শ্রীপুরের শ্রী রাংপানি


সিলেটের মেঘালয়ঘেঁষা পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরের নাম সবাই জানেন। প্রতিদিন হাজারও পর্যটক ছুটে যান সেখানে। সেই মেঘালয়েরই একদম কোলঘেঁষে একটা পাথর কোয়ারি আছে, যেখানে পর্যটনের দারুণ একটি দ্বার খুলে গেছে ইতোমধ্যেই। সম্প্রতি ভ্রমণ করে এলাম সেখান থেকেই। সেই গল্প বলছি আজ।

এবার ইদের পর কোথাও ঘুরতে যাইনি। রমজানের আগে সেই যে ভারতের ত্রিপুরা থেকে ঘুরে এসেছিলাম, এরপর আর কোথাও যাওয়ার ফুরসৎ পাইনি। তাই কাছাকাছি কোথায় যাওয়া যায় ভাবছিলাম। এরমধ্যেই বিভিন্ন মিডিয়া ও কিছু ইউটিউব চ্যানেলে রাংপানি নামের একটি পর্যটনকেন্দ্রকে নিয়ে বিভিন্ন লেখা, ছবি ও ভিডিও দেখে ফেললাম। আমরাও আগ্রহ জাগল। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম যে নতুন আকর্ষণ হিসেবে রাংপানি দেখতে যাওয়াই যায়।

কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। কাল রাতেও অনেক ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সকালে উঠেও আকাশ মেঘলা দেখলাম। আবহাওয়া বিভাগ বলছে আগামী সাতদিন নিয়মিত বৃষ্টিপাত হবে। তবু বাসা থেকে বের হলাম সকাল দশটায়। আমরা পাঁচজন ভ্রমণপ্রেমীর আজকের গন্তব্য সিলেটের নতুন পর্যটন স্পট রাংপানি।

প্রাইভেটকারে রওনা দিলাম সিলেটের উদ্দেশে। আমাদের এলাকা সিলেট বিভাগের তিন জেলার মিলনস্থল শেরপুর থেকে সিলেট শহরের দূরত্ব পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। আমরা কেউই সকালে নাশতা করিনি। সিলেট শহরে প্রবেশের পাঁচ কিলোমিটার আগে লালাবাজার নামক জায়গায় পাঁপড়ি রেস্টুরেন্টে নেমে নাশতা সেরে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যার যার চাহিদামতো চিকেন ও বিফ ভুনা খিচুড়ি দিয়ে ভরপেট খেয়ে নিলাম। এরপর চায়ের স্বাদ মুখে নিয়ে বের হলাম। পথিমধ্যে চণ্ডিপুলে সিএনজি নেয়ার জন্য গাড়ি থামালাম আবারও। সিএনজি নেয়া শেষ করে আবারও রওনা দিলাম।

মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে রাংপানির অবস্থান, যা সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুরে পড়েছে; ছবিঃ লেখক



সিলেট থেকে জাফলং যাওয়ার ২/৩টি রাস্তা আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে সহজ হলো শিবগঞ্জ-টিলাগড় হয়ে এমসি কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার রাস্তাটি। অন্যান্য রাস্তা হলো ভোলাগঞ্জ সড়ক ধরে গোয়াইনঘাট হয়ে অথবা হরিপুর হয়ে জাফলং ও শ্রীপুর যাওয়া যায়। আমরা কেন জানি সহজ রাস্তা রেখে সেদিন গোয়াইনঘাটের রাস্তাটিই ধরলাম। অবশ্য তাতে সময় বেশি লাগলেও একটা লাভ হলো। গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশেষ করে তেপান্তরের মাঠ, নদী, হাওর আর সবুজাভ পরিবেশ দেখতে দেখতে যাওয়ার আনন্দই আলাদা।

ভরদুপুরে গিয়ে পৌঁছুলাম শ্রীপুর বাজারে। যেহেতু আগে যাইনি তাই বাজারে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম রাংপানির অবস্থান। বাজারের কাছেই মোকামপুঞ্জি এলাকা। সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মোকামপুঞ্জি চা বাগান পাশাপাশি। বিদ্যালয়ের মাঠে গাড়ি রাখলাম। দেখলাম আরও অনেকেই গাড়ি, বাইক নিয়ে এসেছেন এখানে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা খাসিয়াদের আবাসিক এলাকার গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। খাসিয়াপুঞ্জির ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর দারুণ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন তাদের। আর চারদিকে ঘন গাছপালা, সবুজায়ন। মনে হলো প্রকৃতি ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে দারুণ সচেতন তারা। আমাদের মতো নোংরা, ময়লা, আবর্জন কোথাও নেই। যাই হোক, মাত্র ১০/১২ মিনিটেই আমরা পৌঁছে গেলাম রাংপানিতে।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা পর্যটনসমৃদ্ধ। ডিবির হাওর, লালাখাল, শ্রীপুর পিকনিক সেন্টার পড়েছে এই জৈন্তাপুরে। জাফলং গোয়াইনঘাটে পড়লেও জৈন্তাপুর হয়েই যেতে হয়। জাফলং ও শ্রীপুর পিকনিক সেন্টারে যায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই দুটো বিখ্যাত ভ্রমণ গন্তব্যের পাশে শ্রীপুরের মোকামপুঞ্জিতে অবস্থিত রাংপানি যেন প্রকৃতির আরেকটি সৌন্দর্যের ঠিকানা।

সবুজের বুকে সুউচ্চ পাহাড়, রাংপানিকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা; ছবিঃ লেখক



রাংপানি শ্রীপুরের সীমান্তবর্তী একটি নদী। এই নদীর স্বচ্ছ জলের উৎপত্তি মেঘালয়ের রংহকং জলপ্রপাত থেকে। এটি একটি পাথর কোয়ারি ছিল। যার নাম ছিল শ্রীপুর পাথর কোয়ারি। সরকারিভাবেই পাথর উত্তোলন করা হতো চার বছর আগেও। জানা যায়, এখানে একসময় সিনেমার গানের শুটিং হয়েছিল। শাবনাজ-নাঈম জুটির ‘চাঁদনী’ সিনেমার একটি গানের দৃশ্যধারণ করা হয় রাংপানিতে। তখনও জায়গাটা অনেক সুন্দর ছিল। কিন্তু পাথর উত্তোলনের ফলে রং হারায় রাংপানি। ফলে আড়ালে থেকে যায় এর সৌন্দর্য। সরকারি নির্দেশে গেলো কয়েক বছর পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় আবার তার পুরোনো রূপ ফিরে পেয়েছে রাংপানি।

সশ্যাল মিডিয়ার অবাধ তথ্যপ্রবাহের ফলে একটা তথ্য বা জায়গার কথা দ্রুত ছড়িয়ে যায়। গত কয়েকদিন রাংপানির কথাও ছড়িয়েছে বেশ। তার প্রমাণ পেলাম সেখানে গিয়ে। দেখলাম দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেক পর্যটক ছুটে আসছেন জায়গাটি দেখতে। অনেকে স্বচ্ছ জলধারায় শরীরটাকে ভেজাতেও এসেছেন এখানে।

আমরা পৌঁছে পুরো জায়গাটা দেখে নিলাম। নদীতে পানি কম। তবে ভারতের ঝর্না থেকে স্রোত আসছে বেশ ভালো বেগেই। ছবি ও ভিডিওগ্রাফির শেষে আমাদের তর সইছিল না পানিতে নামার জন্য। পোশাক পালটিয়ে নেমে পড়ি পাঁচজনই। প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত দেহটা ভিজিয়ে দিই ঝর্নার বুক চিরে পাথর ছুঁয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ জলের ওপর। উল্লাস, আনন্দ, গানে মেতে উঠি। সেইসাথে চলতে থাকে গোসলও। সেগুলোর দৃশ্যধারণ চলছিল মোবাইল ফোনে।

রাংপানি এক পাথুরে নদীর নাম; ছবিঃ লেখক



বিকাল চারটার দিকে আমরা পানি থেকে উঠে ভেজা জামা পাল্টাচ্ছিলাম। হঠাৎ একজন বিজিবি জওয়ান এসে সবাইকে সীমান্ত এলাকা থেকে চলে আসার তাগিদ দেন। চারটার পর নাকি বিএসএফ টহল দেয়। তাই এখানে থাকা বিপজ্জনক। সকল পর্যটকের মতো আমরাও ফিরে আসি। জামা পাল্টে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তখনও নতুন পর্যটক আসছিলেন। কিন্তু তাদেরও হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।

রাংপানির পাশেই মোকামপুঞ্জি। যেখানে খাসিয়া আদিবাসীদের বাস। খাসিয়ারা তাদের গ্রাম বা পাড়াকে পুঞ্জি বলে। রাংপানিতে তাদের পাড়ার ভেতর দিয়ে, এদকম তাদের আঙিনা হয়েই যেতে হয়। খাসিয়াদের প্রধান পেশা হলো পান ও সুপারি চাষ। পুরো মোকামপুঞ্জিতেই পানের বাগান আছে। আছে পানের বরজও। খাসিয়া পানের জন্য বিখ্যাত এই মোকামপুঞ্জি। তাছাড়া এখানে একটা চা বাগানও আছে। যা মুগ্ধ করবে যে কোনো পর্যটককে।

রাংপানি থেকে উঠে কিছুটা পথ আসার পর মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এলো। উপায়ন্তর না দেখে আমরা ১০জনের মতো ট্যুরিস্ট একটা খাসিয়া বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিলাম। পাক্কা আধঘন্টা অঝোরে বৃষ্টি ও সাথে বরফের মতো শিলাপাত হয়ে অবশেষে থামল বৃষ্টি। আমরাও চলে এলাম গাড়ির কাছে।

দুপুরে খাইনি এখনো। খিদে চাগিয়ে উঠেছে সবারই। মোকামপুঞ্জি থেকে বেরিয়ে আর কোথাও না গিয়ে সোজা সিলেটের পথ ধরলাম। পথে হরিপুরে দেখলাম বেশকিছু রেস্টুরেন্ট। থেমে গেলাম খাওয়ার জন্য। হাঁসের মাংস দিয়ে পেটপুরে ভাত খেলাম। এখানে মাংসের সাথে ডাল আর ভাত ফ্রি। একদম উদরপূর্তি করে খাওয়াটা সমাপ্ত হলো আমাদের। খাওয়ার পর চা পানও করলাম। শরীর ও মন অনেক চাঙা হয়ে গেলো সবারই।

অকৃত্রিম সৌন্দর্যের রাংপানি মুগ্ধ করবে সবাইকে; ছবিঃ লেখক


যেভাবে যাবেন

রাংপানি যেতে হলে প্রথমেই যেতে হবে জাফলংয়ের শ্রীপুর এলাকায়। শ্রীপুর পর্যটনকেন্দ্র পার হলেই মোকামপুঞ্জি। সেখান থেকে গাড়ি রেখে মাত্র ১০/১২মিনিটেই হেঁটে চলে যাওয়া যায় রাংপানি। প্রাইভেটকার, সিএনজি, লেগুনাতে করে সিলেট শহর থেকে আসা যায়। আবার জাফলংগামী কোনো বাসে উঠলেও শ্রীপুর নেমে চলে যাওয়া যায় খুব সহজেই।

থাকা ও খাওয়া

থাকার জন্য সিলেটে শহরই সবেচেয়ে ভালো হবে। তাছাড়া জাফলংয়েও কিছু হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট আছে। জৈন্তায় আছে ‘জৈন্তা হিল রিসোর্ট’। আপনার চাহিদা অনুযায়ী থাকতে পারবেন। আর খাওয়ার জন্য জাফলং, জৈন্তাপুর বাজার ও হরিপুর বেস্ট। তবে কেউ চাইলে সিলেট শহরে এসেও খেতে পারবেন। পানসী-পাঁচ ভাইয়ের মতো রেস্টুরেন্টে ভর্তার দারুণ স্বাদ নেয়াও যায়।

কিছু সতর্কতা

*খাসিয়াদের পাড়া হয়ে রাংপানি যেতে হয়। তাদের সাথে কখনো বাজে আচরণ করবেন না। তাদের বাগান থেকে পান অথবা ফলমূল ছেঁড়া যাবে না।

*রাংপানিতে প্রচণ্ড স্রোত। তাই নামার সময় খেয়াল রাখতে হবে স্রোতের ব্যাপারে। কারণ যে পরিমাণ পাথর আছে, একবার স্রোতে নিয়ে গেলে পাথরের সাথে বড়সড় ধাক্কা নিশ্চিত!

*মেঘালয়ের কোলঘেঁষে রাংপানি। যখন-তখন বৃষ্টি আসতে পারে। সিলেটের বৃষ্টির ভরসা নেই। তাই ছাতা নিয়ে যেতে পারেন। আর পানিতে নামার জন্য জামা, গামছা ও ভেজা জামা নিয়ে আসার জন্য পলিথিন নিতে ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ