জীবনানন্দ দাশের শহরে স্বপ্নের আনাগোনা

 


হোটেল অ্যাথেনা ইন্টারন্যাশনাল বরিশালের কাঠপট্টি রোডে অবস্থিত একটি স্ট্যান্ডার্ডমানের হোটেল। লোকেশনে একটা পুরোনোদিনের আবহ, সাথে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার এই হোটেলটি আমাদের থাকার জন্য ঠিক করেছে বরিশালের সন্তান ছোটভাই পিয়াস। সে নিজে এসে আমাদের রুমে চেকইন করিয়ে দিয়েছে, যেহেতু তার পরিচিত হোটেল। আমরা চারজন দুইটা ডাবল বেডের এসি রুম নিলাম। আমরা রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেলাম আবারও। এখনও দুপুরের খাবার খাইনি। বেলা চারটে বেজে গেছে। ঘরোয়া হোটেল নামক রেস্টুরেন্টে গিয়ে তাই শুরুতেই খেয়ে নিলাম। বাংলা খাবারের জন্য এটি বরিশালের জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট। আমাদের হোটেলের কাছেই। খেয়েদেয়ে বের হলাম সন্ধ্যার বরিশাল ঘুরে দেখতে। আমাদের চারজনের সাথে যোগ দিলো বরিশালের ছোটভাই পিয়াস ও তুহিন।

বরিশাল হাঁটতে নেমেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। এই শহরেই আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ বাস করতেন, যার কবিতায় কত কল্পনা করেছি শহরটাকে! আজ আমি সে কবির শহরে ভাবতেই একটা ভালোলাগার অনুভূতিতে মন আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। যা হোক, পিয়াস বললো দাদা, চলেন কীর্তনখোলার তীর থেকে ঘুরে আসি। বরিশাল শহর এই নদীর তীরে অবস্থিত। আমরা শুরুতেই গেলাম কীর্তনখোলার তীরে, মুক্তিযোদ্ধা পার্কে। সেখানে গিয়ে দারুণ মুগ্ধ হলাম। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন একটি জায়গা। নদীর তীরে অনেকখানি জায়গাজুড়ে পার্ক করে রাখা হয়েছে। বিকেলবেলায় এখানে হাঁটা কিংবা কীর্তনখোলার বিশুদ্ধ হাওয়া খেতে খেতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকার জন্য চমৎকার একটি জায়গা। মুক্তিযোদ্ধা পার্কে হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টি এলো। বরিশাল শহর আমাদের স্বাগত জানাল বৃষ্টিতে। আমরা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পার্কের শেষ মাথায় একটা চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। নদীর ওপর বৃষ্টি পড়ছে আর সে দৃশ্য দেখতে দেখতে চা খাচ্ছি, এই অনুভূতিটা স্বর্গীয়।

বরিশালে কীর্তণখোলা নদীর ওপারে অ্যাডামস ইডেন; ছবিঃ লেখক





বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর পিয়াস বললো দাদা, ওপারে একটা পার্ক আছে। চলেন দেখে আসি। পার্কটাও দেখা হবে, নদীতে নৌভ্রমণও হবে। নদীতে শ্যালো ইঞ্জিঞ্চালিত নৌকা আছে, যারা জনপ্রতি ২০টাকা করে ওপারে নিয়ে যায়। কিন্তু ১০জন না হলে নৌকা যায় না। আমরা ছয়জন, তাই পুরো নৌকা রিজার্ভ নিলাম ২০০ টাকায়। যে কীর্তখোলা নদীর কথা উপন্যাসে পড়েছি, কবিতায় জেনেছি, সিনেমায় দেখেছি, সেটাতে নৌকাভ্রমণ করে ওপারে গেলাম। নৌকা আমাদের একদম পার্কের সামনে নামিয়ে দিলো। পার্কটির নাম ‘অ্যাডামস ইডেন’। কীর্তনখোলার পাড়ে এমন চমৎকার পার্ক দেখে অবাক হলাম। এরমধ্যেই সন্ধ্যা হয়ে এলো। পার্কে জ্বলে উঠল নান্দনিক সব রঙিন আলো। এই পার্কে বড়, ছোট সবার জন্য সময় কাটানোর নানা উপকরণ আছে; আছে রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে ও কনফারেন্স হলও। পুরো পার্ক ঘুরে রাতের কীর্তনখোলা দেখতে দেখতে আবারও এপারে চলে এলাম।

কীর্তনখোলা নদীর তীরে আরেকটি জায়গা আছে, যেখানে সন্ধ্যার পর থেকেই মানুষের ভীড় জমে। সেটা হলো ত্রিশ গোডাউন। এখানে নানারকম স্ট্রিটফুড পাওয়া যায়। এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত আইটেম হলো বুম্বাই মরিচের ঝাল সিঙারা। আমরা একটা দোকানের সনে বসলাম। একদম নদীর তীরেই চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে। সিঙারা অর্ডার করলাম ৩০টা। প্রতিটি তিন টাকা করে সিঙারা। দেশে এখনও তিন টাকায় সিঙারা পাওয়া যায় এটাও অবাক করল! সিঙারাগুলোর সাইজ অনেক ছোট। একেক কামড়ে একেকটা খাওয়া যায়। আমরা ৩০টা খেয়ে আরও ২০টা নিলাম। নদীর বাতাস খেতে খেতে সিঙারা খাচ্ছিলাম। আকাশ মেঘলা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সিঙারা খেয়ে তাই উঠে পড়লাম। এখন যাব বঙ্গবন্ধু উদ্যানের দিকে।

বেলস পার্ক বা বঙ্গবন্ধু উদ্যান বরিশাল শহরের সবচেয়ে বড় খোলা উদ্যান। বিশাল মাঠের চারপাশে ওয়াকওয়ে, মাঝখানে রাস্তার দিকে বঙ্গবন্ধুর সুবিশাল ম্যুরাল। আর একপাশে অসংখ্য স্ট্রিটফুডের দোকান। সেখানে প্রচুর মানুষ। সন্ধ্যার পর এই জায়গাটা লোকে-লোকারণ্য হয়ে ওঠে। এখানে বসে আড্ডা দেয় নগরবাসী। সারাদিনের কর্মব্যস্থতা শেষে এই জায়গাটি হয়ে উঠে মিলনমেলা। আমরা পুরো উদ্যানে হেঁটে এসে একটা চায়ের দোকানে বসলাম। সেখানে নানা ধরনের চা। মালাই চা টেস্ট করলাম। মাটির ঘটিতে চা খাওয়ার মজাই আলাদা। বঙ্গবন্ধু পার্ক থেকে আমরা সোজা চলে গেলাম আমাদের রুমে। আজকে আর কিছু করার নেই। শরীরও ক্লান্ত। গল্প করে, ফোনে নানা জায়গায় কথা বলে ঘুমিয়ে গেলাম।



বরিশালে দ্বিতীয় দিন

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ৭টায়। আজকে আমাদের অনেক জায়গায় ভ্রমণ করতে হবে। সারাদিনের জন্য প্রস্তুতি দরকার। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর ফেসবুকে লগিন করতেই একটা ভয়াবহ দুঃসংবাদ চোখে পড়ল। সুনামগঞ্জের বাউল শিল্পী ও জনপ্রিয় তরুণ গীতিকার-সুরকার পাগল হাসান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। খবরটা দেখে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। পাগল হাসানের গান কত শুনেছি। এত অল্প বয়সে আমাদের অনিরাপদ সড়ক এভাবে একজন প্রতিভাবান শিল্পীর প্রাণ কেড়ে নিলো! কী আর করা। লাইফ মাস্ট গো অন। নিজে একজন পরিব্রাজক, দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াই। নিরাপদ সড়ক কতটা দরকার সেটা আমি অন্তত বুঝি।

ফ্রেশ হয়ে শুরুতেই নাশতা করার জন্য বের হলাম। বরিশালে সকাল-সন্ধ্যা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের নাম অনেক শুনে এসেছি। এখানকার থালি সকালের নাশতা হিসেবে সেরা আইটেম। আমাদের হোটেল থেকে হেঁটে সকাল-সন্ধ্যায় যেতে মাত্র ৫ মিনিট লাগে। সকালের বরিশাল দেখতে দেখতে সকাল-সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম। এখনও শহরটা আড়মোড় ভেঙে জেগে ওঠেনি। হোটেলে গিয়ে দ্বিতীয়তলায় চলে গেলাম। একতলাকেই কৃত্রিমভাবে দুই তলা বানানো হয়েছে। ওপরে ওঠে চারজনের জন্য থালি অর্ডার করলাম। পিয়াস-তুহিন এখনও ঘুমে, তাদের ডাকলাম না। আমরা নাশতা খেয়ে রুমে গিয়ে রেডি হয়ে বের হওয়ার সময় তাদের ডেকে নেব। একটা থালায় দুইটা পরোটা, একপাশে সবজি, একপাশে ডাল আর একপাশে পায়েস এলো। এই থালির দাম ৫০ টাকা। খেতে দারুণ। পায়েসটাও অসাধারণ। সকালের নাশতা হিসেবে একদম সঠিক পছন্দ। তারপর এই দোকানের সরমালাই নিলাম। প্রতি সরমালাইয়ের পিস ৬০টাকা। এটাও দারুণ খেতে। পুরোনোদিনের ধ্রুপদী বাংলা গান চলছে রেস্টুরেন্টে। খেতে খেতে এমন মধুর সংগীত শোনার মধ্যে আলাদা তৃপ্তি ছিল। বরিশাল বেড়াতে গেলে সকাল-সন্ধ্যায় অবশ্যই ঢুঁ মারা উচিত।

নাশতা শেষে রুমে এসে গোসল সেরে নিলাম। এরমধ্যেই পিয়াস-তুহিনকে ফোন দিলাম। তারা চলে আসার পর বের হলাম। একটা অটোতে করে চলে গেলাম নতুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে। বরিশালে সবচেয়ে বড় ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এটা। এখানে মাহিন্দ্রা অটো পাওয়া যায় সারাদিনের জন্য। প্রতি অটোতে ৬-৮ জন অনায়াসে বসা যায়। কিন্তু এখানে এসে দেখি বিরাট সিন্ডিকেট চালকদের মধ্যে। যেমন খুশি তেমন ভাড়া হাঁকাচ্ছিল। দরদাম করেও কুলকিনারা পাচ্ছিলাম না। আমরা আজকে সারাদিনের জন্য একটা অটো নেব, ঘুরবো শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাড়ি, দুর্গাসাগর দীঘি, গুঠিয়া মসজিদ ও লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। শেষমেষ একটা অটো ঠিক হলো ১৫শ টাকা ভাড়ায়, আমাদের চারটি গন্তব্যে নিয়ে যাবে এবং শেষে শহরে নামিয়ে দেবে। প্রথম গন্তব্য হলো শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাড়ি ও স্মৃতি জাদুঘর। শহর থেকে এর দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার।

আজকে প্রচণ্ড গরম। সূর্য যেন বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। সকাল থেকেই তেজ শুধু বাড়ছে। আমরা বরিশাল-ঝালকাঠির পিচঢালা মসৃণ সড়ক ধরে, দুইপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। চলন্ত গাড়িতে গান গাইতে গাইতে ভ্রমণ এক অন্যরকম আনন্দ। চারজন সিলেটি পর্যটকের সাথে দু’জন স্থানীয় বরিশালের লোক মিলে একটা আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলো। আধঘন্টার মধ্যে আমরা চলে গেলাম বনারীপাড়া।

শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘর, চাখার, বনারীপাড়া, বরিশাল; ছবিঃ লেখক



শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘর

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার চাখার ইউনিয়নে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বসতভিটার ২৭ একর জায়গাজুড়ে শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয়দের কাছে এই জাদুঘরটি চাখার প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর হিসেবে পরিচিত। অবিভক্ত বাংলার প্রধান মুখ্যমন্ত্রী ও অবিস্মরণীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক পিতার মৃত্যুর পর কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসার উদ্দেশ্যে ১৯০১ সালে বরিশাল আগমন করেন। আইন ব্যবসার পাশাপাশি তিনি চাখারের জমিদারিত্বের দেখাশোনা করতেন। ১৯৮৩ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ইতিহাস ও স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এই জাদুঘর নির্মাণ করা হয়।

পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘরে তিনটি প্রদর্শনী কক্ষ, একটি অফিস কক্ষ, একটি বিশ্রামাগার ও একটি গ্রন্থাগার রয়েছে। জাদুঘরের বাম দিকে শেরে বাংলার একটি বিশাল প্রতিকৃতি এবং তার পাশে জীবনকর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক ছবি এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন ফিচার ও ছবি রাখা আছে। আরও আছে তাঁর বিরল আলোকচিত্র, ব্যবহৃত আসবাপত্র, চিঠিপত্র, সুন্দরবনের শিকার করা কুমিরের মমি, অষ্টভুজাকৃতির মারীচী দেবী মূর্তি, কালো পাথরের শিবলিঙ্গ, ব্রোঞ্জের বৌদ্ধমূর্তি, স্বর্ণমুদ্রা, পাথরের ছোট শিবলিঙ্গ মূর্তি, রৌপ্যমুদ্রা, শ্রী লঙ্কা, ব্রিটিশ ও সুলতানি আমলের তাম্রমুদ্রা এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনে থাকা এই জাদুঘরে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। এই জাদুঘরে প্রবেশমূল্য ১০ টাকা ও বাচ্চাদের জন্য ৫ টাকা জনপ্রতি। খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।

আমরা জাদুঘর দেখে বের হয়ে পাশের একটা বাড়ি দেখলাম। ছোট্ট বাড়ির সামনে লেখা Here Lived Shere Bangla (এখানে শেরে বাংলা বাস করতেন)। বাড়িটি তালাবদ্ধ। সামনে একটা ওয়াকওয়ে। সেটা ধরে বারান্দা পর্যন্ত গেলাম। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে জাদুঘরের অন্যপাশে দেখলাম শেরে বাংলার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও হক হাউজ। এই হক হাউজে শেরে বাংলার বংশধরেরা এখন বাস করেন বলে জানা গেলো। প্রচণ্ড গরমে আর বেশিক্ষণ থাকলাম না। বাইরে বের হয়ে পানি খেয়ে রওয়ানা দিলাম গুঠিয়া মসজিদের দিকে। ১০/১৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম মসজিদের মূল প্রবেশপথে।

বায়তুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্সের মূল মসজিদ। যাকে গুঠিয়া মসজিদ নামে চেনে সবাই; ছবিঃ লেখক

গুঠিয়া মসজিদ

গুঠিয়া মসজিদ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম জামে মসজিদ, যা বরিশাল বিভাগে উজিরপুর থানার গুঠিয়া ইউনিয়নের চাংগুরিয়া গ্রামে অবস্থিত। বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে ১৪ একর জমির উপর বিশাল এই মসজিদটি গড়ে তোলা হয়েছে। গুঠিয়া মসজিদ নামে পরিচিতি পেলেও এর নাম বাইতুল আমান জামে মসজিদ ও ইদগাহ কমপ্লেক্স। ২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর গুঠিয়া ইউনিয়নের এস. সরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদ এবং ঈদগাহ্ কমপ্লেক্সের নির্মাণ শুরু করেন। ২০০৬ সালে গুঠিয়া মসজিদ ও ইদগাহ্ কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ হয়।

গুঠিয়া মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে রয়েছে একটি মসজিদ, সুদৃশ্য মিনার, ২০ হাজার লোকের ধারণক্ষমতার ঈদগাহ্ ময়দান, একটি ডাকবাংলো, এতিমখানা, গাড়ি পার্কিং, পুকুর, লেক এবং ফুলের বাগান। মসজিদটিতে একসাথে প্রায় ১৫০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন এবং মসজিদটির মিনারের উচ্চতা প্রায় ১৯৩ ফুট। মসজিদটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা এবং মসজিদের নির্মাণশৈলীতে ইউরোপ, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের নামকরা মসজিদের ছাপ লক্ষ করা যায়। মসজিদটিতে উন্নমানের কাঁচ, ফ্রেম, এবং বোস স্পিকার ব্যবহার করা হয়েছে। গুঠিয়া মসজিদটির তত্ত্বাবধানে ৩০ জন কর্মচারী সর্বদা নিয়োজিত রয়েছেন। এই মসজিদটিতে মহিলাদের পৃথক নামাজ আদায়ের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

আমরা পুরো মসজিদটিতে ঘুরে শেষে মূল আঙিনায় গেলাম। মসজিদটির ভেতরে যাওয়ার অনেক ইচ্ছে থাকলেও এ যাত্রায় সম্ভব হলো না। কারণ নামাজের সময় শেষ হয়ে গেলে এটি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। এত অসাধারণ একটি মসজিদ, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দেখতে আসেন, অথচ তালাবদ্ধ করে রাখা হয়! মানুষের দেখার জন্য এটা উন্মোক্ত রাখলে ভালো হতো। আশা করি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নমনীয় হবেন।

মসজিদ থেকে বের হয়ে আমরা এখন রওনা দিলাম দুর্গাসাগরের দিকে। পথিমধ্যে একটা ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত মিষ্টির দোকান পড়ে। নাম জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এখানকার সন্দেশ বেশ ভালো। আমরা টেস্ট করার জন্য নেমে সন্দেশ অর্ডার দিলাম। দোকানদার সজল চন্দ্র ভদ্র’র সাথে কথা বলে জানলাম এই দোকানের বয়স ৭০ বছরের বেশি। সজলদার দাদু এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বংশ পরম্পরায় ওনারা এটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য সজলদার পরের প্রজন্মের কেউ এই পেশায় আসছে না। হয়তো একদিন এটাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে!

টলটলে জলের দুর্গাসাগর দীঘি, মাধবপাশা, বরিশাল; ছবিঃ লেখক



দুর্গাসাগর দিঘী

দুর্গাসাগর দিঘী বরিশাল শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে স্বরূপকাঠি–বরিশাল সড়কের মাধবপাশায় অবস্থিত। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ এলাকাবাসীর পানির সংকট নিরসনের জন্য মাধবপাশায় একটি বৃহৎ দীঘি খনন করে তাঁর মা দুর্গা দেবীর নামানুসারে দিঘীটিকে ‘দুর্গাসাগর’ নামকরণ করেন। ঐতিহাসিক এই দিঘীটির জলাভূমির আয়তন ২৭ একর এবং পাড় ও জমিসহ মোট আয়তন ৪৫.৪২ একর। বর্তমানে জেলা প্রশাসন দুর্গাসাগর দিঘী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। দুর্গাসাগর দিঘীর তিনদিকে ৩টি ঘাটলা এবং মাঝখানে একটি টিলা বা ছোট দ্বীপ রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে এই দুর্গাসাগর মাধবপাশা দীঘি নামেও ব্যাপক পরিচিত।

দুর্গাসাগর দীঘিতে ঢুকেই দেখলাম একটি বড় ঘাট, পুরোটা পাকা টাইলস করা। ঘাটের চারপাশে অনেক বৃক্ষরাজি থাকায় সুনিবিড় ছায়ায় ঘেরা। আমরা ঘাটে বসে অনেক সময় কাটিয়ে দিলাম। এত তীব্র গরমেও এখানে ফুরফুরে হাওয়ায় প্রাণটা শীতল হয়ে যাচ্ছিল। এত প্রশান্তিময় জায়গা বরিশাল শহরের এত কাছে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল হতো। বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে কাটিয়ে দীঘির চারপাশে একটা ঘুরান্টি দিলাম। দীঘির পাড়ে একটা মিনি চিড়িয়াখানা, শিশুদের খেলাধুলার কিছু রাইড, সুন্দর একটা ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট আর বসার ছাউনি আছে। বিশাল এই দীঘিকে আরও ভালোভাবে সাজালে এখানে প্রচুর বিদেশী পর্যটকও আসবে। বরিশালের এই দীঘিটি দেখলে মুগ্ধ হবে না এমন মানুষ নেই!

দুর্গাসাগর দীঘি ছেড়ে যেতেই মন চাইছিল না। কিন্তু আমাদের কড়া শিডিউল, সময় অপচয় করার সুযোগ নেই। তাই ঘন্টাদেড়েক এখানে কাটিয়ে বের হলাম। এবার আমাদের গন্তব্য লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। দুর্গাসাগর থেকে মোটামুটি মিনিটবিশেক লাগল আমাদের লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি পৌঁছাতে।

ঝুঁকিপূর্ণ লাকুটিয়া জমিদার বাড়ির আশু সংস্কার প্রয়োজন; ছবিঃ লেখক



লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি বরিশাল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত লাকুটিয়া গ্রামে। ১৭০০ সালে রুপচন্দ্র রায়ের পুত্র রাজতন্ত্র রায়ের হাত ধরে ইট-পাথর আর সূড়কি গাঁথুনিতে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে ৪০০ বছরের পুরনো লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন একটি মঠ, সুবিশাল দীঘি, মাঠ এবং কারুকার্যমণ্ডিত জমিদার বাড়ি। জানা যায়, উনিশ শতকেও জমিদার রাজচন্দ্র রায়ের জমিদার বাড়িটি এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কিন্তু কালের আবর্তে আজ সবই শুধু স্মৃতি। এই জমিদার পরিবারের সদস্যদের অবদানে বরিশালে নির্মিত হয়েছে রাজচন্দ্র কলেজ ও পুষ্পরানি বিদ্যালয়। বর্তমানে লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে আছে। জমিদার বাড়ির প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দ্বিতল প্রাসাদ ছাড়াও লাকুটিয়া জমিদার বাড়ির অন্য সব স্থাপনার মধ্যে একাধিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

জমিদার বাড়িটি দেখে আফসোস হলো আমাদের। এখন অনেকটাই অযত্নে-অবহেলায় বাড়িটি পরে আছে। এটাকে সংস্কার করে পর্যটকদের দেখার উপযোগী করলে এই এলাকার আর্ত-সামাজিক উন্নয়ন ঘটত। অনেক পর্যটক এখানে আসত। কারণ এমন নান্দনিক জমিদার বাড়ি আমাদের দেশে খুব কমই আছে। এর নকশা দেখলে মুগ্ধ হবে যে কেউ। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব আর পর্যটন বিভাগের এদিকে নজর দেয়া আশু জরুরি।

জমিদার বাড়ি থেকে বের হতে হতে চারটার বেশি বেজে গেলো। ইতোমধ্যে সবার ক্ষিদেও লেগেছে বেশ। দুপুরের খাবার খাওয়ার সুযোগই পাইনি। ড্রাইভারকে বললাম আমাদের শহরে নামিয়ে দিয়ে আসতে। পিয়াস গতকাল বলেছিল একটা বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকানের নাম। সেখানেই যাব। ড্রাইভার আমাদের বিরিয়ানির দোকানের সামনে নামিয়ে দিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে গেলো।

কবি জীবনানন্দ দাশ সড়কের নাজেম'স রেঁস্তোরা; ছবিঃ লেখক



বরিশালের বিরিয়ানি

বিরিয়ানি খেতে এসেও প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ে গেলো। কারণ যে রেস্টুরেন্টে আমরা খেতে গেলাম সেটার নাম নাজেম’স। এটি বরিশাল শহরের কবি জীবনানন্দ দাশ রোডে পড়েছে। এই রেস্টুরেন্টের কাঁচের দরজায় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন স্টিকার প্রিন্ট করে রাখা, যেটা মুগ্ধ করল আমাদের। ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।

সবার পছন্দে আমরা নিলাম বাসমতি চালের মাটন বিরিয়ানি। সাথে সালাদ, চাটনি ও কোমল পানীয়। এই বিরিয়ানিটা কাচ্চির মতো দেখতে হলেও কাচ্চি থেকে স্বাদটা একটু ভিন্ন। অনন্য একটি বিরিয়ানির স্বাদ পেলাম। খুব মুখরোচক খাবার। এই রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি খেতে হলে বরিশালেই যেতে হবে। অন্য কোথাও তাদের শাখা নেই।

খেয়েদেয়ে দেখলাম পাঁচটার বেশি বাজে। আমাদের এবার হোটেলে যাওয়া দরকার। রেস্ট নিয়ে বের হতে হবে। রাতে আমাদের লঞ্চ। ঢাকায় ফিরে যাব রাতেই। কিন্তু বের হওয়ার পর পিয়াস বললো, দাদা আর কবে আসবেন ঠিক নেই। চলেন বরিশালের ব্রজমোহন বা বিএম কলেজটা দেখবেন। তারপর রুমে চলে যাবেন। ভাবলাম, যাই। এইটুকু সময়ে কী আর হবে!

সরকারি ব্রজমোহন কলেজ ক্যাম্পাসের একাংশ; ছবিঃ লেখক



ব্রজমোহন কলেজ

ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ও প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৮৯ সালে প্রখ্যাত সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী অশ্বিনীকুমার দত্ত কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। সেসময়ে এ কলেজের মান এতই উন্নত ছিল যে অনেকে একে ‘দক্ষিণ বাংলার অক্সফোর্ড’ বলে আখ্যায়িত করতেন।  ১৯৬৫ সালে কলেজটির জাতীয়করণ করা হয় ও বর্তমানে কলেজটি বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। কলেজটিতে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ২২টি বিষয়ে ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ১৯টি বিষয়ে পাঠদান করা হয়ে থাকে। কলেজে ছাত্রদের জন্য ৩টি (মুসলিম হোস্টেল, মহাত্মা অশ্বিনীকুমার হোস্টেল, কবি জীবনানন্দ দাশ হিন্দু হোস্টেল) এবং মেয়েদের জন্য চারতলা ভবনের ১টি হোস্টেল (বনমালি গাঙ্গুলি মহিলা হোস্টেল) রয়েছে। কলেজের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে মোট বইয়ের সংখ্যা চল্লিশ হাজারের বেশি। এখানে ১টি বাণিজ্য ভবন, ২টি কলা ভবন, একটি অডিটোরিয়াম, ৪টি বিজ্ঞান ভবন ও ৩টি খেলার মাঠ রয়েছে। এছাড়া দুই প্রান্তে দুটি দীঘি কলেজের সৌন্দর্যকে করে তুলেছে মনোমুগ্ধকর।

আমরা কলেজে ঢুকে একটা মাঠে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। আরও অনেকেই বসে আছেন দেখলাম। সেখান থেকে পুরো কলেজ ঘুরলাম। কবি জীবনানন্দ দাশ হলের সামনে গিয়ে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। এই কলেজে কবি একসময় অধ্যাপনা করতেন ভেবে আপ্লুত হলাম। হয়তো কবির হেঁটে যাওয়া পথ ধরে এখন আমরাও হাঁটছি! দেশভাগ কবিকে বরিশাল ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিল। 'মহাপৃথিবী' কাব্যগ্রন্থের 'বলিল অশ্বথ সেই' কবিতাটিতে কবির বরিশালের বাড়ি ছেড়ে যাবার বেদনা ফুটে উঠেছে-

বলিল অশ্বত্থ ধীরে: 'কোন দিকে যাবে বলো-

তোমরা কোথায় যেতে চাও?

এত দিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:

ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;

এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের

তোমরা যেতেছ চ'লে পাই নাক' টের!

বোঁচকা বেঁধেছ ঢের-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;

আবার কোথায় যেতে চাও?

পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নি ক-এই-তো সে-দিন

তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়

-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!

এই কলেজের মাঠগুলো, পুকুরগুলো বেশ সুন্দর। অনেক ভালো লাগল আমাদের। তবে প্রাচীন লাল রঙের ভবনগুলো অনেক মুগ্ধ করল। বেশ কিছুটা সময় কলেজে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এলো। এবার আমাদের নীড়ে ফেরার পালা। এই শহরের অতিথি হিসেবে আজকেই শেষদিন আমাদের। বের হয়েই তাই চলে গেলাম হোটেলে। গিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিলাম। ডিভাইসগুলোকে চার্জ করে নিলাম। রাত আটটায় হোটেল থেকে চেকআউট করে রওনা দিলাম বিআইডব্লিউটিএর নৌবন্দরের দিকে। রাত ন’টার লঞ্চে আমরা ঢাকার পথে রওনা দেব।

এই লঞ্চে করেই ফিরেছিলাম ঢাকায়; ছবিঃ লেখক



অ্যা জার্নি বাই লঞ্চ ফ্রম বরিশাল টু ঢাকা

পদ্মাসেতু হয়ে যাওয়ার পর ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চলাচলকারী বেশিরভাগ লঞ্চই বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বিলাসবহুল লঞ্চ শৌখিন মানুষদের জন্য এখনও চালু আছে। সপ্তাহের বিশেষ বিশেষ দিন ও ইদের সময়গুলোতে লঞ্চে ব্যাপক ভীড় হয়। আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চজার্নি করার। এবার সে ইচ্ছে পূরণ হলো কুয়াকাটা-বরিশাল ভ্রমণে এসে।

গতকাল বরিশাল পৌঁছেই লঞ্চের টিকেট কেটে নিয়েছিলাম আজকের জন্য। আজ বৃহস্পতিবার লঞ্চে ব্যাপক ভীড় হওয়ার দিন। আগেরদিন টিকেট না কাটলে আজ টিকেটই পেতাম না। আমরা পারাবাত-১৮ নামের বিলাসবহুল একটি লঞ্চের একটি এসি কেবিন নিয়েছিলাম। চারজনের জন্য কেবিনের ভাড়া ছিল তিন হাজার টাকা।

লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখি ব্যাপক লোকের সমাবেশ। সবগুলো লঞ্চ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মোটামুটি ৯টার পরপরই একের পর এক লঞ্চ ছেড়ে যায়। আমরা পিয়াস আর তুহিনকে বিদায় দিয়ে লঞ্চে উঠে পড়লাম। গত দুইদিন এই দুটো ছেলে আমাদের সাথে ছিল পুরোটা সময়। তাদের ছেড়ে যাচ্ছি, খারাপ লাগছে। তবু যেতে তো হবেই। আমাদের লঞ্চ ছাড়ল সাড়ে নয়টায়।

লঞ্চের ডেক, ওপেন স্পেস সব ভর্তি হয়ে গেছে আগেই। আমাদের কেবিনের সামনের প্যাসেজ বা হাঁটার পথেও অনেক লোক বসে আছে। আমরা কেবিনে ঢুকে গা-টা একটু ঠাণ্ডা করার জন্য ফ্যানগুলো ছেড়ে দিয়ে রেস্ট করতে লাগলাম। আজকে এত গরম যে ঘেমেটেমে একাকার হয়ে গেছি। লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণ পর ক্যাটারিংয়ের লোক এলো খাবারের অর্ডার নিতে। আমরা ভাতের সাথে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ অর্ডার করলাম। তারপর বের হয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে এলাম লঞ্চটা। আমাদের কেবিন তৃতীয় তলায়। আমরা অন্যান্য ফ্লোরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরো লঞ্চ। এরপর আবার কেবিনে এলাম রাতের খাবার খেতে। সাড়ে দশটার দিকে খাবার এলো।

প্রমত্তা পদ্মার বুকে ভেসে ভেসে এই নির্জন রাতে খাবার খাওয়ার আনন্দ বর্ণনাতীত। তার ওপর খাবারগুলো ছিল মজাদার। মাছ, ডালসহ প্রতিটি আইটেমই ভালো লাগছিল খেয়ে। লঞ্চের খাবার যে এত সুস্বাদু সেটা জানা ছিল না। খেয়েদেয়ে আমরা চলে গেলাম লঞ্চের ছাদে। ইতোমধ্যে বৃষ্টি হয়েছে, আকাশ মেঘলা। তবু একফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে বারবার মেঘের ফাঁকে। সে চাঁদের আলো পড়ছে পদ্মার বুকে। আমরা মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হচ্ছি। দূরে দেখা যাচ্ছে একের পর এক লঞ্চ আসা-যাওয়া করছে। অদ্ভুত একটি রাত ছিল। কখন যে রাত আড়াইটা বেজে গেলো বুঝতেও পারলাম না। সারাদিনের ক্লান্তি আমাদের, তাই ঘুমানো প্রয়োজন। কেবিনে এসে হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।

ভোরে দেখলাম লঞ্চের লোকেরা ডাকছে আমাদের দরজায় এসে। বলছে, ‘ঢাকা এসে গেছি, নেমে যান’। এত ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়েছিলাম যে কখন ভোর হয়ে গেছে বলতেই পারি না। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে নেমেই একটা দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগল। কালো কুচকুচে দূষিত বুড়িগঙ্গার পানি থেকে এমন দুর্গন্ধ বছরের পর বছর ধরে এলেও এর কোনো প্রতিকার হয় না। হয়নি কখনো। এই এক অদ্ভুত দেশ আমাদের!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ