে সেসব ধান বস্তায় করে ঘোড়ায় পিঠে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই দৃশ্যটা গ্রাম-বাংলায় একসময় প্রচুর দেখা গেলেও এখন বিলুপ্তপ্রায়। এখানে আবার দেখে শৈশবের স্মৃতি ফিরে এলো। এই যন্ত্রের যুগে এখন এসব ঘোড়ার কদরও আছে দেখে ভালো লাগল অনেক। যা হোক, আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কালেঙ্গা বাজার। সেখানে পানি কিনতে গিয়ে মুশতাক ভাইয়ের এক পরিচিত দোকানি আমাদেরকে জোর করে কোমল পানীয় পান করালেন। কিছুক্ষণ তার দোকানে বসেই রেমা-কালেঙ্গায় প্রবেশ করবো। সামনেই দেখা যাচ্ছে প্রবেশ গেট।

রেমা-কালেঙ্গার নান্দনিক লেইক; ছবিঃ লেখক



রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত-সংলগ্ন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে এর দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। এটি শুকনো ও চিরহরিৎ বন। সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমিও এটি। ১৯৮২ সালে এই অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৬ সালে এটি আরও সম্প্রসারণ করা হয়। এই বনাঞ্চলের আয়তন ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর। বন বিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের চারটি বিটের মধ্যে রেমা, কালেঙ্গা ও ছনবাড়ী বিস্তীর্ণ জঙ্গল নিয়ে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য গঠিত। এই বনের দেখভালের জন্য আছে ১১টি ইউনিট ও ৭টি ক্যাম্প।

বাংলাদেশের যে কয়টি প্রাকৃতিক বনভূমি ভালো অবস্থায় টিকে ছিল, রেমা-কালেঙ্গা তার মধ্যে অন্যতম হলেও নির্বিচারে গাছ উজাড়ের কারণে এ বনভূমির অস্তিত্বও এখন হুমকির মুখে। রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ। ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা-লতাগুল্ম এই বনে পাওয়া যায়।

বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখির জন্যও এই বন সুপরিচিত। এদের মধ্যে আছে- ভীমরাজ, টিয়া, পাতি ময়না, লালমাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, রাজধনেশ, শকুন, কালো মথুরা, লাল বনমোরগ, প্যাঁচা, মাছরাঙা, ঈগল, চিল ইত্যাদি।

এই বনে তিন প্রজাতির বানরের বাস, এগুলো হলো- উল্টোলেজি বানর, লাল বান্দর ও নিশাচর লজ্জাবতী বানর। তাছাড়া এখানে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালিও দেখা যায়। এর মধ্যে বিরল প্রজাতির মালয়ান বড় কাঠবিড়ালি একমাত্র এ বনেই পাওয়া যায়। বন্যপ্রাণির মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য আরও আছে মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান, উল্লুক, মায়াহরিণ, মেছোবাঘ, দেশি বনশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। শঙ্খচূড়, দুধরাজ, দাঁড়াশ, লাউডগাসহ এ বনে আঠারো প্রজাতির সাঁপের দেখা পাওয়া যায়।

আমরা গেটে গিয়ে টিকেট কাউন্টারে কাউকে পেলাম না। ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে আজ। এই অসহ্য গরমে এখানে ঘুরতে আসবে না কেউ এটাই স্বাভাবিক। তার ওপর এই বনটি একটু অফবিটে পড়েছে। লোকশূন্য হওয়ায় অবশ্য খুশিই হলাম। একটু নিরিবিলি, নির্জনে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। গেট দিয়ে ঢোকার মুখটা মূল রাস্তা থেকে উঁচু। বাইক নিয়ে উঠে পড়লাম। বিভিন্ন সাইনবোর্ডে নানা ধরনের নির্দেশনা দেখছিলাম, হঠাৎ বনের একজন কর্মকর্তা এলেন। টিকেট নিয়েছি কী না জানতে চাইলেন। মুশতাক ভাই সাতছড়িতে থাকেন, উনি নিজের পরিচয় দিতেই আমাদের আর টিকেটের প্রয়োজন হলো না। আমরা ঢুকে পড়লাম বনের ভেতরে।

রেমা-কালেঙ্গার ঝুঁকিপূর্ণ ওয়াচ টাওয়ার; ছবিঃ লেখক



প্রথমে বাইকে চলে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। এই বনের ভেতরে একটা বড় লেইক আছে, একদম ওয়াচ টাওয়ারের সাথে লাগোয়া। এই বনের প্রাণিদের অন্যতম জলের উৎস লেইক। সেই লেকের পাড়ে আমাদের বাইকগুলো রেখে উঠে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে। অনেক পুরোনো একটি ওয়াচ টাওয়ার, দেয়ালগুলো খসে খসে পড়ছে। আমরা একসাথে চারজন না ওঠে দুজন করে উঠলাম। কোনোমতে এই টাওয়ারের ওপর থেকে দেখে নিলাম পুরো বন। ভয়ে ভয়ে ছিলাম যদিও। বনবিভাগ এই টাওয়ারে উঠতে এখন নিরুৎসাহিত করে থাকে। একসাথে অনেকজন উঠলে অবশ্যই ঝুঁকিটা বেশি। তাই যারা একান্তই উঠতে চান, ১/২জন করে উঠে আবার দ্রুত নেমে আসা উচিত।

এরপর বনের গহীনে যাওয়ার জন্য আমরা বাইক নিয়ে মেঠোপথ ধরলাম। এই বনের শুরুর দিকে অনেকগুলো ধানখেত দেখে অনেকে শুরুতে হতাশ হয়, ভাবে এখানে বনটা কোথায়। কিন্তু ধানখেত পেরিয়ে একটু ভেতরে গেলেই বোঝা যায় কতটা গহীন এই অরণ্য! আমরা বাইকগুলো একটা ধানখেতের আলে রেখে দিলাম। এরপর ধরলাম ট্রেইল। এই বনে অনেকগুলো ট্রেইল আছে। এরমধ্যে জনপ্রিয় আধঘন্টা, একঘন্টা ও তিন ঘন্টার ট্রেইলগুলো। আমরা যে ট্রেইল ধরলাম সেটি এক ঘন্টার।

বনের পাশে গাছের ডাল পড়ে আছে। লাঠির মতো দুটো ডাল আমরা নিয়ে গেলাম। হাঁটতে সুবিধা হয়, আবার বিপদ-আপদেও কাজে লাগে। যেহেতু আমাদের সাথে কোনো গাইড নেই, আর আমরা ছাড়া এই ট্রেইলে আর কেউ নেই, আমরা সতর্কতার সাথে হাঁটছিলাম। বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজির প্রকাণ্ড ডালগুলোর ফাঁক গলে উত্তপ্ত সূর্য খুব সামান্যই আসছিল। প্রচণ্ড গরমে সূর্য থেকে বাঁচতে এমন বনের ভেতরে থেকে যাওয়া যেত যদি ভাবছিলাম।

যত গভীরে যাচ্ছিলাম, একটা গা ছমছমে পরিবেশ। এত নির্জন বন যে ঝিঝির ডাক ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিল না। অবশ্য মাঝে মাঝে অচেনা পাখিদের কিচিরিমিচির, কোলাহল নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে কর্ণযুগলকে প্রশান্তির সুরে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। পায়ের নিচে পড়ে থাকা গাছের শুকনো ডালগুলো মড়মড় আওয়াজে ভাঙছিল। ঝরা পাতাগুলো মাড়িয়ে পথচলার আনন্দটা অন্যরকম হলেও এখানে একটা ভয়ার্ত পরিবেশ। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি কিংবা ডিসকভারি চ্যানেলে জঙ্গল অভিযাত্রীদের দেখে যতটা গা ছমছম করত, তারচেয়ে অনেক বেশি ছমছমে ভাবে চলে আসছিল। আমাদের কল্পনাবিলাসী মন অজানা আশঙ্কায় বারবার কেঁপে উঠছিল; মনে হচ্ছিল এই বুঝি কোনো ভয়ঙ্কর প্রাণি এসে সামনে এসে দাঁড়াবে! কিন্তু আবিষ্কারের নেশায় আমরা পেছনে না তাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম শুধু।

পুরো রেমা-কালেঙ্গাজুড়ে এমন বুনোফুলের দেখা মেলে; ছবিঃ লেখক



প্রচণ্ডে গরমে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। বারবার পানি পান করে গলা ভেজাচ্ছি।  মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। বিভিন্ন ধরনের নাম না জানা পোঁকামাকড়, মাকড়শা, প্রজাপতি দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। সবচেয়ে আনন্দ পাচ্ছিলাম বুনোফুলগুলো দেখে। কখনো লাল, কখনো সাদা, কখনো নীল কিংবা বাহারি রঙের বুনোফুলগুলো দেখে শৈশবে ফিরে যাচ্ছিলাম। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, “পাখির কাছে ফুলের কাছে মনের কথা কই কিংবা “তোমরা যখন শিখছ পড়া/মানুষ হওয়ার জন্য/আমি না হয় পাখিই হব/পাখির মতো বন্য”। এখানে এসে ইচ্ছে করছিল পাখি আর ফুলেদের সাথেই যদি একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যেত!

বনের যত গহীনে যাচ্ছিলাম নানা রঙের পাখিদের দেখা পাচ্ছিলাম। সাদা বক, বুলবুলি, টিয়া, প্যাঁচার দেখা পেলাম। আর দেখলাম হনুমান। দেখা দিয়েই নাই হয়ে গেলো! রেমা-কালেঙ্গায় অনেক হনুমান দেখা যায়। রামায়নে পড়া পাহাড় নিয়ে উড়তে থাকা হনুমান নয়, মুখপোড়া হনুমান ও চশমাপরা হনুমান। বানর দেখলাম কিছু ডালে ডালে ঝুলে আছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল এই চারজন কেন এসেছে এখানে? আমরা যখন আর তাদেরকে বিরক্ত করলাম না, ছবিও তোলার চেষ্টা করলাম না, তখন তারা নিজেদের কাজে মনোযোগ দিলো। বানরগুলো দেখে একটা মজার ও শিক্ষণীয় গল্প মনে পড়ে গেলো। “বনের রাজা সিংহ তার বাচ্চাদের নিয়ে শীতের সকালে রোদ পোহাচ্ছিলো। হঠাৎ বানর এসে তার লেজ ধরে ঝাঁকি দিলো! সিংহ যতটা না অবাক হলো, তারচেয়ে বিরক্ত হলো বেশি। বানর একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিংহকে কয়েকটা ভেঙচি কেটে হাসতে হাসতে চলে গেলো। সিংহশাবক সিংহকে বললো, এতবড় বেয়াদবি করে গেলো আপনি তাকে কিছুই বললেন না বাপজান! সিংহ বললো, বলার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। কয়েকদিন পর হঠাৎ বানর সিংহের সামনে পড়লো এবং এক থাপ্পরে তাকে শেষ করে দিলো সিংহ। সিংহশাবক অবাক হয়ে সিংহকে জিজ্ঞেস করলো, বাপজান, সেদিন এত অন্যায় করলো কিন্তু আপনি কিছুই বললেন না তাকে। অথচ আজকে সে কিছুই করেনি, কিন্তু তাকে মেরে ফেললেন? সিংহ জবাবে বললো, এটাই কৌশল বাবা! সেদিনের পর বানরটা ভালুককে লাথি মেরেছে, হাতির শুঁড় ধরে দুলেছে, গন্ডারের পিঠে চড়ে নেচেছে, হায়নাকে কাতুকুতু দিয়েছে, জিরাফকে থাপ্পড় দিয়েছে আর সবাইকেই বলেছে, রাজাকেই আমি মানি না, সেখানে তুমি কে? সেদিন ওকে মারলে সবাই আমাকে বলত, ক্ষমতা দেখিয়েছি, আমি স্বৈরাচারী এবং খুনি। আজকে দেখবি সবাই এসে বলবে, থ্যাংক ইউ রাজা সাহেব!”

এক ঘন্টার বেশি সময় ট্রেকিং করে একদম ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এই গরমে ট্রেকিং আদর্শ সময় নয়। তাছাড়া গাইডও নিইনি আমরা। ইচ্ছে ছিল বনের প্রাণিদের বিচরণস্থলে গিয়ে মায়াহরিণের দেখা পাব। কিন্তু আসলে গাইড ছাড়া এটা অসম্ভব বুঝে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। যাওয়া-আসা মিলিয়ে দুই ঘন্টা ট্রেকিং করে আমরা বাইকের কাছে চলে এলাম। বাইক নিয়ে এরপর চলে গেলাম বনের অন্যপাশে। বনের ভেতরে বাস করা আদিবাসীদের জীবনযাপনের চিত্র দেখব এখন।

দারুণ পাখি পাতি শ্যামাঘুঘু; ছবিঃ সামিউল মোহসেনিন



বনের মেঠোপথ ধরে বাইক নিয়ে চলছিলাম আর দেখছিলাম ধানখেত থেকে ধান কেটে মাড়াই করা হচ্ছে মাড়াইকলে। সেসব ধান বেপারীরা সাথে সাথে বস্তাবন্দী করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে একটা ত্রিপুরা পাড়ায় ২০/২৫টা ত্রিপুরা পরিবার আছেন। তারাই মূলত ধান চাষ করেন। শুধু ধান নয়, কলা, লেবুরও ব্যাপক চাষ হয়। অবশ্য পুরো বনজুড়ে কয়েকটা ত্রিপুরা পাড়া আছে। ত্রিপুরা ছাড়াও এই বনে আরও তিনটি আদিবাসীগোষ্ঠী রয়েছে। তারা হলো সাঁওতাল, তেলুগু ও উড়ং আদিবাসী।

আমরা কয়েকটা লেবুবাগানে গেলাম। লেবু ঝুলে আছে ডালে ডালে অনেক। লেবু এখন সস্তা হওয়ায় তারা বিক্রি করছেন না। দাম একটু বাড়লে বিক্রি করবেন বলে জানালেন। ত্রিপুরাদের বাড়িঘর দেখলাম। খুবই আন্তরিক তারা। একদম সাধারণ জীবনযাপন। খুব পরিশ্রমীও। আমাদের জল খাওয়ালেন। তীব্র গরমে ত্রিপুরা পুরুষদের কারও গায়েই জামা দেখলাম না, শুধু প্যান্ট/হাফপ্যান্ট ছাড়া। তাদের সুস্বাস্থ্য ও মেদবিহীন দেহ দেখে বুঝলাম কতটা কায়িক শ্রম দিয়ে থাকেন। নারীরাও দেখলাম সমানে কাজ করছেন। ত্রিপুরাপাড়ায় আধঘন্টার মতো কাটিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। তিনটা বেজে গেছে, ক্ষুধাও পেয়েছে ব্যাপক। আমরা বাইক নিয়ে এবার সোজা চলে এলাম গেটের কাছে। ফেরার পথে দেখে নিলাম শহিদ নায়েক আব্দুল মান্নান বীর উত্তমের সমাধিও। রেমা-কালেঙ্গায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এতবড় একজন বীর শুয়ে আছেন, অথচ আমরা জানতামই না!

আমাদের সফরসঙ্গী মুশতাক ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট আছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের সামনে। সেখানে উনি ফোন দিয়ে আমাদের জন্য একটা দেশি হাঁস রান্না করার কথা বলে দিলেন। রেমা-কালেঙ্গা ঘুরতে এলেও আজকের লাঞ্চটা হবে সাতছড়িতে। হাঁসের মাংস আমার বরাবরই পছন্দের। আমরা সোজা চুনারুঘাট বাজার হয়ে সাতছড়ির পথে ছুটতে থাকলাম। পেছনে ফেলে যাচ্ছি স্মৃতি। রেমা-কালেঙ্গার স্মৃতি। আগামী শীতে আবার রেমা-কালেঙ্গায় আসব, ক্যাম্পিং করার জন্য। তখন পুরো বনের অনেক বেশি জায়গা এক্সপ্লোর করে যাব অবশ্যই।

বনের ভেতরে ত্রিপুরাদের বাণিজ্যিক লেবু বাগান; ছবিঃ লেখক



যেভাবে যাবেনঃ রেমা-কালেঙ্গায় যেতে হলে আপনাকে শুরুতে ট্রেন কিংবা বাসে করে যেতে হবে শায়েস্তাগঞ্জ। সেখান থেকে চুনারুঘাট বাজার হয়ে কিংবা সরাসরি সিএনজি ও লেগুনা রিজার্ভ করে চলে যেতে পারবেন কালেঙ্গা বাজারে। তবে স্থানীয় এলাকায় রিজার্ভ গেলেই ভালো। ১২-১৫শ টাকার মধ্যে রিজার্ভ লেগুনা বা সিএনজি পেয়ে যাবেন।

যেখানে থাকবেনঃ রেমা-কালেঙ্গায় সরকারি ডাকবাংলো আছে থাকার জন্য। সংশ্লিষ্ট বিভাগে অনুমতি নিয়ে থাকা যায়। তাছাড়া সেখানে তিনটি বেসরকারি রিসোর্ট আছে। সিএমসি রিসোর্ট, রেমা-কালেঙ্গা ইকো রিসোর্ট ও নিসর্গ রিসোর্টে বুকিং দিয়ে গেলে থাকতে পারবেন।

যেখানে খাবেনঃ রিসোর্টে থাকলে সেখানেই খাবারের ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া চুনারুঘাট বাজারে অনেক রেস্টুরেন্ট আছে। সাতছড়িতে গেলে সেখানেও খেতে পারেন। খাবার নির্ভর করছে আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনার ওপর।

যখন যাবেনঃ রেমা-কালেঙ্গা যেহেতু ট্রেকিং করে দেখতে হয়, শীতকালটা সেরা সময়। ক্যাম্পিং করলেও শীতে যেতে পারেন। তবে বর্ষাকালে গেলে সবুজের সমারোহ বেশি দেখা যায়, তাই অনেকে সে সময়ও গিয়ে থাকেন।

সতর্কতাঃ বনে খাবার নিয়ে যাবেন না, বড়জোর পানি নিয়ে যাবেন। পানির বোতল, খাবার কিংবা চিপসের প্যাকেট বনে ফেলবেন না। বনের প্রাণিদের বিরক্ত করবেন না, অযথা শব্দ করবেন না। উপযুক্ত পোশাক ও জুতো পরে যাবেন ট্রেকিংয়ের জন্য। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে বাজে ব্যবহার করবেন না। সীমান্তর বেশি কাছাকাছি যাবেন না। বিজিবির নির্দেশনা মেনে চলবেন অবশ্যই। আর বর্ষাকালে জোঁক থাকে, সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ