সাগরকন্যায় সমুদ্রবিলাস


ইদের ছুটিতে দেশের প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রে ব্যাপক ভিড় হয়। হোটেল-মোটেলে একটা রুমও খালি থাকে না। রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় না বসার জায়গাও। আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে পর্যটকদের ৪০০টাকা বিল দিতে হয় বলে একবার তো নিউজ ভাইরাল হয়েছিল। ইদে কোথাও ঘুরতে গিয়ে সেটা উপভোগ করা মুশকিল হয়ে যায়। বরাবরের মতো তাই এবারও ইদে বের হইনি কোথাও। পরিকল্পনা ছিল ইদের ছুটি শেষ হওয়ার পরই ঘুরতে যাব সাগরকন্যা কুয়াকাটায়।

সিদ্ধান্ত ছিল সিলেট থেকে বাসে যাব সরাসরি কুয়াকাটা। কুয়াকাটা ঘুরে বরিশাল ফিরব বাসে। সেখান থেকে লঞ্চে ঢাকা, আবার ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট। যেই কথা সেই কাজ। দুইদিন আগেই বাসের টিকেট কেটে নিলাম আমরা চারজনের জন্য। মামুন পরিবহনের নন-এসি বাস সিলেটের কদমতলি বাস টার্মিনাল থেকে ছাড়ে সন্ধ্যা ছয়টায়, কুয়াকাটা গিয়ে পৌঁছায় সকালে। আমরা টাইমের আগেই কাউন্টারে চলে গেলাম। সামনের সারিতে পাশাপাশি চারটা সিট নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক ধরে।

প্রচণ্ড গরমে হাওয়া খেতে খেতে ছুটছিলাম। ঢাকায় যাওয়ার আগে ভৈরবে একটা যাত্রাবিরতি দিলো বাস। আমরা চারজন নেমে চা-নাশতা খেয়ে নিলাম। যাত্রাবিরতির পর ঢাকায় যেতে যেতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেলো। যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারে বেশ ভালোই জ্যাম ছিল। প্রায় ঘন্টাখানেক জ্যামে বসে থেকে বের হলাম ফাঁকা রাস্তায়। ঢাকায় গিয়ে বাসের চালক বদলে গেলো। নতুন চালকের সাথে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে বা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কের মসৃন সুবিশাল রাস্তা ধরে যেন উড়ে চললাম আমরা। দ্রুতই পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের পদ্মাসেতুতে। আমি এই সেতুতে আগেও ভ্রমণ করেছি। আমার বন্ধু জাকির প্রবাস থেকে এসে এখানে প্রথমবার এসেছে। সে এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মাসেতু দুটো দেখেই মুগ্ধ। সৌদিতে ছিল সে। জানাল সেখানেও নাকি এরকম সড়ক দেখেনি!


কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের এই রূপ মুগ্ধ করে সবাইকে; ছবিঃ লেখক



ভাঙ্গা চত্বরে গিয়ে বাস বরিশালের রাস্তায় ঢুকে গেলো। পথিমধ্যে গৌরনদীতে একটা হোটেলে আবারও বিরতি দিলো। রাত দুটো বেজে গেছে, আমরা রাতের খাবার খাইনি। ক্ষুধাও ছিল অনেক। নেমে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে আবার বাসে চড়ে বসলাম। বরিশাল শহর পেরিয়ে এবার বাস ছুটে চললো কুয়াকাটার দিকে। ভোর ছয়টায় গিয়ে আমাদের নামিয়ে দিলো কুয়াকাটা বাস টার্মিনালের কাছে। আমরা বাস থেকে নেমে একটা অটোভ্যান ভাড়া নিলাম বিচের পাশে হোটেলে যাওয়ার জন্য। ভোরের নির্মল হাওয়ায় প্রাণটাকে জুড়িয়ে নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সৈকতের পাড়ে। প্রথম দর্শনেই কুয়াকাটাকে ভালো লেগে গেলো আমাদের।

কুয়াকাটায় অনেক হোটেল আছে। কিন্তু সকালের দিকে রুম পাওয়া মুশকিল। কারণ চেকআউট টাইম দুপুর ১২টায়। কিন্তু আমাদের রুম দরকার। সারারাত ঘুমুইনি, তার ওপর জার্নির ক্লান্তি। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর বের হওয়ার প্ল্যান। আমরা সাগরলাগোয়া বিভিন্ন হোটেল ঘুরে রুম পেলাম না। এরপর হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম রাস্তার অন্যপাশে। হোটেল সৈকত নামের একটা হোটেলে গিয়ে সেখানে চারজন থাকার মতো একটা এসি রুম পেলাম, ভাড়াও যৌক্তিক। রাতপ্রতি দুই হাজার টাকা। আমরা আর যাচাই না করেই রুমটা নিয়ে নিই। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিই ঘন্টাদুয়েক। এরপর বের হই সকালের নাশতা করতে। একটা হোটেলে গিয়ে গরম গরম ভুনা খিচুড়ি অর্ডার দিই। ডিম, ডাল দিয়ে সেই খিচুড়ি খেয়ে আবার রুমে চলে যাই। তবে যাওয়ার আগে দুইটা বাইকের সাথে কথা বলে সারাদিন আমাদের নিয়ে ঘুরবে বলে রিজার্ভ করে নিই। মোট ১৮টা স্পট ঘুরে দেখানোর চুক্তি হয় বাইকপ্রতি এক হাজার দুইশো টাকায়। আধঘন্টা পরে তাদের হোটেলের সামনে চলে যেতে বলি। তারপর রুমে গিয়ে রেডি হয়ে বের হয়ে যাই। কুয়াকাটার সৌন্দর্য দেখার জন্য রওনা দেয়ার আগে আসুন সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে নিই কুয়াকাটার ইতিহাসও।



ইতিহাস থেকে কুয়াকাটা

প্রায় সোয়া দুইশ’ বছর আগে আরাকান থেকে বিতাড়িত দেড়শ’ রাখাইন পরিবার নৌকায় ভাসতে ভাসতে বাংলার দক্ষিণের একটি সৈকতে এসে নোঙর করে। সাগরপাড়ের শ্বাপদ-সঙ্কুল এই জনপদে গড়ে তোলে বসতি। সাগরের নোনাজল ছাড়া পান করার নিরাপদ পানি ছিল না। কুয়া খনন বা কেটে মিঠা ও নিরাপদ পানি সংগ্রহ করা শুরু করে তারা। সে সব কুয়ার নামানুসারে সেই থেকে জায়গাটার নাম হয় কুয়াকাটা।

এই কুয়াকাটার অবিচ্ছেদ্য অংশ এখানকার আদি বাসিন্দা রাখাইন সম্প্রদায়। এদের ভিন্ন আদলের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা অবলোকনের সুযোগ রয়েছে কুয়াকাটার রাখাইন পল্লিগুলোতে। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে এদের তাঁতসহ উল বুনন কার্যক্রম এবং তাঁতের মার্কেটও। যেখান থেকে কিনে নেয়া যায় রাখাইনদের হাতেবোনা নানা তাঁতপণ্য ও সুভ্যেনির। শুধু রাখাইন নয়, কুয়াকাটায় আছে জেলেদের বৈচিত্রময় জীবনের নানা গল্পও।

ভ্রমণবিলাসীদের আনন্দভ্রমণ ও অবকাশ কাটানোর অন্যতম মনোমুগ্ধকর জায়গার নাম সাগরকন্যা কুয়াকাটা। বেলাভূমির একই স্থানে দাড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বিরল মনোরম দৃশ্য দেখা যায় এই সৈকত থেকে। নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে কুয়াকাটার রয়েছে আলাদা সুখ্যাতি। দেশের সর্বদক্ষিণে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের শেষপ্রান্তে সাগরপাড়ের একটি জনপদ এটি। প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এক কিলোমিটার প্রস্থ সৈকতের সর্বত্র রয়েছে সুন্দরের বিপুল সমাহার ও চোখধাঁধানো রূপের বাহার। রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য লেক। রয়েছে সৈকত লাগোয়া নারিকেলবীথি। আরও রয়েছে জাতীয় উদ্যান বা ইকোপার্ক ও আন্ধারমানিক মোহনার উল্টোদিকের ফাতরার বিশাল ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলও।



কুয়াকাটায় সারাদিন ঘোরাঘুরি

হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তায় অপেক্ষমান আমাদের বাইকারদের পেছনে উঠে গেলাম। প্রতি বাইকে দু’জন করে রওনা দিলাম কুয়াকাটাকে দেখতে। রাস্তা থেকে নেমে আমাদের বাইক সৈকত ঘেঁষে ছুটে চলল প্রথম গন্তব্য গঙ্গামতির চরের দিকে। সাগরের তীর ধরে চমৎকার ঢেউ দেখতে দেখতে ১০/১৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম গঙ্গামতির চরে। এই চরটা মূলত একপাশে জঙ্গলের মতো গাছপালা, মাঝখানে গাছের মরে যাওয়া গুঁড়ি, অন্যপাশে নান্দনিক সমুদ্রসৈকতের মিশেলে তৈরি। বেশকিছুক্ষণ এখানে অবস্থান করলাম। ছবি ও ভিডিওগ্রাফি করে এরপর রওনা দিলাম অন্য গন্তব্যের দিকে। বাইকার ভাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিলাম আমাদের এরপরের গন্তব্য কাউয়ার চর, লাল কাঁকড়ার চর ও ঝাউবন। কিন্তু তার আগে আমাদের পার হতে হবে একটা ছোট্ট ক্যানাল। সেটার জন্য নৌকাভাড়া দিতে হবে প্রতি বাইক ৫০টাকা করে।

খালের কাছে পৌছে দুটো নৌকা পেলাম। পর্যটক আর বাইকে দুটোই একদম ভরে গেলো। আমরা পাঁচ মিনিটেই খালের ওপারে চলে গেলাম। বাইকগুলো নামার পর আমরাও নামলাম। আবার রওনা দিলাম কাউয়ার চরের দিকে। আবারও সমুদ্রের একদম কিনার ধরে ছুটে চললাম। প্রচণ্ড রোদ ছিল, কিন্তু সমুদ্রের শীতল হাওয়া আমাদের গরম লাগতে দিচ্ছে না। অসম্ভব ভালো লাগছিল প্রতিটি মুহূর্ত। বেশ চনমনে ভাব নিয়ে কাউয়ার চর, লাল কাঁকড়ার চর দেখে ঝাউবাগানে চলে গেলাম। লাল কাঁকড়ার চরে লাল লাল কাঁকড়াগুলোর ছুটোছুটি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। একেকটা কাঁকড়া বের হয়, কিন্তু মানুষের নড়াচড়া দেখেই গর্তে ঢুকে যায়। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার তারা গর্তের একদম কাছেই থাকে, সেখান থেকে দূরে আসে না। সবাই আসলে নিজের নিরাপত্তাটা আগে খুঁজে। কাঁকড়াও ব্যতিক্রম নয়।

ঝাউবনে গিয়ে এতটাই মুগ্ধ হলাম যে মনে হলো কুয়াকাটার এক অকৃত্রিম সৌন্দর্যে চলে এসেছি। অনেকে বলে কুয়াকাটায় দেখার কিছুই নেই। তাদের আসলে দেখার চোখই নেই। এই ঝাউবন এত সুন্দর, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন যে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। আবার বনের সামনের সৈকত আর সাগর মোহনীয় এক রূপ ধারণ করে থাকে। এখানে পর্যটক কম আসে, তাই বিচ এতটা সৌন্দর্য ধর রেখেছে বলে মনে হলো। ঝাউবনের সামনে একদম সাদা সাদা বালি রোদে চিকচিক করছিল। এত সুন্দর বালি আমাদের সৈকতগুলোতে দেখা যায় না। মনে হচ্ছিল এই ঝাউবনে একটা ক্যাম্প ফেলে এখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে পারলে জীবনটা সার্থক হবে। এত নান্দনিক জায়গা কুয়াকাটায় আছে এটা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।




গঙ্গামতির চরে অনেকগুলো খাবার হোটেল আছে। বিভিন্ন দোকানপাটের সাথে ডাব বিক্রেতাদেরও দেখা মেলে। আমরা কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়ার জন্য সেখানে থামলাম। ঘড়ির কাটা প্রায় ১২টা ছুঁই ছুঁই। সূর্য মধ্যগগনে। আমরা বিশ্রাম নিতে নিতে কচি ডাবের জল খেয়ে প্রাণটাকে জুড়িয়ে নিলাম। এরপর ছুটে চললাম মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধবিহার ও রাখাইন তাঁতপল্লি দেখতে। এটা বেশ দূরে। রাস্তা কিছুটা মাটির, কিছুটা পাকা আবার কিছুটা বালুকাময়। ২০/২৫ মিনিট বাইকে চলার পর পৌঁছে গেলাম মিশ্রিপাড়ায়।

জানা যায় মিশ্রি তালুকদার নামক প্রভাবশালী এক স্থানীয় ব্যক্তির নামে এই পাড়াটার নামকরণ করা হয়েছে। এখানে সীমা বৌদ্ধবিহারের বুদ্ধমূর্তিটা উপমহাদেশের অন্যতম বড়। বৌদ্ধবিহারের সাথে জাদুঘরও রয়েছে। সেখানে প্রবেশ করতে হলে ১০টাকা করে প্রতিজন টিকেট কাটতে হয়। আমরা টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম। বিশাল বুদ্ধমূর্তি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সেখান থেকে বের হয়ে জাদুঘরের পেছনে চলে গেলাম। জাদুঘরের ঠিক পেছনেই আছে একটা মিষ্টিপানির বড় কুয়া। কুয়াকাটায় এসে এই প্রথম কুয়া দেখলাম। মুগ্ধ হলাম বেশ। কুয়া দেখে রাখাইন তাঁতপল্লিতে ঢুকলাম। রাখাইনদের হাতে বোনা বিভিন্ন তাঁতপণ্যের দোকান ও বার্মিজ নানা খাদ্যপণ্য যথা আচার, চকলেটসহ নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। পর্যটকরাই এসব দোকানের ক্রেতা। তারা এলে ভালোই ব্যবসা হয়। দোকানগুলোতে কেনাকাটা করলে অবশ্যই দরদাম করে নিতে হবে। কারণ দোকানিরা অনেক দাম চেয়ে থাকে।




মিশ্রিপাড়া থেকে বের হয়ে সমুদ্রসৈকতের অন্যপাশটা দেখার জন্য রওনা দিলাম। সেইসাথে দুপুরের খাবারও খাওয়া দরকার। দুইটা বেজে গেছে, অনেক ক্লান্ত সবাই। ব্যাপক খিদেও লেগেছে। সমুদ্রের তীর ধরে লেবুর চরে যেতে মিনিটবিশেক লাগল। পথিমধ্যে আমাদের বাইক রাইডাররা বাইকে ফুয়েল ভরে নিলো। লেবুর চরে বেশকিছু হোটেল আছে। একদিকে সৈকত, অন্যদিকে লেবুবাগান। হোটেলগুলোতে সামুদ্রিক সবধরনের মাছ পাওয়া যায়। সাথে ডাল আর ভাত। আমরা একটা বড় আকারের সামুদ্রিক লাক্ষা মাছ নিলাম ১২০০টাকায়। এটা অর্ধেক ভেজে ও অর্ধেক ভুনা করে দেবে। সাথে আমাদের বাইক রাইডার রুবেলের নিজেদের জেলে নৌকা থেকে নেয়া তরতাজা কাঁকড়া ফ্রাই করার জন্য দিলাম। বাইকার রুবেল এগুলো আমাদের গিফট করেছে। ৮/১০টা কাঁকড়া ছিল, যেগুলোর দাম অনায়াসে ৫০০টাকা হতো। তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম।




আধঘন্টা রেস্ট করলাম হোটেলের ছাউনিতে বসে। পাওয়ার ব্যাংকে ডিভাইসগুলো চার্জ দিচ্ছি। এরমধ্যেই আমাদের খাবারগুলো চলে এলো। প্রথমে এলো কাঁকড়া ভাজা। সেগুলো খেতে খেতেই চলে এলো লাক্ষামাছের ভাজা ও ভুনা, সাথে ডাল আর ভাত। আমরা চারজন আর দুই রাইডার মিলে ছয়জনের বেশ মজার ও দারুণ ভুরিভোজ হলো। একটাই সমস্যা ছিল, ওদের ভাতগুলো বেশ মোটা। আমাদের এই মোটা ভাত খেয়ে অভ্যেস না থাকায় একটু অসুবিধা হলেও সমুদ্রসৈকতে বসে এরকম সামুদ্রিক মাছের ভোজপর্ব এক স্বর্গীয় অনুভূতি দিচ্ছিল। ফুরফুরে বাতাসের সাথে এমন লাঞ্চ, অনেকদিন মনে থাকবে।

খাওয়াদাওয়া শেষে লেবুর চর ঘুরে চলে গেলাম তিন নদীর মোহনায়। গভীর সমুদ্রের সাথে তিনটি নদীর মিল থাকার কারণে স্থানীয় জেলেরা এটার নামকরণ করে তিন নদীর মোহনা। ধীরে ধীরে পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে এই নামটি, গভীর সমুদ্রের সাথে মিলেছে সোনাতলা নদী, শিব্বিরিয়া নদী ও আন্ধারমানিক নদী। এক-একটি নদী তার নিজের রূপ ছড়িয়েছে; এবং ছড়িয়েছে সৌন্দর্যও। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিম দিকে নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তিন নদীর মোহনা। এই মোহনা থেকে সূর্যাস্তও দারুণভাবে দেখা যায়। এর একপাশে আছে চমৎকার ঝাউবন। কুয়াকাটার সর্বত্রই ঝাউবনের ছড়াছড়ি, যা কুয়াকাটাকে দিয়েছে অন্যমাত্রা। আর তিন নদীর মোহনায় বাইকে যখন সমুদ্রের একদম জল ছুঁয়ে ছুটে চলবেন, তখন এক অন্য লেভেলে চলে যাবেন। মনে হবে এমন একটি ভ্রমণের জন্যই আপনি বেঁচে ছিলেন!




তিন নদীর মোহনা দেখে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম শুঁটকিপল্লিতে। জেলেদের ছোট ছোট ঘর, তারপাশে শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। যদিও এখন শুঁটকি তৈরির মৌসুম না, তবু সারিবদ্ধভাবে বানানো বাঁশ আর কাঠের মাচায় কিছু শুঁটকি শুকোতে দেখলাম। সেগুলো দেখে চলে গেলাম সারি সারি শুঁটকির দোকানে। কত ধরনের যে শুঁটকি হতে পারে, ওখানে না গেলে বোঝা যায় না। একদম ছোটমাছ থেকে বড় বড় মাছের শুঁটকি পসরা সাজিয়ে বসেছে সবাই। একজন দোকানির সাথে কথা বলে শুঁটকির রকমফের, শুঁটকি বানানোর প্রসেস ও দাম সম্পর্কে জেনে নিলাম। তাদের দাবি পুরো অর্গানিক প্রসেসে শুঁটকি বানায় তারা। যদি সেটা হয়, তাহলে যারা শুঁটকিপ্রেমী তাদের জন্য কুয়াকাটার শুঁটকি বেস্ট অপশন।

শুঁটকিপল্লি থেকে বের হয়ে দেখি ঘড়িতে চারটে বেজে গেছে। এবার আমাদের ফিরতে হবে হোটেলে। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর চলছিল না আর। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার বের হতে হবে সূর্যাস্ত দেখা ও রাতের কুয়াকাটা দেখতে। বাইকাররা একদম হোটেলে নামিয়ে দিয়ে এলো। তাদের ভাড়া মিটিয়ে আমরা রুমে চলে গেলাম। বাইকারদের ব্যবহার ও আন্তরিকতা ছিল মুগ্ধ করার মতো। কেউ কুয়াকাটা গেলে নির্দ্বিধায় তাদের সার্ভিস নিতে পারেন। তাদের নাম্বার হলো- ০১৭২৯৬৪৭৭৯৮ (রুবেল) ও ০১৭৫৪২৭৮২৪২ (জুলহাস)



কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত ও রাতের কুয়াকাটা

সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আছে। কিন্তু কুয়াকাটায় এত মানুষ যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অকৃত্রিম সৌন্দর্য দেখার জন্য। দেশের আর কোথায় একই সৈকত থেকে এভাবে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখা যায় না। এজন্যই কুয়াকাটা অনন্য। যা হোক, ঘন্টাখানেক হোটেলে রেস্ট করলাম। সাড়ে পাঁচটার দিকে বের হয়ে সূর্যাস্ত দেখতে চলে গেলাম সৈকত ধরে বেশ কিছুটা দূরে। ইতোমধ্যে সূর্য লাল আভা ধারণ করেছে। আমরা সূর্যাস্ত দেখার জন্য যে পয়েন্টে গেলাম সেখানে বেশকিছু ট্যুরিস্ট দেখলাম আগে থেকেই অপেক্ষমান। লাল টকটকে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে, সমুদ্রের গভীর জলে হারিয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্যটা অকৃত্রিম এক সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন করে দেয় আমাদের।

সূর্যাস্তের পর আবছা আলো আর আবছা অন্ধকারে সৈকতের চেয়ার ভাড়া নিয়ে ঘন্টাখানেক শুয়ে শুয়ে সমুদ্রকে উপভোগ করলাম। ইতোমধ্যেই রাতের নীরবতা নেমে এসেছে। আকাশ মেঘলা, দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। আমরা সৈকত ধরে হেঁটে গেলাম রাতের কুয়াকাটাকে উপভোগ করতে। গিয়ে দেখি মূল পয়েন্টে আলোর ঝলকানি। জমজমাট এক রাতের কুয়াকাটা। প্রচুর মানুষজন ফিশ ফ্রাইয়ের দোকানগুলোতে ভিড় করেছে। রাতের আলো ঝলমলে কুয়াকাটায় কিছুক্ষণ ঘুরে আমরাও ফিশ ফ্রাইয়ের দোকানগুলোর সামনে চলে এলাম। সারি সারি সামুদ্রিক মাছের দোকানে রূপালি মাছের আঁশটে গন্ধ আর মাছভাজার গন্ধ মিলেমিশে একাকার। মাছ দেখে দেখে একটা দোকানে দুইটা মাছ কিনে নিলাম। একটা টোনা ও একটা কোরাল মাছ। মাছগুলো বারবিকিউ করে দেবে আমাদের। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সিট পেলাম। বসে অপেক্ষা করলাম মাছের জন্য। মাছ সামনে আসতেই আর তর সইল না। অন্যরা রুটি দিয়ে বারবিকিউ খেলেও আমি শুধুই মাছ খেলাম। অনেক মজাদার এই মাছের বারবিকিউ খেতে হলে কুয়াকাটা যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

ভোজনপর্ব সেরে চলে গেলাম আবারও সৈকতে। রাতের সৈকত উপভোগ করতে আমাদের হোটের সামনের বিচে চলে গেলাম। ওখানে আবারও চেয়ার ভাড়া নিলাম। কুয়াকাটায় চেয়ার ভাড়া কক্সবাজারের চেয়ে অনেক কম। শুধু চেয়ার না, সবকিছুই কক্সবাজারের চেয়ে কমে পাওয়া যায়। হোটেল, সামুদ্রিক মাছ, খাবারদাবার সবই যৌক্তিক দামে মেলে। যা হোক, ঘন্টাদুয়েক কাটিয়ে দিলাম এখানে। এরপর রুমে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি, আগের রাতের নির্ঘুম জার্নির ধকল কাটাতে ঘুম দরকার। রুমে গিয়ে তাই সবাই হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে, স্বপ্নের অচেনা জগতে।



বিদায় কুয়াকাটা

পরদিন সকালে আমাদের প্ল্যান ছিল সূর্যোদয় দেখব। কিন্তু এত ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছিলাম যে আর উঠতেই পারলাম না সকালে। এক ঘুমে সকাল নয়টা বেজে গেলো। যেহেতু আজ বরিশালে যাওয়ার বাসের টিকেট রাতেই কেটে নিয়েছি, আর থাকার সুযোগ নেই। সুর্যোদয়টা আরেকবার এসে দেখার জন্য স্টকে রেখে দিলাম। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা করতে বাইরে চলে গেলাম। পরোটা, ডিমভাজি, ছোলার ডাল, সালাদ দিয়ে খেয়ে রুমে এসে গোছগাছ করে নিলাম। ১২টায় আমাদের চেকআউট।

হোটেল সৈকতের সার্ভিস বেশ ভালো ছিল। আমরা বের হয়ে ভ্যানে করে কুয়াকাটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকলাম কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের দিকে। সেখান থেকে আমাদের বিআরটিসির এসি বাসটি ছাড়বে দুপুর ১টায়। কুয়াকাটা-বরিশাল রুটে নন-এসি বাস সব। এই গরমে এসি বাস সম্ভবত বিআরটিসিই শুধু অপারেট করে। আমরা জনপ্রতি সাড়ে তিনশ করে টিকেট কেটেছি। নন-এসি বাসে আরও কম ভাড়া।

প্রচণ্ড গরমে ঘেমেটেমে বাসে উঠলাম। এরপর আড়াই ঘন্টার বেশি সময় জার্নি করে পথে পথে নদী, সেতু, সরিষা খেত দেখতে দেখতে বরিশালে পৌঁছে গেলাম বিকেল চারটার আগেই। এক ছোটভাইকে ফোন দিলাম। তার পরিচিত হোটেলে যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম অটোরিকশায় চড়ে। বরিশাল নগরীর নান্দনিক রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে চলে গেলাম হোটেলে।

যেভাবে যাবেনঃ কুয়াকাটা সরাসরি বাসে যাওয়া যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট থেকে। দেশের জনপ্রিয় সকল বাস সার্ভিসের বাসগুলোতে যেতে পারেন। সাধারণত বাসগুলো সন্ধ্যায় ছেড়ে ভোরে কুয়াকাটা গিয়ে পৌঁছায়। পদ্মাসেতু ও লেবুখালি সেতু হওয়ায় কুয়াকাটা যেতে সময় লাগে আগের চেয়ে অনেক কম। এছাড়া ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে বরিশাল অথবা পটুয়াখালী পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে বাস ও রেন্ট-এ কারে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। কেউ ঢাকা থেকে ফ্লাইটে বরিশালে গিয়েও কুয়াকাটা যেতে পারেন।

যেখানে থাকবেনঃ থাকার জন্য বাজেট অনুযায়ী অনেক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। সৈকতের সাথে লাগোয়া হোটেলে থাকলে ভাড়া একটু বেশি গুনতে হবে, কিন্তু দারুণ একটা এক্সপেরিয়েন্স পাওয়া যাবে। তবে যেখানেই থাকেন, চেষ্টা করবেন আগে বুকিং করে যেতে। কারণ একদম সকালে গিয়ে রুম খালি পাওয়া মুশকিল। ১২টায় চেকআউট টাইম।

যেখানে খাবেনঃ অনেক রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ খেতে হলে সৈকতের লেবুর চরে লাঞ্চ করার চেষ্টা করবেন। আর রাতের সৈকতে বারবিকিউ ও ফিশ ফ্রাই খেতে পারেন। অবশ্যই মাছের দরদাম করে নেবেন। তবে কক্সবাজারের তুলনায় কুয়াকাটার মাছের দাম কমই হয়ে থাকে।

ক্রমশ… (দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ