আগরতলা ভ্রমণ ২য় পর্ব
ঘুম ভাঙল সকাল আটটায়। আগেরদিনের ক্লান্তি আর আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে
রাতে বাজি ফোটানোর শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছিলাম কখন বলতে পারবো না। সকালে
ওঠে একদম সতেজ মনে ঝটপট নাশতা সেরে নিলাম। কাল রাতেই হোটেলের কিচেনে নাশতা অর্ডার করে
দিয়েছিলাম। চারটা করে লুচি, সবজি, সেদ্ধ ডিম আর চা দিয়ে একদম ভরপেট নাশতা খেলাম। সকালে
রেস্টুরেন্ট খোলা পাব কী না নিশ্চিত না থাকায় রুমেই নাশতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
হোটেলের খাবারের দাম অনেক বেশি। তবু উপায় না থাকায় সেটাই খেলাম।
সকাল ৯টায় বের হলাম হোটেল থেকে। আজকে আমাদের পরিকল্পনা হলো শুরুতেই
নীরমহল যাওয়া। এরপর সময় থাকলে ত্রিপুরা ও আগরতলার আরও কিছু ট্যুরিস্ট স্পট এক্সপ্লোর
করা। হোটেল থেকে বেরিয়ে তাই অটোতে করে সোজা চলে গেলাম শহরের বটতলায়। শুরুতেই মানি এক্সচেঞ্জ
থেকে বেশকিছু রুপি নিয়ে নিলাম। আমাদের কাছে টুকটাক যা ছিল তা খরচ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।
আজ এক্সচেঞ্জ না করলেই হতো না। প্রতি ১০০টাকায় ৭২.৫০রুপি করে পেলাম। ডলারের দাম বেড়ে
যাওয়ায় টাকার রেটও এখন কম। এরপর গেলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। বটতলায় ফ্লাইওভারের নিচেই
পড়েছে স্ট্যান্ডটা। কয়েকজন ট্যাক্সিচালক এসে কথা বলছিল। নীরমহলসহ আরও দুটো স্পট দেখাবে,
এজন্য সবাই মোটামুটি ১৫০০রুপি চাচ্ছিল। পরে কথাবার্তা বলে ১৪০০রুপিতে একটা ট্যাক্সি
নিলাম। এসিসহ ট্যাক্সিটি সারাদিনের জন্য আমাদের সাথে থাকবে। ৫৩কিলোমিটার দূরের নীরমহলসহ
একাধিক স্পট দেখে সারাদিনের জন্য ট্যাক্সিভাড়া যৌক্তিক মনে হলো, অন্তত আমাদের দেশের
তুলনায়।
আজকে প্রচণ্ড রোদ, গরম প্রচুর। গতকালের আতঙ্কের পর আগরতলা আজ সকালে জাগতে শুরু করেছে। ট্যাক্সিতে বসে শহর দেখতে দেখতে সায়েন্স সিটি, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম চমৎকার একটি রাস্তায়। চা বাগানের মাঝখানে দিয়ে চলছিলাম। হঠাৎ আমাদের চালক বললেন আপনারা এই চা বাগানে নেমে ছবি তুলতে পারেন। চালকের নাম মুহাম্মদ ফোটন মিয়া, চমৎকার মানুষ। আমরাও নেমে গেলাম। বাগানটির নাম জানি না, কিন্তু ভালো লাগছিল। আমরা চায়ের দেশের মানুষ, সিলেটের সর্বত্রই চা বাগান। তাই ওখানে বেশিক্ষণ না কাটিয়ে আবার রওয়ানা দিলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা একটা বনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জে আমাদের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যেভাবে রাস্তা গেছে ঠিক সেভাবেই সিপাহিজলা বনের ভেতর দিয়ে এই রাস্তাটা গেছে। লাউয়াছড়ার ফিল পেতে পেতে হঠাৎ থেমে গেলো গাড়ি। ড্রাইভার বললেন সিপাহিজলা বন্যপ্রাণি অভয়াশ্রমে চলে এসেছি, আপনারা ঘুরে আসুন।
সিপাইজলা বন্যপ্রাণি অভয়াশ্রমের প্রবেশপথ। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন হওয়ায় আমরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি! |
সিপাহিজলা বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য
গাড়ি থেকে নেমে হতাশ হলাম। কারণ আজকে শুক্রবার, অভয়ারণ্য দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ। প্রতি শুক্রবারে এটা বন্ধ থাকে। অগত্যা বাইরে থেকে কিছু ছবি আর ভিডিও ফুটেজ নিলাম। আপনারা যারা যেতে চান তাদের জন্য এই অভয়ারণ্য সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখলাম।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ২৪ কিলোমিটার
দূরে সিপাহিজলা বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্যের অবস্থান। সিপাহিজলা ত্রিপুরার একটি জেলার
নাম। সম্ভবত এই বনের নামেই জেলার নামকরণ করা হয়েছে। এই অভয়ারণ্যটি অনেকটাই আমাদের
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মতো। ১৮ দশমিক ৫৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা
নিয়ে এ বন্যপ্রাণি অভয়াশ্রম। ১৯৭২ সাল থেকে বায়োডাইভার্সিটির নানা বিষয় নিয়ে সিপাহিজলা
বায়ো কমপ্লেক্স কাজ করে যাচ্ছে। এখানে বোটানিক্যাল গার্ডেন, হরিণ পার্ক ও চিড়িয়াখানাও
রয়েছে।
১৯৮৭ সালে এটিকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। এখানে প্রায় ৪৫৬ ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে,
আছে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ ও অনেক ভেষজ গাছও। কমপক্ষে সাড়ে ৪হাজার কিউবিক মিটার বাগান
খুঁজে পাওয় যাবে অভয়ারণ্যের পার্কে। যেখানে রয়েছে রেসাস, গিটেইন ম্যাককিউ, ক্যাপড ল্যাগার,
স্পেকট্যাপল মাংকি ও নানান জীব-জন্তু। এর সঙ্গে রয়েছে বাঘ, কিভেট, হরিণ, বন্য শূকর
ও হাতিও। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে এখানে আছে কফি ও রাবার বাগান, বোটে চড়ার ব্যবস্থা ও টয়
ট্রেন। অনেক ট্যুরিস্ট কটেজও আছে, যা ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করে। বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরাজি,
লেইক ও নানা জাতের বন্যপ্রাণি - সব মিলিয়ে গা ছমছম করা এ অভয়ারণ্যটি মুগ্ধ করবে প্রকৃতিপ্রেমী
যে কোনো পর্যটককে। বলা যায় ইকো পর্যটনের আদর্শ এক জায়গা ত্রিপুরার সিপাহিজলা অভয়ারণ্য।
দারুণ এক জলাভূমি রুদ্রসাগর। এই হ্রদের মাঝখানেই তৈরি করা হয়েছে ত্রিপুরার আভিজাত্যের প্রতীক নীরমহল। ছবিঃ লেখক |
নীরমহল
সিপাহিজলা জেলার ছোট্ট একটা শহর মেলাঘর। এই মেলাঘর নিয়ে ঐতিহাসিক কারণে আমাদের অনেক আবেগ আছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনেক গেরিলা যোদ্ধাই সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরা-আগরতলায় ট্রেনিংয়ে আসতেন। তাদের বড় একটা অংশই মেলাঘরে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। পপসম্রাট বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খান, ক্র্যাকপ্লাটুনের বীর শহিদ শাফি ইমাম রুমি থেকে শুরু করে অনেকেই মেলাঘরে ট্রেনিং নিতেন। কিন্তু মেলাঘরে প্রবেশ করে বিভিন্নজনকে জিজ্ঞেস করেও এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পেলাম না। ড্রাইভার বললেন উনিও কিছু জানেন না। ত্রিপুরা সরকার এসব ট্রেনিং গ্রাউন্ড সংরক্ষিত করেছে কী না সে তথ্যও জানা যায় না। অগত্যা নীরমহলের দিকে চলে গেলাম। নীরমহল মেলাঘরেই পড়েছে।
নীরমহলে যাওয়ার ঘাটে যেতেই একটা বড় গেট, যেখানে নীরমহলে স্বাগত জানানো হয়েছে পর্যটকদের। আমরা ৩০রুপি দিয়ে পার্কিং টিকেট নিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। টিকেট কাউন্টারে গিয়ে জানলাম নীরমহলে যাওয়ার জন্য দুই ধরনের নৌকা বা বোট আছে। ইঞ্জিনচালিত বড় বোট ন্যূনতম ২৫জন যাত্রী হলে শেয়ারে যায়, ভাড়া জনপ্রতি ৫০টাকা। আর মাঝিচালিত ছোট বোটে ৭জন পর্যন্ত যাওয়া যায়, রিজার্ভ ৩৫০টাকায়। বড় বোটের যাত্রী না থাকায় ছোট বোট রিজার্ভ নিলাম আমরা তিনজন। বোটে ওঠে বসলাম। মাঝি রুদ্রসাগরে ভাসিয়ে দিলেন তার তরি।
রুদ্রসাগর নামের জলমহালের ওপর দূর থেকে ভাসতে দেখলাম ত্রিপুরার শৌর্য-বীর্য আর আভিজাত্যের প্রতীক নীরমহলকে। রুদ্রসাগর হ্রদ, যা টুইজিলিকমা নামেও পরিচিত, ত্রিপুরার মেলাঘরে অবস্থিত একটি হ্রদ। ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় রুদ্রসাগরকে এর জীব-বৈচিত্র্য এবং আর্থ-সামাজিক গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহারের জন্য জাতীয় গুরুত্বের অন্যতম জলাভূমি হিসাবে চিহ্নিত করেছে। রামসার কনভেনশনের মহাসচিব রুদ্রসাগর হ্রদকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বের জলাভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই প্রশংসাপত্রটি ২৯শে ফেব্রুয়ারি ২০০৭-এ ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় দ্বারা প্রদান করা হয়েছে। রুদ্রসাগর হ্রদটি সিপাহিজলা জেলার সোনামুড়া মহকুমার মেলাঘর ব্লকে অবস্থিত। হ্রদটি ৫.৩ বর্গকিলোমিটার ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে গঠিত।
বাগানে বাগানে সজ্জিত পুরো নীরমহল। প্রতিটি কক্ষের সামনেই এমন বৃক্ষ আর বাগান শোভা পাচ্ছে। ছবিঃ লেখক |
রুদ্রসাগর ধরে আমাদের নৌকা ছুটছিল। দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছিল পর্যটক কিংবা মাঝির গাওয়া গান। আমরাও গলা মেলাচ্ছিলাম তার সাথে। চারদিকে নানা প্রজাতির পাখি। এত পাখি আমাদের দেশের হ্রদ কিংবা হাওরে এখন দেখা যায় না। এরকম পাখি থাকলে আমরা কবেই সেগুলো শিকার করে খেয়ে ফেলতাম! যা হোক, মাত্র বিশ মিনিটের নৌকাভ্রমণ শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম নীরমহলে। নৌকা থেকে নামার সময় মাঝি আমাদেরকে ঘোরাঘুরির সময় বেঁধে দিলেন। ৪০মিনিটের মধ্যেই আমাদের ফিরে আসতে হবে। দেরি করলে প্রতিঘন্টা প্রতিজনের জন্য আলাদা করে ১৫০রুপি দিতে হবে। সবার জন্য এটাই নিয়ম। টিকেটের পেছনেও সেটা লেখা আছে।
নীরমহল (Neermahal) ভারতের ত্রিপুরার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। নীর অর্থাৎ জলের মাঝে মহলটি স্থাপিত বলে এর নামকরণ করা হয় নীরমহল। ত্রিপুরার শেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের আমলে নীরমহল তৈরি করা হয়। ইংল্যান্ডের মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানি ১৯৩০ সালে এর কাজ শুরু করে এবং ১৯৩৮ সালের ১২ই মে ভবনটির উদ্বোধন করা হয়। উল্লেখ্য, ভারতেরই আরেক প্রদেশ রাজস্থানের উদয়পুরে ঠিক এরকম একটি প্রাসাদ রয়েছে, যার নাম জলমহল।
রুদ্রসাগরের ঠিক মাঝখানে ত্রিপুরার রাজার গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এই মহলটি নির্মাণ করা হয়। ভবনটি একাধারে যেমন রাজার আভিজাত্যের প্রমাণ দেয়, তেমনি হিন্দু ও মোঘল সংস্কৃতি মিশিয়ে তিনি যে একটি দর্শনীয় স্থাপনা করতে চেয়েছিলেন, সেই ধারণারও প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাসাদে মোট দুটি অংশ। মূল অংশ রয়েছে পশ্চিমপাশে এবং পূর্বপাশে রয়েছে নিরাপত্তাবাহিনীর জন্য দুর্গ। মূল অংশকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- বাইরের কক্ষ এবং অন্দরমহল। বাইরের কক্ষগুলোর মধ্যে বিশ্রামঘর, খাজাঞ্চিখানা ও নাচঘর উল্লেখযোগ্য। এ ধরনের পাঁচটি কক্ষ সেখানে রয়েছে। এছাড়া দাবা খেলার জন্যও একটি আলাদা কক্ষ রয়েছে। রানি ও অন্যদের জন্য অন্দরমহলে রয়েছে বিশাল ছয়টি কক্ষ। এছাড়া রান্নাঘর, রাজার সভাঘর, আড্ডাঘর ইত্যাদি তো রয়েছেই। বর্তমানে মহলের ভিতর একটি জাদুঘরও রয়েছে। অন্দরমহলটি এমনভাবে সাজানো ছিল যাতে রাজা-রানি নৌকাভ্রমণ সেরে অন্দরমহলের সিঁড়িতে সরাসরি প্রবেশ করতে পারেন। এছাড়া প্রাসাদের ভেতরের অংশে একটি বিরাট বাগানও রয়েছে। রাজা-রানির ঘুরে বেড়ানোর জন্য ঘাটে সবসময় মোটরচালিত নৌকা থাকত।
রুদ্রসাগর থেকে দেখা নীরমহল। নদীর বুকে ভাসমান এক চমৎকার প্রাসাদ! ছবিঃ লেখক |
তবে মহারাজা অনেক অর্থ খরচ করে এই প্রাসাদ নির্মাণ করলেও খুব বেশিদিন ব্যবহার করতে
পারেননি। মাত্র সাত বছর তিনি এই প্রাসাদ ব্যবহার করেছিলেন। কারণ মাত্র ৩৯ বছর বয়সেই
তিনি অকালপ্রয়াত হন। মহারাজা মারা যাওয়ার পর বহুবছর নীরমহল পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।
এ সময় আস্তে আস্তে এটি ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে মলিন হতে থাকে। ১৯৭৮ সালে ত্রিপুরার তথ্য,
সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এর দায়িত্ব নেয় এবং ভবনটি রক্ষায় সচেষ্ট হয়। ১৯৯৫-৯৬
অর্থবছরে ভবনটিতে বড় ধরনের সংস্কার করা হয়। বর্তমানে এটিকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন
স্পট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতি শীতের সময়ে লাইট অ্যান্ড লেজার শোর মাধ্যমে পর্যটকদের
আকৃষ্ট করার পাশাপাশি এই প্রাসাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। এছাড়া প্রতিবছর
সেপ্টেম্বরে রুদ্রসাগর হ্রদে ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হয়।
ঐতিহাসিক এই প্রাসাদটি
দেখে, এর স্থাপত্যশৈলী আর রুচিশীল বিভিন্ন স্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে কখন যে ৪০মিনিট হয়ে গেলো
বলতে পারবো না। তীব্র গরমে পুরো নীরমহল ঘুরলেও একটুও ক্লান্তি আসেনি। কারণ রুদ্রসাগর
থেকে ভেসে আসা সুশীতল হাওয়ায় মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। মহারাজা কেন এটি নির্মাণ করেছিলেন
অনুভব করতে পারছিলাম। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় জায়গাটা স্বর্গীয় এক প্রাসাদে পরিণত হতো সেটা
যে কেউ বুঝতে পারবেন।
আমরা নিচে এসে একটা ক্যাফে দেখলাম। সেখান থেকে বিভিন্ন টক ও ঝাল উপাদান মেশানো তিন গ্লাস পেপসি নিলাম। প্রতি গ্লাস ৫০রুপি। এরপর এসে নৌকায় উঠলাম। কোমলপানীয়তে চুমুক দিয়ে রুদ্রসাগরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পাড়ে চলে এলাম। পেছনে ফেলে এলাম ত্রিপুরার এক অভিজাত প্রাসাদকে।
আগরতলার নান্দকিন সায়েন্স সিটি। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে তুলে ধরার এই আয়োজন সত্যি মুগ্ধ করার মতো! ছবিঃ লেখক |
সায়েন্স সিটি
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে আসছে। আমরা ত্রিপুরার পাহাড় ও অভয়ারণ্যের মাঝখান দিয়ে পিচঢালা পথ ধরে ফিরছি আগরতলার দিকে। আগরতলার কাছে সায়েন্স সিটির সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে খোঁজ নিয়ে দেখলাম আজকে সায়েন্স সিটি খোলাই আছে। তাই ঝটপট নেমে পড়লাম। ৩০রুপি করে টিকেট কেটে বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর জগতে প্রবেশ করলাম।
বিজ্ঞানের উন্নতি
ও অগ্রযাত্রাকে তুলে ধরতে আগরতলা শহরের কাছে ৩০ একর জায়গার ওপর নির্মিত এই সায়েন্স
সিটি উদ্বোধন হয়েছে এই বছরের একদম শুরুতেই। বর্তমানে নির্মিত মূল বিল্ডিংয়ে
৬টি এক্সিবিশন হল, ২টি সেমিনার হল, ১টি প্ল্যানেটোরিয়াম, ১টি থ্রিডি হল, ১টি চিল্ড্রেন
অ্যাক্টিভিটি হল রয়েছে। এক্সিবিশন কম্পোনেন্টের মধ্যে রয়েছে ফান সায়েন্স এক্সিবিট
গ্যালারি, অ্যাস্ট্রোনমি, টেম্পোরারি এক্সিবিশন, বায়োডাইভার্সিটি গ্যালারি, থ্রিডি
থিয়েটার, প্ল্যানেটোরিয়াম। জানা গেছে আগামী দিনে এখানে সায়েন্স পার্কও নির্মাণ করা
হবে।
সায়েন্স
সিটিতে বিজ্ঞানের অনেক বিষয় জানার ব্যবস্থা আছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম একেকটি
গ্যালারি আর অবাক হচ্ছিলাম নানা অজানা তথ্য জেনে। ডিসপ্লেতে নানা তথ্য শো করছিল।
কোথাও বা অডিও, কোথাও ভিডিওতে দেখা হচ্ছিল নানা বিস্ময়কর জিনিস। একটি গ্যালারি আছে
ফান সায়েন্স নামে। এটাতে গিয়ে দারুণ মজার মজার জিনিষ দেখেছি। বিশেষ করে ছোটদের
জন্য আদর্শ গ্যালারি। এছাড়াও থ্রিডি থিয়েটার বিভিন্ন সময়ে শো হয়, সেগুলো দেখা যায়
টিকেট কেটে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন শো ছিল না, তাই দেখতে পারিনি। পুরো ভবনের
নিচতলার গ্যালারিগুলো চালু হলেও দ্বিতীয়তলায় আরও বেশকিছু গ্যালারির কাজ চলছে।
সেগুলো সম্পন্ন হলে আরও আকর্ষণীয় হবে পুরো সায়েন্স সিটি, এটা বলে দেয়াই যায়। আর
হ্যাঁ, সায়েন্স সিটি সকাল
১১টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতি সপ্তাহের
সোমবার শুধু এটি বন্ধ থাকে।
বিকেল হয়ে আসছে, খিদেও চাগিয়ে
উঠেছে। ঘন্টাখানেক সায়েন্স সিটিতে কীভাবে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না। বেরিয়ে
দ্রুত চলে এলাম শহরে। ড্রাইভার ফোটন ভাই আমাদেরকে শংকর হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে
চলে গেলেন। ওনাকে লাঞ্চ অফার করলেও উনি খেলেন না। শংকর হোটেল আগরতলার ঐতিহ্যবাহী
হোটেল। লাঞ্চটা সেখানেই সেরে নিলাম। এরপর আর ঘোরাঘুরি না করে ক্লান্ত দেহে হোটেলের
রুমে চলে গেলাম।
রাতের আগরতলা
সন্ধ্যার পর রাতের আগরতলাকে
এক্সপ্লোর করে বের হলাম। আমাদের একজন সহযাত্রী কাল চলে যাবে কলকাতা। তার জন্য
টিকেট করতে রেলস্টেশনে চলে গেলাম। আগরতলা রেলস্টেশনে যেতে বটতলায় যেতে হবে প্রথমে।
সেখান থেকে অটোতে ২০রুপিতে জনপ্রতি যাওয়া যায় স্টেশনে। আমরাও গেলাম। স্টেশনের মূল
ভবনের স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করার মতো। আর ভেতরে সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দেখে আরও অবাক
হলাম। পুরো স্টেশন একদম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। স্টেশনে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ। দারুণ
একটা স্টেশন। আমাদের পাশের দেশের একটা সীমান্তঘেঁষা রাজ্যে এরকম স্টেশন দেখব
ভাবিনি। ভারতীয় রেলসেবা দুনিইয়ার অন্যতম সেরা কেন তার প্রমাণ পেলাম। যা হোক, আমরা
কলকাতার টিকেট পেলাম না। আর কলকাতা ট্রেনে যাওয়া ৩০ঘন্টার বেশি সময়ের ব্যাপার। তাই
আমাদের ট্যুরমেট মুহিবুর সিদ্ধান্ত নিলো ফ্লাইটে যাবে। বটতলায় এসে একটা এজেন্সি
থেকে ফ্লাইটের টিকেট কেটে নিলো পরদিন সকালের জন্য।
চিকেন ফ্রাইড মমো। আগরতলা মানেই স্ট্রিটফুডের দারুণ অভিজ্ঞতা। ছবিঃ লেখক |
আগরতলা সিটি সেন্টারে গেলাম
এরপর। ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরো সিটি সেন্টার। পরে শপিং সেন্টারগুলোতে ঘুরলাম।
স্মার্ট বাজার, বাজার কলকাতা, বিশালে ঘুরলাম। টুকটাক শপিং করে নিলাম বাসার জন্য।
শপিং শেষে দেখি রাত নয়টা বেজে গেছে। খাওয়াদাওয়া হয়নি রাতের। সিদ্ধান্ত নিলাম
স্ট্রিটফুড খাব। গতকালের নির্বাচনের ফলাফল পরবর্তী সমস্যার জন্য আজও অনেক
স্ট্রিটফুডের দোকান বন্ধ। কিন্তু কিছু দোকান খোলাও আছে। আমরা একটা দোকানে গিয়ে
চিকেন ফ্রাইড মমো অর্ডার করলাম। সাথে কোমলপানীয়। বেশ ভালো ছিল মমোর স্বাদ।
রাত সাড়ে নয়টায় দেখি আগরতলার
বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে, নিস্তব্দ হয়ে গেছে শহরের রাস্তাগুলো। আমরা
হাঁটছিলাম। মমো খেয়ে মন ভরলেও পেট ভরেনি। ভাবছিলাম রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার করবো।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছোট্ট স্ট্রিটফুডের দোকান। সেখানে চালের রুটি আর চিকেন রোস্ট
বিক্রি হচ্ছে। মানুষের ভীড়। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম এটা ট্রাই করার। যেই ভাবা সেই
কাজ। তিনজনের জন্য অর্ডার করলাম। চালের রুটি আর রোস্ট দুটোই দারুণ লাগল। খাবারের
মান ও স্বাদ অসাধারণ ছিল। খেয়ে দারুণ তৃপ্ত হলাম।
রাতের আগরতলা ঘুরে ঘুরে বেশ ভালোই সময় কাটল। সাড়ে দশটার দিকে হোটেলের রুমে চলে গেলাম। ক্লান্ত দেহে ফ্রেশ হয়েই ঢলে পড়লাম বিছানার কোলে।
বাকি অংশ
তৃতীয় পর্বে
0 মন্তব্যসমূহ