দীর্ঘ পরিকল্পনা করে কিংবা অনেক প্রস্তুতি নিয়ে ভ্রমণে যাওয়া আমার
পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় না। আমি সবসময় হুটহাট বেরিয়ে পড়ি, সেটা কাছে কিংবা দূরে যেখানেই
হোক। সেদিন এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে একটা বিল নিয়ে চমৎকার একটা প্রতিবেদন দেখলাম।
বিলটা আমারই জেলাতে অবস্থিত। অবশ্য এই বিলটার নাম এর আগেও অনেকবার শুনেছি। এবার দেখার
জন্য আর তর সইল না। আমার দীর্ঘদিনের ভ্রমণসঙ্গী হেলালকে বলতেই সে বললো, চলে এসো, এবার
ঘুরে আসি বাইক্কা বিল থেকে। ইতোমধ্যেই তাকে নিয়ে আমি সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় ঘুরেছি।
বাইক রাইডার হিসেবে তার সাথে ভ্রমণ আমার জন্য স্বস্থিদায়ক ও আনন্দের।
মৌলভীবাজার শহর থেকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভৈরবগঞ্জ বাজারে যেতেই মনে
হলো খিদে পেয়েছে বেশ। আমরা বেরিয়েছি দুপুরে। লাঞ্চ করিনি কেউই। ভৈরবগঞ্জ স্থানীয় বাজার,
তার ওপর পাঁচ কিলোমিটার পরেই শ্রীমঙ্গল শহর। এখানে ভালোমানের রেস্টুরেন্ট পাওয়া মুশকিল।
হঠাৎ দেখলাম একটা রেস্টুরেন্ট, নাম ‘বাইক্কা বিল রেস্টুরেন্ট’। নামটা দেখেই ভালো লাগল।
হেলালকে বললাম এখানে খেতে হবে। সেও নাম দেখে আগ্রহী। রেস্টুরেন্টের সামনে বাইক পার্ক
করে খেতে বসলাম। কিন্তু রেস্টুরেন্টে বসে হতাশ হলাম। নামেই ‘বাইক্কা বিল’, কাজে লবডঙ্কা!
তেমন কিছুই নেই খাওয়ার। নলা মাছ, শুটকির ভর্তা, ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া ডাল দিয়ে খেয়ে নিলাম
কোনোমতে। জিভরক্ষা তো হলো।
বাইক্কা বিলের হিজল বনে হারিয়ে যেতে নেই মানা; ছবিঃ লেখক |
ভৈরবগঞ্জ বাজার থেকে একটু সামনে এগোলেই ডানদিকে একটি রাস্তা চলে গেছে।
ছোট গ্রামীণ রাস্তা, কিন্তু পিচঢালা পথ। সে রাস্তা ধরে দশ কিলোমিটার গেলেই মূলত বাইক্কা
বিলে চলে যাওয়া যায়। আমরা পিচঢালা পথ ধরে বাইক নিয়ে ছুটে চলছিলাম আর গাইছিলাম, ‘পিচঢালা
এই পথটারে ভালোবেসেছি, তার সাথেই এই মনটারে বেঁধে নিয়েছি…’ রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ,
নান্দনিক গ্রামীণ ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে বরুণা, হাজীপুর পেরিয়ে বাইক্কা বিলের কাছে চলে
গেলাম। বিলের কাছাকাছি দেখলাম বেশ কয়েকটি মৎস্য প্রকল্প বা ফিশারিজ। বিশাল বিশাল জায়গা
নিয়ে একেকটি মাছচাষের প্রকল্প পেরিয়ে বাইক্কা বিলের গেটে চলে গেলাম।
বাইক্কা বিলের গেট থেকে বিলে প্রবেশের মুখে একটা সেতু করা হয়েছে। সেই
সেতু ধরে বিল-কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে গিয়ে পৌঁছালাম। ঘড়িতে তখন বিকেল চারটা। শুনেছিলাম
ওখানে টিকেট কেটে বিলে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু কোনো টিকেট লাগল না আমাদের। সম্ভবত এখন
আর টিকেট লাগে না। আমরা অফিস থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে একটা ট্রেইল ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
বিলের পাড়ে জঙ্গলের মতো কিছু গাছ আছে। হিজল, করচ এসব গাছই বেশি। বর্ষায় এসব গাছ পানিতে
ডুবে থাকলেও শীতে নান্দনিক একটা ঘন জঙ্গলের মতো হয়ে যায়। ঝরা পাতারা পড়ে থাকা চারপাশে।
হাঁটতে দারুণ লাগে।
বাইক্কা বিল; ছবিঃ লেখক |
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তথা চায়ের জন্য বিখ্যাত মৌলভীবাজার একইসাথে হাওরবেষ্টিত
জেলা। হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, কাউয়াদিঘী হাওর ছাড়াও অসংখ্য ছোটবড় হাওর-বাওর জেলার
চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বাইক্কা বিল হাইল হাওরের পূর্বপাশে একটি জলাভূমির নাম। একসময়
হাইল হাওর তথা এই বিলে অবৈধ পাখি আর মাছ শিকারে বিলটি বিপন্ন হয়ে গিয়েছিল। জলজ উদ্ভিদ,
পাখি, মাছ হারিয়ে যেতে বসেছিল বিল থেকে। বিপন্ন এই হাওরকে বাঁচাতে বাংলাদেশ সরকারের
ভূমি মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালের জুলাইয়ে ২৫০ একর আয়তনের একটি বড় জলাভূমিকে মাছেদের অভয়াশ্রম
ঘোষণা করে। নিষিদ্ধ করা হয় সকলপ্রকার মাছ, পাখি ও প্রাণি শিকার। ফলে অতিথি পাখিরা আবার
ফিরতে শুরু করে বিলটিতে। সেই সাথে দেশি-বিদেশি পাখিরা গড়তে থাকে স্থায়ী আবাস। মাছেদের
অভয়াশ্রম ঘোষণার পর মাছের আবাদ বাড়তে থাকে বিলে। সেই মাছেরা ছড়িয়ে পড়ে গোটা হাইল হাওরে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ পেয়ে আবারও মাছে মাছে ভরে ওঠে হাইল হাওরের জলজ বুক।
বাইক্কা বিলের দুটি রূপ। শীত আর বর্ষায় আলাদা আলাদা রূপে হাজির হয়
বিলটি। শীতে অতিথি ও স্থানীয় পাখিদের কলতানে মুখর থাকে বিলটি। বর্ষায় শুধু জল আর জল।
জলজ নানা উপাদানে বর্ষায় বিলটি নান্দনিক এক রূপ পায়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ
অবধি, এমনকি কখনো কখনো মার্চেও বাইক্কা বিলে পাখির দেখা মেলে। পরিযায়ী পাখিদের এক দারুণ
মেলা বসে শীত আর বসন্তের বাইক্কা বিলে। প্রায় ৪০ প্রজাতির জলচর পাখি দেখা যায় বাইক্কা
বিলে। পরিযায়ী পাখির মধ্যে বালিহাঁস, খয়রা কাস্তে চরা, তিলা লালসা, গেওয়ালা বাটান,
পিয়াং হাঁস, পাতি তিলা হাঁস, নীলমাথা হাঁস, উত্তুরে লেঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, উত্তুরে
খুন্তিহাঁস, মরচে রং ভূতিহাঁস, মেটেমাথা টিটি, কালালেজ জৌরালি, বিল বাটান, পাতিসবুজলা,
বন বাটান, পাতিচ্যাগা, ছোট ডুবুরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, গয়ার, বাংলা শকুন, এশীয়
শামুকখোল, পানমুরগি, পাতিকুট, নিউপিপি, দলপিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, উদয়ী বাবু বাটান, ছোট
নথ জিরিয়া, রাজহাঁস, ওটা, ধুপনি বক, ইগল, ভুবন চিল অন্যতম। দেশি পাখিদের মধ্যে আছে
হলদে বক, দেশি কানিবক, গো–বক, ছোট বক,
মাঝেলা বগা, লালচে বক, বেগুনি কালেম, বড় বগা, দেশি মেটে হাঁস, সরালি, বালিহাঁস, পানমুরগি।
আর হিজলবনে তো শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, চড়ুই, বুলবুলি, দাগি ঘাসপাখি, টুনটুনি, ফিঙে ইত্যাদি
পাখিরা আছেই। পাখি ছাড়াও নানা প্রজাতির দেশি ও সুস্বাদু মাছ যথা আইড়, মেনি, কই, ফলি,
পাবদা, বোয়াল, রুই, গজারসহ ৯০ প্রজাতির মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ যেমন শাপলা, পদ্ম, পানিফল,
শালুক, সিংরাই, মাখনা প্রভৃতির দেখা মেলে বাইক্কা বিলে।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা বাইক্কা বিল; ছবিঃ লেখক |
ট্রেইল ধরে কিছুক্ষণ এগিয়ে যেতেই ডানদিকে খোলা জায়গা চোখে পড়ল আমাদের।
সেখান থেকে অদূরেই বিলের মধ্যে একঝাঁক পাখি বসে আছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি সেখানে আরও পর্যটক
বাইনোকুলার দিয়ে পাখি দেখছেন। আমাদের কাছে কোনো দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছিল না, ছিল ফোন।
স্যামসাং গ্যালাক্সি এস টুয়েন্টি টু আলট্রার টেন এক্স জুমে বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছিল
পাখিগুলো। বিদেশি অতিথিরাও আমাদের সাথে ফোনে এসে দেখছিলেন। ওনারা জানতে চাইছিলেন পাখিদের
নাম আমরা চিনি কী না। এতদূর থেকে দেখে নাম বলা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া আমি পাখি বিশেষজ্ঞও
নেই। দেশি পাখিদের চিনলেও পরিযায়ী পাখিদের দেখে চেনার উপায় নেই। কথায় কথায় জানলাম ওনারা
ভারত থেকে এসেছেন বাইক্কা বিলের পাখি দেখতে ও গবেষণা করতে।
এরপর ওয়াচ টাওয়ারের ট্রেইল ধরে আমরা সোজা চলে গেলাম ওয়াচ টাওয়ার। ভারতীয়
গবেষকদল বাঁ দিকের ট্রেইল ধরলেন। আমরা ওয়াচ টাওয়ারের একদম ওপরে ওঠে গেলাম। তিনতলা এই
টাওয়ার থেকে বিলের একটা ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ দেখা যায়, একদম খালি চোখে। শুধু তাই নয়, টাওয়ারের
দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় বাইক্কা বিলের কিছু প্রসিদ্ধ পাখি ও মাছেদের ছবিসহ নাম ডিসপ্লে
করে রাখা আছে। সেইসাথে ইংরেজি নাম ও বর্ণনাও দেয়া আছে। সেখান থেকে বেশ ভালো একটা ধারণা
পেলাম বিলে থাকা পাখি ও মাছগুলোর। ওয়াচ টাওয়ার থেকে চোখে পড়ল নিচেই আছে দুটো নৌকা।
নিশ্চয়ই বিলে ঘোরাঘুরির জন্য নৌকাগুলো রাখা। কিন্তু আজ আমাদের হাতে সময় কম, তাই নৌকায়
চড়ে বিলে ঘোরার আশা বাদ দিলাম। আরেকদিন এলে ঘুরবো। কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বললে তারা
নিশ্চয়ই মাঝির ব্যবস্থা করে দেবেন। অবশ্যই তার জন্য পয়সা খরচ করতেও রাজি।
শেষ বিকেলের সূর্য; ছবিঃ লেখক |
বিকেল ঘনিয়ে আসছে। সূর্যটা একদম রক্তিম আভা ছড়াতে শুরু করেছে বিলজুড়ে।
কনকনে হিমেল বাতাস শরীর আর মনটাকে প্রশান্ত করে দিচ্ছে ক্রমশ। টাওয়ার থেকে নামতে ইচ্ছে
করছে না। তবু নেমে এলাম। কারণ আমাদের আরও কিছুক্ষণ বিলে ঘুরতে হবে। এবার বাঁ দিকের
ট্রেল ধরে হাঁটলাম। চারদিকে হিজল-করচ গাছের নিচে ঝরাপাতাদের পায়ে মাড়িয়ে নির্জন বিলে
হাঁটার অনুভূতি যেন স্বর্গীয় আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছিল আমাদের মনে। তার সাথে পাখিদের কিচিরমিচির
শব্দ অসম্ভব এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পরে বিলের অন্যপাশটা দেখে এলাম।
সেই সাথে চোখে পড়ল কিছু পলিথিন, খাবারের প্যাকেটও। নিজের দেশটাকে নোংরা করার মিশনে
নেমেছে কিছু পর্যটক নামধারী নোংরা মানুষ। এত চমৎকার জায়গায় কেন ময়লা ফেলে আসে লোকে
আমার মাথাতেই আসে না। কর্তৃপক্ষের উচিত বিলে প্রবেশের সময় কোনো খাবার, পানির বোতল,
চিপসের প্যাকেট নিয়ে কাউকেই বিলে প্রবেশ করতে না দেয়া। পরিবেশ রক্ষার্থে আমাদের সবাইকে
ভূমিকা রাখতে হবে।
বিলের মূল অংশ থেকে বেরিয়ে এবার পূর্বদিকে চলে গেলাম। সেদিকে গিয়ে
সাদা বকের বড় একটা ঝাঁক দেখলাম। যদিও সেগুলো আগের পাখিদের চেয়ে বেশ দূরে। মোবাইলের
জুমের সাহায্যে সেগুলোও দেখে নিলাম। ইতোমধ্যেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। আমরা
আর দেরি করতে চাইলাম না। এখনও বেশ ভালো শীত পড়ে সন্ধ্যায়। বাইকে ঠাণ্ডা লেগে যাবে ভেবে
রওনা দিলাম। আসার পথে ভৈরবগঞ্জ বাজারে এক বন্ধুর অফিসে ঢুঁ মারলাম। সেখান থেকে ব্ল্যাককফি
খেয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নিলাম। এরপর ধরলাম বাসার পথ।
বাইক্কা বিলের প্রবেশপথ; ছবিঃ লেখক |
যেভাবে যাবেনঃ বাইক্কা বিলে
যেতে হলে শ্রীমঙ্গল অথবা মৌলভীবাজারে যেতে হবে। বাস ও ট্রেনে ঢাকা কিংবা দেশের যে কোনো
জায়গা থেকেই শ্রীমঙ্গলে আসা যায়। সেখান থেকে সিএনজি, চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে বাইক্কা
বিলে যেতে হবে। শ্রীমঙ্গল থেকে এই বিলের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার ও মৌলভীবাজার শহর থেকে
২০ কিলোমিটার। রাস্তা মসৃণ হওয়ায় বেশি সময় লাগে না।
যেখানে থাকবেনঃ বাইক্কা বিলের
আশপাশে থাকার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। শ্রীমঙ্গল অথবা মৌলভীবাজারে এসে থাকাটাই ভালো।
বাজেট অনুযায়ী অনেক হোটেল, রিসোর্ট ও পাঁচ তারকামানের হোটেলও আছে।
যেখানে খাবেনঃ খাওয়ার জন্য
স্থানীয় হোটেলের ওপর ভরসা না করাই ভালো। মৌলভীবাজারে পানসী, কলাপাতা, মামার বাড়িসহ
অনেক ভালোমানের রেস্টুরেন্ট আছে। শ্রীমঙ্গলে আছে পানসী, কুটুমবাড়ি, সাতকড়াসহ
অনেক রেস্টুরেন্ট। এছাড়াও কাচ্চিঘর, কাচ্চি কিংসহ অনেক কাবাব রেস্টুরেন্টও আছে। চাহিদা
অনুযায়ী খেয়ে নেয়া যাবে।
0 মন্তব্যসমূহ