আগরতলায় আতঙ্ক



আগরতলা ভ্রমণ পর্ব-১

ভারতের ২৮টা রাজ্য ও ৮টা কেন্দ্রশাসিত রাজ্যসংঘের মধ্যে যে ক’টা রাজ্য বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত, তার মধ্যে অন্যতম হলো ত্রিপুরা। এর আগে ভারতের মেঘালয় ও আসাম ভ্রমণ করা হলেও ত্রিপুরায় যাইনি কখনো। এবার ভিসা করার পর ত্রিপুরায় ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল শুরু থেকেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে থাকা আগরতলা, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের জায়গা মেলাঘরের মতো স্থানগুলোতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল বেশি। তাছাড়া যে ত্রিপুরার রাজধানী একসময় আমাদের কুমিল্লা ছিল, সেই ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সাথে আমাদের এখনকার কুমিল্লার একটা তুলনামূলক চিত্র দেখে আসারও ইচ্ছে ছিল।

ভিসা করেছি অনেকদিন হয়ে গেছে। নানা ঝামেলায় বের হতে পারছিলাম না। ওদিকে আমার ভ্রমণসঙ্গী ব্যাংক কর্মকর্তা বন্ধুবর জাকারিয়া কবিরের ভিসাও শেষ হয়ে যাবে শিগগিরই। তাই হঠাৎ করেই বেড়িয়ে পড়লাম গত ২রা মার্চে। শায়েস্তাগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে আখাউড়া যাওয়ার জন্য দুপুর একটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জংশনে। ট্রেন আসার কথা ছিল দুপুর ১.১৫মিনিটে। কিন্তু প্রায় ঘন্টাখানেক দেরিতে এলো ট্রেন। ২.৪০মিনিটে এসে পৌঁছাল প্ল্যাটফর্মে। সিলেট থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ট্রেন পাহাড়িকা এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম আমাদের নির্ধারিত বগির শোভন শ্রেণির আসনে। বিভিন্ন স্টেশন ও ক্রসিংয়ে থেমে থেমে ট্রেনটা গিয়ে আখাউড়া স্টেশনে পৌঁছাল সাড়ে চারটার দিকে। যেহেতু আমাদের হাতে সময় কম, লাঞ্চও করতে পারবো না, তাই ট্রেনেই ফাস্টফুড খেয়ে নিলাম আপাতত। ট্রেনের খাবারের দাম বেশি ও খাবার ঠাণ্ডা হলেও সময় হাতে না থাকায় সেটাই গলঃধকরণ করা লাগল। কী আর করা!

স্টেশন থেকে বেরোতেই সিএনজি আর অটোওয়ালাদের হাঁকডাক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া একটি ঐতিহ্যবাহী ও পুরোনো স্টেশন। ব্রিটিশ আমলে ১৮৯৬সালে এটি নির্মিত হয়। সিলেট থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম যেতে হলে এই স্টেশন হয়ে পরে ট্রেন আলাদা দুই পথে চলে যায়। আখাউড়া থেকে সিএনজি বা অটো রিজার্ভ নিয়ে আখাউড়া স্থলবন্দরে যাওয়া যায়। দূরত্ব মাত্র সাত কিলোমিটার। আমাদের হাতে সময় কম, ইমিগ্রেশনে গিয়ে সময়ের আগেই ঢুকতে হবে। একটা সিএনজি রিজার্ভ নিলাম। ভাড়া দেড়শো টাকা। অটোতে গেলে অবশ্য ৮০-১০০টাকায় যাওয়া সম্ভব ছিল। যাই হোক, স্টেশন থেকে আখাউড়ার রাস্তাটা খুবই সুন্দর ও নয়নাভিরাম। প্রকৃতি দেখতে দেখতে ১৫মিনিটেই পৌঁছে গেলাম স্থলবন্দরে।

আখাউড়া-আগরতলা বাংলাদেশের অন্যতম স্থলবন্দর। ভারতের সাথে পণ্য আমদানি-রফতানির গুরুত্বপূর্ণ রুট। ১৯৯৪সালে চালু হয় এই বন্দরটি। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ায় এই স্থলবন্দরের গুরুত্ব ও পণ্য পরিবহনের পরিমাণ প্রচুর বেড়ে গেছে। ১৯শে এপ্রিল ২০১১ থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পন্য পরিবহন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।  আমরা গিয়ে প্রথমে সোনালি ব্যাংকের বুথে ৫০০টাকা করে ভ্রমণ ট্যাক্স দিয়ে দিলাম। বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে ভারতে গেলে এই ট্যাক্স বাধ্যতামূলক। আকাশপথে ও ট্রেনে গেলে এটা টিকেটের সাথেই সংযুক্ত থাকে, তাই আলাদা করে দিতে হয় না। ট্যাক্স দিয়ে দ্রুত নাম এন্ট্রি করে চেকইন সেরে নিলাম। এরপর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে ভারত অংশের ইমিগ্রেশন এরিয়ায় ঢুকে পড়লাম। বিকেলবেলায় ভীড় কম থাকায় ১৫মিনিটেই বাংলাদেশ অংশের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলো।

ভারত অংশের ইমিগ্রেশন ভবনে ঢুকে অবাক হলাম খুব। পুরো ইমিগ্রেশন ভবন দারুণভাবে তৈরি করা হয়েছে। একেবারে এয়ারপোর্টের সুযোগ-সুবিধা ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা চোখে পড়ল সর্বত্র। একটা আন্তর্জাতিক স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমনই মনে হলো। অপরদিকে বাংলাদেশ অংশের ইমিগ্রেশন সেই মান্ধাতার আমলের হয়ে আছে এখনও। তবে আশার কথা, নতুন ইমিগ্রেশন ভবন তৈরি হচ্ছে। সেটার কাজ শেষ হলে হয়তো আমাদেরও আধুনিক ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যাই হোক, চেকইন ও লাগেজ স্ক্যানিং শেষ করে, অ্যারাইভাল ফর্ম ফিলআপ করে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাওয়ার পর ভারতের ইমিগ্রেশন অফিসার যা বললেন তাতে ধাক্কা খেলাম বড়সড়। চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠল আমাদের কপালে।

ইমিগ্রেশন অফিসার যা বললেন তার সারমর্ম হলো, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। আজকে তার ফলাফল দেবে। পাঁচটায় ফল প্রকাশের পর বিজয়ী দল উল্লাস করে যেমন, তেমনি অনেকে সহিংসতায় মেতে ওঠে। আমাদের দেশের মতো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আছে সেখানেও। শুধু তাই নয়, সেদিন আগরতলাসহ ত্রিপুরার সকল শহরের দোকানপাট সব বন্ধ থাকে। ফলে আমাদের বিপদে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আমরা আজকে ওখানে প্রবেশ করবো কী না ভেবে দখতে বললেন তিনি। আর যদি আমাদের বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজন থাকে, তারা আমাদের রিসিভ করবে কী না জিজ্ঞেস করলেন। হোটেল বুক করেছি কী না সেটাও জানতে চাইলেন। আমাদের উত্তর ছিল না-বাচক। কারণ আমরা আগরতলা গিয়েই হোটেল নেয়ার প্ল্যান করে গিয়েছি।

ইমিগ্রেশন অফিসারের কথায় চিন্তিত হয়ে কয়েক জায়গায় ফোন দিলাম। তাতে জানা গেলো আজ সব বন্ধ থাকলেও হোটেল-মোটেল খোলা থাকবে। ফলে আমাদের অসুবিধা হবে না তেমন। আর অন্যান্য পর্যটকেরাও যাচ্ছেন দেখে আমরাও যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। এতটা ধাপ পেরিয়ে ফিরে যেতে মন চাইল না। ‘যা আছে কপালে’ ভেবে মনে আতঙ্ক নিয়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে নিলাম। এরপরই পা রাখলাম ভারতের মাটিতে। ইমিগ্রেশন এরিয়া থেকে বেরিয়ে গেলাম শহরে যাওয়ার যানবাহনের খোঁজে।

নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন বিজেপি এবারও নির্বাচিত হয়েছে। আমরা বের হয়ে অটোর ড্রাইভারের সাথে কথা বললাম। আজ অটোর সংখ্যা খুবই কম। একেকজন ভাড়া হাঁকছিল খুব বেশি। জনপ্রতি ২০/৩০টাকা দিয়ে যেখানে যাওয়া যায় সেখানে আমাদের তিনজনের কাছে ৩০০টাকা দাবি করছিল। বলছিল আজ যাওয়ায় ঝুঁকি আছে, তাই রেট বেশি। কী আর করা, অগত্যা ২৫০রুপিতে তিনজন একটা অটো নিয়ে শহরের দিকে রওনা হলাম। পথে পথে দেখলাম গেরুয়া পার্টির সমর্থকেরা গেরুয়া রঙ ছিটাচ্ছে একে-অপরের দিকে। বাইক নিয়ে বড় বড় মিছিল-শোডাউন করছে। আমাদের একজন ভিডিও করছিল চারপাশের দৃশ্যগুলো। একটা বাইক থেকে ২/৩টা ছেলে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি শুরু করল সেটা দেখে! অটো ড্রাইভার আজকে কোনো ভিডিও করতে নিষেধ করলেন। ২০ মিনিটের মধ্যেই আমাদেরকে আগরতলার পোস্ট অফিস চৌমুহনী এলাকার হরি গঙ্গাপ্রসাদ সড়কে নামিয়ে দিলেন ড্রাইভার। এখানে কয়েকটা ভালো হোটেল আছে। যে কোনো একটায় উঠে যেতে বললেন আজ।

আমরা অটো থেকে নামার পর দেখলাম পুরো শহর একদম থমথমে হয়ে আছে। কোথাও মানুষজন নেই। সব দোকানপাট বন্ধ। মনে হলো একদম নিস্তব্দ, নীরব কোনো নগরী আগরতলা। রাস্তার এপাশ-ওপাশ দুটো হোটেল দেখলাম। তারপর হোটেল সিটি সেন্টার নামের একটা হোটেলে রুম পছন্দ হলো। তিনজন থাকার মতো একটা রুম নিলাম। আমি আর বন্ধু জাকারিয়ার সাথে আখাউড়া বর্ডার থেকে একটা ছেলে যোগ দিয়েছে। সে একাই ছিল, তাই আমাদেরকে অনুরোধ করেছে আমাদের সাথে থাকতে ও ঘুরতে চায়। সিলেটেরই ছেলে, বয়সে বেশ জুনিয়র। কথাবার্তায় ভদ্র মনে হলো। নাম মোহাম্মদ আলি। তাই তাকেও নিয়ে নিলাম সাথে। তিনজনের জন্য বড় একটা রুম নিলাম, ভাড়া প্রতিরাত ২২০০রুপি। রুমটা পছন্দ হলো। একটু পুরোনো ধাঁচের ফার্নিচার ও ইন্টেরিয়র হোটেলটার। তবে সুযোগ-সুবিধা ভালোই ছিল। এসি রুম, সাথে বাথরুমে গরম জলের গিজার ছিল। আর বেশ ভালো স্পিডের ওয়াইফাই ছিল। শুনলাম আগরতলার পুরোনো হোটেলগুলোর মধ্যে এটা উন্নত ছিল একসময়। এখন আরও অনেক আধুনিক ও উন্নতমানের হোটেল হয়ে গেছে, তাই এটা একটু পুরোনোধাঁচের মনে হবে। তবে আমরা তো ঐতিহ্যের সন্ধানী, আমাদের খারাপ লাগার কারণই নেই। তবে হোটেলের সাথে ব্রেকফাস্ট অন্তর্ভুক্ত থাকলে ভালো হতো। আমরা সেরকমই চেয়েছিলাম। কিন্তু আজকের আতঙ্কজনক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আর যাচাই-বাছাই করিনি।

রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে গেলো। আজকে যেহেতু ঘোরাঘুরির সুযোগ নেই, আজকের রাতটা রুমেই কাটিয়ে দেব। ভালো রেস্টও হবে। রাতের খাবারটা হোটেলের কিচেন থেকে অর্ডার দিয়ে রুমেই খেয়ে নেব ভাবছিলাম। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে হোটেলের সামনে একটু হাঁটতে বের হতেই দেখলাম অপরপাশের হোটেলের নিচে একটা চমৎকার রেস্টুরেন্টে আছে। সেখানেই খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। রেস্টুরেন্টের নাম দ্য সোশ্যাল ক্লাব। নান্দনিক ইন্টেরিয়র আর আলোকসজ্জা দেখে মুগ্ধ হলাম খুব। ভেতরের পরিবেশও নিরিবিলি। আজকে লোকও কম। আমরা একটা টেবিল নিয়ে বসে পড়লাম। মেন্যু দেখে মাটন দম বিরিয়ানি টেস্ট করতে চাইলাম তিনজনই। অর্ডার করার পর পাঁপরভাজা দিয়ে গেলো ওয়েটার। সেটা খেতে খেতে আর কিছু ছবি তুলতেই এসে গেলো খাবার। আজকে লাঞ্চ করিনি, তাই খিদেও ছিল ভালো। বিরিয়ানির ঘ্রাণে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। খেতে শুরু করলাম। ২৮০রুপির বিরিয়ানির দামটা বেশ যথার্থই মনে হলো। বড় সফট মাটন দুই পিস, আলু একপিস আর বেশ ভালো পরিমাণে বাসমতি চালের বিরিয়ানি ছিল। অনেকটা আমাদের দেশের কাচ্চির মতো দেখতে হলেও স্বাদটা একটু ভিন্ন ছিল। ঝাল ঝাল একটা স্বাদ। আমার আর আমার সহখাদকদের ভালোই লেগেছে।

খাওয়া শেষ করে বাইরে এসে দেখি রাতের আগরতলা আজ আরও বেশি নীরব। স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলো বন্ধ, নেই কোনো ব্যস্ততা। নির্বাচনে জয়ী দলের কর্মীরা আমাদের সামনেই বাজি ফুটাচ্ছিল। আমরা বড় এক বোতল জল কিনে রুমে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরিবেশটা এখনও আতঙ্কের মনে হলো। তবে আশার কথা হলো আগামীকাল বেশিরভাগ দোকান খুলে যাবে, সব স্বাভাবিক হবে বলে স্থানীয়দের সবাই জানালেন। রুমে গিয়ে মোবাইল চার্জ করে বিভিন্ন জায়গায় ফোনে কথা বলে ঘুমুতে ঘুমুতে রাত একটার মতো বেজে গেলো। নিস্তব্দ রাতে হোটেলের রুমে বসেই একের পর বাজির শব্দ আসছিল কানে। মনে হলো সারা শহরকে নিস্তব্দ করে কিছু মানুষ উল্লাসে মেতে উঠেছে। কী আর করা, যস্মিন দেশে যদাচার!

 

(বাকি অংশ দ্বিতীয় পর্বে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ