প্রচুর ভিড় ঠেলে মেলায় ঢুকতেই মাছের আড়ৎগুলোতে বিক্রেতাদের হাঁকডাক। মুহূর্তেই
নিলামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ টাকার মাছ। আড়তের পাশেই বিশাল আকারের সব রুই, কাতলা,
মৃগেল, বোয়াল, চিতল, গজার, ইলিশ, বাঘাইড়সহ দেশি প্রজাতির মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন
দোকানিরা। সেসব মাছ কিনতে যেমন ক্রেতাদের অভাব নেই, দেখতেও তেমনি দর্শনার্থীদের ভিড়
সর্বত্র। সিলেট বিভাগের তো বটেই, সারা দেশের নানাপ্রান্ত থেকে ক্রেতা আর বিক্রেতায়
মুখরিত থাকে কুশিয়ারা নদীর তীর। এ যেন মেলা নয়, মাছের মহোৎসব। যেখানে একেকটি বড় বাঘাইড়
মাছের দাম ওঠে এক থেকে দেড় লাখ টাকায়। বোয়াল মাছ বিক্রি হয় ৫০হাজার ১লাখ টাকা পর্যন্ত।
মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার শেরপুর সিলেট বিভাগের চার জেলার মিলনস্থল। সিলেট, হবিগঞ্জ
ও মৌলভীবাজার জেলা সরাসরি শেরপুরে এসে মিললেও শেরপুরের উত্তর-পশ্চিমে দশ কিলোমিটার
গেলেই সুনামগঞ্জ জেলা শুরু। এই সিলেটের কেন্দ্রস্থল শেরপুর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে একসময় নদী বন্দর, লঞ্চঘাট ছিল জমজমাট। নদীপথ ও সড়কপথে এখান থেকে দেশের নানা জায়গায়
যাতায়াত করা যায়। এখানেই এখন হচ্ছে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর পৌষ সংক্রান্তিকে
কেন্দ্র করে এখানেই প্রতি বছর বসে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা।
এই মেলাটি কবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক হিসাব নেই। তবে অনুমান করা যায় এটির বয়স ২০০ বছর
কিংবা তারও বেশি। শুরুতে মেলাটি কুশিয়ার ও মনু নদের মিলনস্থল মনুমুখ নামক জায়গায় বসত।
কালের বিবর্তনে নদীভাঙনের কবলে পড়ে মেলাটি ৫০/৬০ বছর আগে শেরপুরের কুশিয়ার নদীর তীরে
স্থানান্তর হয়। সদর উপজেলার তৎকালীন সত্রস্বতী পরগনার সাধুহাটি গ্রামের জমিদার রাজেন্দ্রনাথ
দাম (মথুর বাবু) মেলাটি প্রবর্তন করেছিলেন। যা এখন জেলা প্রশাসন থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে
লাখ লাখ টাকায় ইজারা দেয়া হয়। দুই রাত ও একদিনের এই মেলাটিতে কয়েক কোটি টাকার মাছ ও
অন্যান্য পণ্য বিকিকিনি হয়। ঐতিহ্যের সাথে বাণিজ্যিকভাবেও তাই মেলাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শেরপুরের মাছের মেলা সারাদেশ ও বাংলাভাষী পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছেই পরিচিত। ইন্টারনেটের
কল্যাণে এখন সবাই চেনে, জানে এটির কথা। পৌষের শিশিরভেজা রাতে শুরু হয়ে মাঘের প্রথম
তারিখে গিয়ে মেলাটি সমাপ্ত হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় তৈরি হয় উৎসবের আমেজ।
অনেক বাড়িতে তৈরি হয় পিঠাপুলি, আসেন আত্মীয়স্বজনেরাও। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মেলাটি
পরিণত হয় এক মিলনমেলায়।
সিলেট বিভাগ হাওর ও নদীবেষ্টিত। এসব হাওর, নদীর সবচেয়ে বড় ও তাজা মাছগুলো মারা হয় মেলাকে
কেন্দ্র করে। হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, কাউয়াদীঘির হাওর, টাঙুয়ার হাওর ছাড়াও সুরমা,
কুশিয়ারা, মনু, খোয়াইসহ বিভিন্ন নদ-নদীর মাছ ভালো দাম পাওয়ার আশায় সবাই মেলায় বিক্রি
করতে চায়। তাছাড়া মাছের পাইকারি আড়ৎগুলোতে রাজশাহী, নাটোর, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা,
চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ইত্যাদি এলাকা থেকে অসংখ্য ট্রাক ভর্তি করে মাছ আসে, যা রাতভর পাইকাররা
নিলামের মাধ্যমে কিনে নিয়ে বিক্রি করেন দেশের বিভিন্ন বাজারে। মাছের মেলার ব্যাপ্তি
তাই মৌলভীবাজারের শেরপুর থেকে ছড়িয়ে যায় সিলেট বিভাগ তথা দেশের আনাচেকানাচে।
মাছের মেলা নাম হলেও শেরপুরের এই মেলাটিতে মাছ ছাড়াও বসে নানা পণ্যের সমাহার। ঘর সাজানোর
ফার্নিচার, শিশুদের খেলনা, জামাজুতো, কম্বলসহ শীতের নানা উপকরণ, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী
মুড়ি, মুড়কি, মণ্ডা, মিঠাই, বাতাসা, মিষ্টি খই ও নানা পদের মিষ্টান্ন পাওয়া যায় মেলায়।
শুধু তাই নয়, লোহা ও লোহাজাত বিভিন্ন পণ্য, ঐতিহ্যবাহী গাইল, ছিয়া, বেতবাঁশের ও মাটির
আসবাবপত্র এবং শীতলপাটি পর্যন্ত পাওয় যায়। তাই এটি মাছের মেলা যতটা সত্য, তারচেয়ে বেশি
সত্য এটি একটি সার্বজনীন পণ্যের মেলাও বটে।
করোনার প্রকোপ ও বিধিনিষেধের কারণে গত দুই বছর (২০২১-২০২২) মেলাটি অনুষ্ঠিত না হলেও
এবার (২০২৩) আবার বসছে মেলা। জানুয়ারির ১৩-১৪ তারিখে পৌষ সংক্রান্তিতে তাই নতুন বছরে
নব উদ্যমে এবারের মেলাটি হচ্ছে। স্রোতস্বিনী কুশিয়ারার তীরজুড়ে আবারও ছড়িয়ে পড়ুক পৌষ
সংক্রান্তির এই মেলাটির সার্বজনীন রূপ, রস, ঘ্রাণ। নাকজুড়ে আবারও নেমে আসুক রূপালি
মাছের আঁশটে গন্ধ। জয় হোক বাংলার। বেঁচে থাকুক বাঙালির ঐতিহ্য।
0 মন্তব্যসমূহ