সুড়ঙ্গঃ আফরান নিশো এলেন দেখলেন জয় করলেন

 


‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ প্রবাদটা পড়েননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই প্রবাদকে উপজীব্য করে বাংলা ভাষায় কবিতা, গল্প, গান, সিনেমা হয়েছে ভুড়ি ভুড়ি। কিন্তু সার্থক শিল্প হয়েছে কয়টা? সংখ্যাটা খুবই কম হবে। আজকে যে সিনেমাটি নিয়ে আমরা আলোচনা করবো সেটি একটি সার্থক সিনেমা কী না তা দর্শক ও বোদ্ধারা বিবেচনা করবেন। আমি শুধু ব্যক্তিগত মতামত দেব।

এবার ইদে পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। তারমধ্যে আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে শুরু থেকেই ছিল সুড়ঙ্গ। কারণ ছিল দুটো। ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা আফরান নিশোর সিনেমায় অভিষেক আর সময়ের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল পরিচালক রায়হান রাফির পরিচালনা। রাফির একাধিক সিনেমা দেখেছি আগেও। তার ওপর একটা আস্থা ছিল। তারচেয়ে বেশি আস্থা ছিল নিশোর প্রতি। কারণ তিনি অতীতে অনেক সিনেমার অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন তৈরি হয়েই বড়পর্দায় নামতে। নাটক ও ওয়েব সিরিজে অনেক দুর্দান্ত সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সেজন্য তার প্রথম কাজটা কেমন হয় সেটা জানার আগ্রহ ছিল প্রবল।

ইদের দিন থেকেই সারাদেশে বৃষ্টি। সিলেটে তো বৃষ্টি আরও আগে থেকেই। ইদের প্রথম দু’দিন ব্যস্ততায় গেলেও তৃতীয় দিন বৃষ্টিভেজা বিকেলে সিলেটের প্রথম ও একমাত্র সিনেপ্লেক্স গ্র্যান্ড সিলেট মুভ্যি থিয়েটারে উপস্থিত হলাম। বিকেল ৫.৩০-এর শো ছিল। আগেই বুকিং দেয়া থাকায় কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করে চলে গেলাম থিয়েটারের ভেতরে। ঢুকেই দেখি পুরো হলভর্তি লোক। হাউজফুল শো। তাই শুরুতেই ভালোলাগা কাজ করছিল। হাউজফুল না হলে সিনেমা দেখে কেমন যেন পানসে লাগে!

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শহিদ সিরাজ লেকের পাড়ে মেঘালয় পাহাড়ের কোলে দৃষ্টিনন্দন লোকেশনে সিনেমার শুরু। ইলেকট্রিশিয়ান মাসুদ, ময়না ও মাসুদের বন্ধু জহিরের গল্প। খুবই সাদামাটাভাবে গল্পটির সূচনা হয়। শুরুতে প্রেম, রোমান্স, বিয়ে। এরপর যত সময় যায় কাহিনি গড়ে উঠতে থাকে, এস্টাবলিশ হয়। একসময় পরকীয়া, লোভ থেকে গল্প গড়ায় থ্রিলারের দিকে। সিনেমা মুভ করে চট্টগ্রামে।

একটি সুড়ঙ্গকে কেন্দ্র করে মাসুদ, ময়না আর জহির জড়িয়ে পরে নানামুখী অপরাধে। লোভের ফাঁদে পা দিয়ে তিনজনই ভুল করতে থাকে আর কাহিনি জমে উঠে সিনেমার। থ্রিল, টানটান উত্তেজনার পর একটা দুর্দান্ত ফিনিশিং দেখে আমরা বের হই হল থেকে। দর্শকের চোখেমুখে তৃপ্তির রেশ দেখে বেশ ভালো লাগে। বাংলা সিনেমা দেখে অনেকদিন পর এই উচ্ছ্বাস আশা জাগায় যে সিনেমার সুদিন হয়তো ফিরছে। আর সিনেমার গল্প এরচেয়ে বেশি জানতে হলে অবশ্যই হলে যেতে হবে।

সুড়ঙ্গ সিনেমার অনেকগুলো ভালো দিক ও অল্পস্বল্প নেগেটিভ দিকও আছে। প্রথমত ভালো দিক হলো এর গল্প। রায়হান রাফি সবসময় চেনাজানা জগত থেকে গল্প বেছে নেন, কখনো সত্য ঘটনা অবলম্বনেও নির্মাণ করেন। সুড়ঙ্গও সম্ভবত সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। তবে ঘটনাটা সম্পর্কে নিশ্চিত না থাকায় এ বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। গল্পটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বেশ ইউনিক ছিল। সংলাপগুলো আহামরি না হলেও বেশ পরিমিতবোধ ছিল এবং বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়নি। গতানুগতিক বাণিজ্যিক সিনেমার সাথে সংলাপের মিল খুঁজে পাবে না দর্শক এটা নিশ্চিত। আর চট্টগ্রামের ভাষায় সংলাপগুলো বেশ মজার ছিল, দর্শক ব্যাপক আনন্দ পেয়েছে। সুনামগঞ্জ তথা সিলেটের ভাষায় কিছু সংলাপ থাকলে আরও বাস্তবসম্মত লাগত।

অভিনয় হলো সিনেমার প্রাণ। এই সিনেমায় সে প্রাণের সন্ধান পেয়েছি বেশ ভালোভাবেই। আফরান নিশো প্রথম সিনেমাতেই দুর্দান্ত কারিশমা দেখিয়েছেন অভিনয়ে। কখনো ইলেকট্রিশিয়ান, কখনো প্রবাসী শ্রমিক, কখনো বরফকলের দিনকামলা, কখনো ব্যাংক ডাকাত। প্রতিটি ট্রান্সফরমেশনই ছিল দুর্দান্ত। পুরো সিনেমা টেনে নিয়ে গেছেন, দর্শকদের পর্দা থেকে চোখ সরানোর সুযোগ দেননি। পুরো সিনেমায় নিশো ছিলেন এক অনবদ্য প্যাকেজ। মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, নিজের জাত চিনিয়েছেন। নাটকের লোকেরা সিনেমায় ভালো করতে পারে না, এই অপবাদ আগেই ঘুচিয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী। এবার আফরান নিশো প্রমাণ করেছেন অভিনয় জানলে মাধ্যম কোনো ব্যাপার না। তার এক্সপ্রেশনগুলো ছিল দেখার মতো।

তমা মির্জাকে প্রথম দেখি টেলিভিশনের একটা নাচের অনুষ্ঠানে। সেখান থেকে তিনি বাণিজ্যিকধারার সিনেমায় অভিনয় করতেন। কিন্তু তার সিনেমা দেখা হয়নি আগে। প্রথম তার অভিনয় দেখি রায়হান রাফিরই ওয়েব সিরিজ ‘দ্য ডার্ক সাইড অফ ঢাকা’তে। সেখানে দূরন্ত অভিনয়ে নজর কেড়েছিলেন। এরপর সুড়ঙ্গতে তার অভিনয় দেখলাম। ময়না চরিত্রটার জন্য তিনি একদম যথার্থ ছিলেন। একজন লোভী নারীর চরিত্রে নিজেকে এত ভালোভাবে মেলে ধরেছেন যে, দর্শক রীতিমতো ঘৃণা উগড়ে দিচ্ছিল তাকে। অভিনেতা হিসেবে এটাই সার্থকতা।

মাসুদের (নিশো) বন্ধু জহির চরিত্রে মুস্তফা মনোয়ার ভালো অভিনয় করেছেন। তবে তিনি চরিত্রটার জন্য সঠিক পছন্দ ছিলেন না। কারণ মাসুদের বয়সের চেয়ে জহিরকে বেশ বয়স্ক লেগেছে। হয় আরও ইয়াং কাউকে নেয়া উচিত ছিল, নয়তো জহিরকে সেভাবেই প্রস্তুত করা দরকার ছিল। তবে এই সিনেমায় শহিদুজ্জামান সেলিমের অভিনয় ছিল নজরকাড়া, অসাধারণ। চাটগাঁর ভাষায় দুর্দান্ত ডায়লগ ডেলিভারির সাথে তার অভিনয়ের লেভেল, জাস্ট মুগ্ধ করার মতো। তিনি পর্দায় সময় পেয়েছেন কম। কিন্তু তার এন্ট্রির সাথে সাথেই সিনেমাটা বেশ ভালোভাবে জমে যায়। অজ্ঞাতনামা, চোরাবালির পর অভিনেতা হিসেবে নিজের জাত চেনালেন এখানেও। তাকে আরও বেশি স্ক্রিন ও স্পেস দেয়া উচিত ছিল। প্রয়োজনে গল্পটা সেভাবেই সাজানো যেত।

সিনেমার চরিত্রগুলোর কস্টিউম, মেকাপ-গেটআপ যথেষ্ট সুন্দর ছিল। কালার গ্রেডিং, এডিটিং যথেষ্ট যত্নের সাথে করা হয়েছে। ক্যামেরার কাজ ছিল দারুণ। শটগুলো সিনেম্যাটিক ছিল। নীলাদ্রী লেকের দৃশ্যায়ন সুন্দর ছিল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলি সেতুকে (সম্ভবত) দারুণভাবে দৃশ্যায়ন করা হয়েছে। নীলাদ্রী লেকের পাড়ে একটি আস্ত বাড়ি, আস্ত বাজার তৈরি করে গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। তবে সবেচেয়ে অবাক লেগেছে সুড়ঙ্গটা দেখে। একটা এতবড় সুড়ঙ্গ বাস্তবিকভাবে তৈরি করা আর সেখানে শুট করা দেখে বোঝা যায় কতটা পরিশ্রম করেছে সুড়ঙ্গ টিম। সুড়ঙ্গের ভেতরের শটগুলোও একদম বাস্তবিক লেগেছে। আমাদের সিনেমায় এরকম কষ্ট করে বাস্তব লোকেশন শুট করা যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এফডিসিতে সেট বানিয়ে তাই অনেকে কাজ সারেন, অনেকে ভিএফএক্সের ব্যবহার করেন। সুড়ঙ্গ সেটা করেনি দেখে ভালো লাগছে।

সুড়ঙ্গ হতাশ করেছে গানে। আইটেম গান সিনেমায় রাখা হয় নানা কারণে। তবে সেটা কাহিনির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া চাই। আইটেম গানটা না হলেও এই সিনেমার সামান্যতম ক্ষতি হতো না। গানটার উদ্ভট লিরিক, সুর, গায়কী বিরক্তি উৎপাদন করেছে শুধু। আর অন্যান্য গানও মনে দাগ কাটেনি। ‘গা ছুঁয়ে বলো’ গানটার সুর ভালো লাগলেও, অবন্তির গায়কী মিষ্টি লাগলেও লিরিক যাচ্ছেতাই ছিল। গানে আরও নজর দেয়া উচিত রায়হান রাফির। দেশে অনেক ভালো গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী আছেন। আমাদের গানের ভাণ্ডার কম সমৃদ্ধ নয়। শ্রুতিমধুর গান তৈরিতে একটু ভালো বাজেট রাখলে আখেরে সিনেমারই লাভ হয়।

অনেক নারীবাদী সুড়ঙ্গকে নারীবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু সিনেমাটিতে সমাজে ঘটে যাওয়া বাস্তবতাই তুলে ধরা হয়েছে, নারীদের অপমান করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না এখানে। আবার অনেকে অশ্লীল বলছেন। সিনেমার কোন দৃশ্যটা অশ্লীল মনে হলো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। আর সিনেমা বিনোদনের মাধ্যম। এখানে প্রেম, রোমকান্টিকতা থাকবে। এসব জেনেই পরিবার কিংবা বাচ্চা নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া উচিত। সুড়ঙ্গে যা দেখানো হয়েছে এরচেয়ে অনেক বেশি রোমান্টিক, ইন্টিমেট দৃশ্য অহরহ দেখি সিনেমায়, এমনকি নাটকেও। উদ্দেশ্যমূলকভাবে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে একটা ভালো সিনেমাকে দমানো যায় না।

সুড়ঙ্গ নিশোর সিনেমা, রাফিরও। নিশোর প্রথম কাজ হলেও রাফি এই কাজে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। এই ছাড়িয়ে যাওয়াটা তাকে অব্যাহত রাখতে হবে। আর আফরান নিশো প্রত্যাশাটা বাড়িয়ে দিলেন বহুগুণ। সামনের দিনগুলোতে আরও দারুণ সব সিনেমা করবেন এবং সংখ্যায় নয়, মানে নিজেকে ধরে রাখবেন এটাই এখন আশা।

সিনেমাঃ সুড়ঙ্গ

পরিচালকঃ রায়হান রাফি

ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৮/১০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ