লাল শাপলার রাজ্যে একটি হেমন্তের সকাল

 


সিলেটে বেড়ানোর জন্য আদর্শ সময় হলো বর্ষাকাল। সুনামগগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, ভোলাগঞ্জ শাদাপাথর, রাতারগুল জলাবন, জাফলং, পাহাড়ের বুক চিরে আসা ঝর্নারাজি বর্ষায় এক মোহনীয় রূপ ধারণ করে। কিন্তু বর্ষাকালের বাইরেও নানা ঋতুতে সিলেটের সৌন্দর্য আরও নানাভাবে প্রকাশিত হয়। শরতের শেষে কুয়াশাঝরা হেমন্ত, কনকনে শীত আর ঋতুরাজ বসন্তেও সিলেট তার সৌন্দর্যের পসরা সাজায়, মেটায় ভ্রমণপ্রেমীরদের চোখ আর মনের তৃষ্ণাও। আজ শীতের সিলেটের সৌন্দর্য নিয়ে বলবো আমার পুরো একটি দিনের ভ্রমণ গল্প।

সিলেটের এক জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট গ্রুপের সাথে গত ৪ঠা নভেম্বর শুক্রবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দারুণ একটি দিন কাটাতে এক বন্ধুকে নিয়ে আগেরদিন ৩রা নভেম্বর তাদের একটি প্যাকেজ বুকিং দিলাম। প্যাকেজের প্রধান আকর্ষণ ছিল লাল শাপলার বিল তথা ডিবির হাওরে ফুটন্ত লাল শাপলার সাথে একটি হেমন্তের সকাল কাটানো। সাথে নীলপানির লালাখাল আর জাফলংয়ের পাহাড়ি সৌন্দর্য তো আছেই। সবমিলিয়ে পুরো ভ্রমণটা নিয়ে দারুণ এক্সাইটেড ছিলাম আমরা।

সকাল ৭টায় আমরা সিলেট নগরীর চৌহাট্টায় আলপাইন রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছে যাই। সেখান থেকেই আমাদের বাস যাত্রা শুরু করবে। একে একে পুরো গ্রুপের সবাই চলে আসেন। মোট ৩৪জন মানুষ, দেশের নানাপ্রান্ত থেকে এসে যোগ দিয়েছেন আমাদের সাথে এই যাত্রায়। যার মধ্যে অর্ধেকের মতো নারী পর্যটকও ছিলেন। কেউ কাউকে চিনি না, কিন্তু একসাথে ট্যুর করবো। গ্রুপ ট্যুরে গেলে এই মজাটা পাওয়া যায়। নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া যায়।

সকাল সাতটার একটু পরেই আমরা যাত্রা শুরু করলাম জৈন্তাপুর বাজারের দিকে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সিলেট-তামাবিল রোডের দারুণ ভিউ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম জৈন্তাপুর বাজারে। সেখানে আমরা সকালের নাশতা সেরে নেব। হোটেল পলাশীতে আমাদের পূর্বনির্ধারিত মেন্যু অনুযায়ী সবাই নাশতা সেরে নিলাম। এরপর রওনা দিলাম পাটগ্রাম ইউনিয়নের ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড়ের কোলে ডিবির হাওরের দিকে। মাত্র এক কিলোমিটার রাস্তা বাকি ছিল, ১০মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। যেহেতু আমরা বাস নিয়ে গিয়েছি, বিল পর্যন্ত যাওয়ার উপায় নেই। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে মেঠোপথ ধরে আরও এক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। বাস থেকে নেমে তাই হাঁটা শুরু করলাম সবাই।

পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। আগেই ঠিক করে রাখা আমাদের নৌকায় উঠার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। এরমধ্যে অসংখ্য পর্যটক-নৌকা ঘুরছে বিলে। অনেকে ঘোরা শেষ করে ফিরেও যাচ্ছে। আমরা চারটা নৌকায় পুরো গ্রুপ ভাগ হয়ে উঠলাম। ইতোমধ্যেই শাপলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ সবাই। সে গল্পে পরে আসছি। তার আগে শাপলা বিল সম্পর্কে কিছু তথ্য শেয়ার করে নিই।

ডিবির হাওরে পর্যটকদের পার্কিং করা গাড়ির পাশে ভেড়ার পালের দৃশ্য অসাধারণ! ছবিঃ লেখক




ডিবির হাওর বা লাল শাপলার বিল

জৈন্তাপুর সিলেটের একটি ঐতিহাসিক উপজেলা। এর ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। তার সাথে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। লাল শাপলার বিল যেমন অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা, তেমনি এর রয়েছে অনেক মিথ ও ইতিহাস। ইয়াম, হরফকাটা, কেন্দ্রী বিল ও ডিবি নামের মোট চারটা বিল নিয়ে এই লাল শাপলার রাজ্য। সিলেট শহর থেকে ৪২ ও জৈন্তাপুর বাজার থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। এই বিলটি একসময় মাছেদের অভয়ারণ্য ছিল। সরকারিভাবে ইজারা দেয়া হতো লাখ লাখ টাকায়। তখন এখানে লাল শাপলা ছিল না, ছিল শাদাপদ্মের রাজত্ব। এখান থেকে শালুক, পানি ফল পাওয়া যেত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। কিন্তু একসময় এই বিলে কেউ লাল শাপলার চারা ফেলেছিল। সেখান থেকে লাল শাপলায় ছেয়ে যায় পুরো বিল। ৭/৮ বছর এটার কথা কেউ জানত না। কিন্তু এখন অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পর্যটকে মুখরিত থাকে বিলটি। এখন আর এখানে তেমন মাছ পাওয়া যায় না। শাপলার সৌন্দর্য নষ্ট হবে বলে মাছ শিকার করতে জালও ফেলা হয় না। এখন শাপলা ফোটার অপেক্ষায় থাকেন স্থানীয়রা।

পৌরাণিক আমলের জৈন্তিয়া রাজ্য আজকের এই জৈন্তাপুর। এককালে এই রাজ্য ছিল নারীশাসিত। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে জৈন্তা রাজ্য শাসন করেছেন খাসিয়া রানি জৈন্তেশ্বরী দেবী। শোনা যায় পরাক্রমশালী মোগল ও ইংরেজরাও কখনো জৈন্তিয়া জয় করতে পারেনি। সিলেট অঞ্চলের জৈন্তিয়া রাজ্য সম্পর্কে এখনও নানা গল্প শোনা যায়, যা রূপকথাকেও হার মানায়। স্থানীয়দের মতে, জৈন্তিয়া রাজ্যের রাজা রামসিংহের মামা বিজয় সিংহকে এই হাওরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নৌকা ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। তার স্মৃতিতে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার ভগ্নাংশ হাওরে এখনও দেখা যায়। ঘুরতে যাওয়া প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে যারা ইতিহাস-সচেতন, তারা মন্দিরটি দেখতে যান। শুধু প্রাচীন ইতিহাস নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও সমৃদ্ধ জৈন্তাপুর। এর লাগোয়া মুক্তিযুদ্ধের চার নম্বর সাব সেক্টর মেঘালয়ের মুক্তাপুর। বলা যায়, শুধু সৌন্দর্য নয়, সিলেটের জৈন্তাপুরের লাল শাপলার বিল প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক নানা ঘটনার নীরব সাক্ষী।

ডিবির হাওরের অপার্থিব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ছবিঃ লেখক

মোট ৯০০ একর এলাকা নিয়ে এই লাল শাপলার রাজ্য। এখানে শাপলা ছাড়াও নানা ধরনের অতিথি ও স্থানীয় পাখির দেখা মেলে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিগুলো বিলের ওপর উড়ে বেড়ায়, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ করে অবিরাম। বালিহাঁস, পাতিসরালি, পানকৌড়ি, নীলকণ্ঠী, সাদাবক, জলময়ূরসহ অসংখ্য প্রজাতির পাখি দেখা য়ায়। লাল শাপলার বিল সংরক্ষণে উপজেলা প্রশাসন কমিটি করে দিয়েছে। নৌকাভাড়াও নির্ধারণ করে দিয়েছে, প্রতি নৌকা ৩০০টাকা করে। বিলের সৌন্দর্য রক্ষায় বিল থেকে ফুল ছেঁড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

প্রকৃতির অপার মহিমায় মুগ্ধ হয়ে ঘুরছিলাম আমরা। সাথে চলছিল ফটো ও ভিডিওগ্রাফিও। মাঝিরা গান গাইছিল গলা ছেড়ে। তার সাথে তাল মেলাচ্ছিলাম আমরাও। নৌকা থেকে একটা ডিবিতে নেমেছিলাম, ডাঙায়। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে পুরো বিল আরও সুন্দর দেখা যায়। পাশেই মেঘালয় পাহাড়ের সবুজ আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ এলাকা। আকাশে শাদা মেঘের উড়ে বেড়ানো, ওপরে পাহাড় আর নিচে জলের ওপর ভাসমান পদ্মের সাথে বকের সারির ওড়াউড়ি- এ এক অপার্থিব সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন করে দেয় আমাদের। দেখতে দেখতে ঘন্টাদুয়েক কাটিয়ে দিলাম কীভাবে বলতেও পারবো না। ততক্ষণে গনগনে সূর্য মাথার ওপর। শাপলাগুলোও মিইয়ে যেতে শুরু করেছে। আমরাও তাই ফেরার পথ ধরলাম। ২০টাকা জনপ্রতি অটো ভাড়া দিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের বাসের কাছে।

জাফলং জিরো পয়েন্ট। একপাশে মেঘালয়, ডাউকি ব্রিজ (ভারত) আর অন্যপাশে পিয়াইন নদী (বাংলাদেশ)। ছবিঃ লেখক




প্রকৃতিকন্যা জাফলং

সিলেটকে পর্যটনে যে জায়গাগুলো পরিচিত করেছে দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে তারমধ্যে জাফলংয়ের নাম আসে সবার আগে। শাপলার রাজ্যে পুরো সকালটা কাটিয়ে দুপুরের সময়টায় রওনা দিলাম জাফলংয়ের পথে। সিলেট শহর থেকে জাফলং ৬২কিলোমিটার হলেও লাল শাপলার রাজ্য তথা জৈন্তাপুর থেকে দূরত্ব মাত্র ১৮কিলোমিটার। রওনা দেয়ার আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জাফলং। বাস থেকে নামার সময় আমাদের হোস্ট জুনেদ ভাই সবাইকে বলে দিলেন দুইটার মধ্যে সবাই যেন সীমান্ত ভিউ রেস্টুরেন্টে চলে আসে। দুপুরে লাঞ্চ করবো সেখানেই। পুরো গ্রুপ ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়লাম জাফলং দেখতে।

জাফলং বর্ষা ও শীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে হাজির হয়। বর্ষায় পিয়াইন নদীতে জলে টুইটম্বুর থাকলেও শীতে জল কমে যায়। পিয়াইন নদীর পাড়ে নুড়ি আর পাথরের এক রাজ্য গড়ে উঠেছে। এখানকার পাথর সারাদেশে যায়। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পাথর আসে পিয়াইন ও ধলাই নদীতে। সে পাথর পেশাদার ডুবুরিরা উত্তোলন করেন। সেগুলো ক্র্যাশার দিয়ে নানা সাইজ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করা হয়।

গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত জাফলং সিলেটে আসা পর্যটকদের গন্তব্যের তালিকায় সবসময় থাকে। জৈন্তা পাহাড় আর মেঘালয় পাহাড়ের মাঝখানে স্বচ্ছ, শীতল নদী বয়ে গেছে। সে নদীতে পর্যটকরা বোটিং, কায়াকিং, সাঁতার কাটা, গোসল করাসহ সবই করেন। বর্ষায় মায়াবি ঝর্না জলে পূর্ণ থাকে, সবাই জাফলংয়ের এই ঝর্নায় গিয়ে জলকেলি করেন। শীতে পানি কমে যাওয়ায় ঝর্নায় না গিয়েই জাফলং উপভোগ করতে হয়। ভারতের সীমান্তঘেঁষা জাফলংয়ের জিরো পয়েন্টে গেলে ওপাশে ভারতের ট্যুরিস্ট ও জেলে নৌকা একদম কাছ থেকে দেখা যায়। ভারতীয় অনেক ট্যুরিস্টের সাথে কথাও বলা যায়। ডাউকি ঝুলন্ত সেতুটির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় জিরো পয়েন্ট থেকে। তামাবিল স্থলবন্দর হয়ে যারা মেঘালয়, শিলং, চেরাপুঞ্জি ঘুরতে যান, তারা ডাউকি ঝুলন্ত সেতুর ওপর দিয়েই গিয়ে থাকেন।

পিয়াইন নদীর তীরে পাথুরে জাফলংকে প্রকৃতিকন্যা বলা হয় এই নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্য। ছবিঃ লেখক





জাফলংয়ে ঘুরতে গেলে পিয়াইন নদীর ওপারে খাসিয়াপুঞ্জিতে যান অনেকে। খাসিয়াদের জীবন, লাইফস্টাইল, ঘরবাড়ি ও পান উৎপাদন এবং বিশাল বিশাল পানের বরজ দেখা যায় খাসিয়াপুঞ্জিতে গেলে। পানবরজ ছাড়াও মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়াপুঞ্জিতে অনেক কমলা বাগান আছে। সিজনে গেলে বাগানে ঝুলন্ত কমলাগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় অনেকের। বল্লা, সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে ৫টি খাসিয়াপুঞ্জি। সংগ্রামপুঞ্জির রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে দেশের প্রথম সমতল চা বাগান। পাহাড়, পান, পানি, ঝর্না আর পাথর মিলিয়ে জাফলং যেন এক স্বর্গরাজ্য।

আমরা পুরো এলাকা ঘুরে একদম জিরো পয়েন্টে গেলাম। সেখানে পা ভিজিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। এরপর ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে ওঠানামার সিঁড়ির দুপাশে প্রচুর দোকান দেখা যায়। বেশিরভাগ দোকান ভারতীয় চকলেট ও কসমেটিকসের। আমরাও বাসার বাচ্চাদের জন্য চকলেট কিনে নিলাম। দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম এসব চকলেট কোথায় পান। তারা বলল, চোরাইপথে সীমান্ত দিয়ে আসে। বাজারে, বিভিন্ন দোকানে যে দামে কিনি আমরা তার থেকে অনেক কমে পাওয়া যায় বলে এখান থেকে অনেকে কিনে নিয়ে যায়।

ইতোমধ্যেই খিদে চাগিয়ে উঠেছে। গ্রুপের অনেকেই ফিরেননি। আমরা যারা ফিরেছি তারা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। যেহেতু আমাদের খাবার আগেই অর্ডার করা ছিল, আমরা খেয়ে নিলাম। বাকিরা এসে খাবে সময়মতো। খাওয়ার পর সবার খাওয়ার অপেক্ষা করতে করতে বেশ কিছুক্ষণ রেস্ট করলাম রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে। রেস্টুরেন্টে প্রচুর ভিড় থাকায় গ্রুপের সবার খেতে দেরি হয়ে গেলো বেশ কিছুটা। সাড়ে তিনটার দিকে আবার বাসে উঠলাম। এবার গন্তব্য লালাখাল।

লালাখাল শীতে দারুণ রূপ ধারণ করে। নীলজলের এই নদীতে ঘুরতে আসেন অনেকেই।  ছবিঃ লেখক


নীলজলের লালাখাল

জাফলং থেকে ফেরার পথেই পড়বে লালাখাল। সিলেট থেকে ৩৫কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় এর অবস্থান। এটি মূলত একটি নদী। এর বেশিরভাগ জল নীল রঙের হলেও কিছু জায়গায় সবুজ, কিছু জায়গায় স্বচ্ছ জলও আছে। লালাখালে ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় শীতকাল। বর্ষায় এর পানি ঘোলা থাকলেও শীতে দারুণ রূপ ধারণ করে। সারিঘাট থেকে নৌকা অথবা স্পিডবোট রিজার্ভ করে লালাখালে যেতে হয়। শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ১৫/২০জন অনায়াসেই যাতায়াত করা যায়। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির পাহাড় ও বিভিন্ন নদী থেকে নেমে আসা জল এসে মেশে লালাখালে। চেরাপুঞ্জি আর লালাখাল এপার আর ওপার বলা যায়।

লালাখালের দুপাশে পাহাড়, ঘন জঙ্গল আর মাঝখানে নদী। নদীটা এতটাই সুন্দর যে মনে হয় এই নদীতে সারাজীবন ভ্রমণ করলেও সাধ মিটবে না। মিনিট পয়তাল্লিশেক ভ্রমণ করার পর নদীর লালাখাল চা বাগানের ফ্যাক্টরি ঘাট পড়বে, যেখানে নামে অনেকে। লালাখালের দুপাশের পাহাড়গুলো এতটাই আকর্ষণীয় যে মনে হবে কেউ যেন নিজের হাতে থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে। নীল, স্বচ্ছ জলরাশি তো আপনাকে চোখ ফেরাতে দেবে না। চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে তৃপ্ত করে দেবে সহজেই। তবে লালাখাল ভ্রমণে গেলে সন্ধ্যার মধ্যেই ঘাটে ফিরে আসা উচিত। সন্ধ্যার পর নৌকা চলে না আর নদীতে, তাই বিপদ এড়াতে আগেই ফেরা উচিত।

আমরা নৌকায় করে যাচ্ছিলাম লালাখালের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে। যাওয়ার পথে একটা চরের মতো টিলা পেলাম নদীর মাঝখানে। সেখানে নেমে ছবি তোলা হলো। এরপর আবার রওনা দিলাম ফ্যাক্টরি ঘাট পর্যন্ত যেতে। কিন্তু বিধিবাম! আমাদের একটা নৌকার ফ্যানের একটা পাখা ভেঙে গেলো। সেটা সারাতে সারাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। অগত্যা আর কিছুক্ষণ এগিয়ে আবার ফেরার পথ ধরলাম। ইতোমধ্যেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এসেছে। আকাশে চাঁদও উঠেছে। মেঘমুক্ত আকাশে চাঁদের আলোয় এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। নৌকায় আলো না থাকায় চাঁদের আলো আরও বেশি করে চোখকে আরাম দিচ্ছিল। সুন্দর একটা রাতের নৌকা জার্নিও হয়ে গেলো। নৌকা নষ্ট না হলে বোধহয় এই দৃশ্যটা মিস করতাম।

ঘাটে ফিরে পাশের রেস্টুরেন্টে গিয়ে সবাই চা-পান করে নিলাম। কেউ কেউ হালকা নাশতাও সেরে নিলো। চা খেয়ে বাসে উঠে গেলাম। বাস ছাড়ল সিলেটের উদ্দেশে। একটা মোহময়, স্মৃতির পাতায় অনেকদিন রয়ে যাওয়ার মতো দিন কাটিয়ে গানে গানে আনন্দ করতে করতে সবাই গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম।

লালাখাল মানেই মুগ্ধতার এক অবিরাম প্রতিচ্ছবি! ছবিঃ লেখক





যেভাবে যাবেন

ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বাস, ট্রেন কিংবা ফ্লাইটে সরাসরি সিলেট যাওয়া যায়। ঢাকার সায়দাবাদ, ফকিরাপুল, মহাখালি, গাবতলি, রাজারবাগ থেকে শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এনা, গ্রিনলাইনসহ আরও অনেক বাস পাওয়া যায়। বাসগুলো এসি, নন-এসি, ভলভো, স্ক্যানিয়া, ডাবল ডেকার হয়ে থাকে। ভাড়া বাসভেদে ৬০০ থেকে ১৮০০টাকা। ট্রেনে গেলে আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেনে যাওয়া যায়। ভাড়া ১৫০ থেকে ১হাজার পর্যন্ত পড়বে। সিলেট থেকে সিএনজি, লেগুনা, মাইক্রোবাস, কার রিজার্ভ করে জৈন্তাপুর হয়ে এই জায়গাগুলোতে যাওয়া যায়। এসব স্পটে দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা যায়। চাইলে কেউ বাসেও যেতে পারবে। ১/২জন হলে বাসে যাওয়া যায়। বেশি হলে রিজার্ভ যাওয়াই ভালো।

যেখানে থাকবেন

জাফলংয়ে কিছু হোটেল ও রিসোর্ট আছে, জৈন্তায় আছে জৈন্তা হিল রিসোর্ট। কিন্তু যেহেতু দিনে দিনে ফিরে আসা যায়, সিলেট শহরে থাকাই ভালো। শহরের দরগা গেইট, আম্বরখানা, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, কদমতলি বাস টার্মিনাল, তালতলাসহ নানা জায়গায় একদম তারকামানের হোটেল থেকে সাধারণ হোটেলও পাওয়া যায়। হোটেলভেদে ভাড়া পড়বে। দেখেশুনে হোটেল নেয়া ভালো। কেউ ঝামেলায় না যেতে চাইলে অনলাইনে কিংবা ফোনেও বুক করে নেয়া যায়।

যেখানে খাবেন

সিলেটে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট আছে। তবে ট্যুরিস্ট হিসেবে সিলেটি খাবার ও ঐতিহ্যবাহী নানা পদের ভর্তার স্বাদ নিতে জিন্দাবাজারস্থ পাঁচভাই ও পানসী রেস্টুরেন্টে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও উঠান, সাম্পান, ডিঙি, উন্দাল, কাবাবিয়া, স্পাইসিসহ নানা ধরনের রেস্টুরেন্ট আছে সিলেটে। বাজেট ও রুচি অনুযায়ী বাংলা খাবার নাকি বিদেশি খাবেন সেটার ওপর নির্ভর করে রেস্টুরেন্ট বাছাই করতে পারেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ