ঋষি সুনাকের ব্রিটিশ মসনদে আরোহন উপমহাদেশকে কী বার্তা দিলো

 


ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ঋষি সুনাক স্বাস্থ্যব্যবস্থা পর্যবেক্ষন করতে একটি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এক বৃদ্ধাকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানকার দায়িত্বরতরা আপনাদের ঠিকভাবে সেবা দিচ্ছেন তো?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘এখানকার সবাই নিজেদের দায়িত্ব ঠিকভাবেই পালন করেন। আপনারা তাদের বেতন ঠিকভাবে দিচ্ছেন না কেন?’ ঋষি সুনাক বললেন, ‘আমরা চেষ্টা করবো’। উনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘আপনারা চেষ্টা করছেন না। আপনারা আরও সক্রিয় হন, ওনাদের সমস্যাগুলো দূর করেন’। প্রধানমন্ত্রী অবনত মস্তকে বৃদ্ধার কথা মেনে নিয়ে বললেন, ‘আপনি যা বলবেন তাই হবে ম্যাম!’

ব্রিটেনের গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, প্রধানমন্ত্রী যে শুধুই সেখানে সেবক ও চাকরীজীবী ছাড়া কিছুই নন, এই ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। এর আগেও আমরা দেখেছিলাম ডেভিড ক্যামেরনকে একজন ফাস্টফুড বিক্রেতা মহিলা ধমকেছিলেন, তিনি কেন খাবারটা নিতে গিয়ে তাড়া দিচ্ছেন, যেখানে লাইনে অন্যরাও দাঁড়িয়ে ছিল। এসব ঘটনা একটা দেশের উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের প্রমাণ। জবাবদিহি আর স্বচ্ছতার জায়গায় এরকম গণতন্ত্রই আছে বলেই একজন অশ্বেতাঙ্গ, ভারতীয় ও এশিয়ান বংশোদ্ভূত এবং নন-খ্রিষ্টান (হিন্দু) ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আজ সম্ভব হয়েছে। তাও কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীল দল থেকেই। যে কনজারভেটিভরা অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসনের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার, আজ তাদের দল থেকেই একজন অশ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়াটা ব্রিটেনের উদার গণতন্ত্র ও কিছুটা হলেও বদলে যাওয়া নীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা যায়।

বেক্সিট, কোভিড অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল অবস্থায় আছে অনেকদিন ধরেই। যার ফলে লিজ ট্রাস ক্ষমতায় বসার মাত্র ৪৫দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ব্রিটেনের কনজারভেটিভ দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় যে কমিটি, তার নাম ১৯২২ কমিটি। সে কমিটি ঋষি সুনাককে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন অনেকটা ভালো বিকল্প সামনে না থাকায়। এর আগেও দলের এমপিদের ভোটে লিজ ট্রাসের বিপক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে ঋষি সুনাক এগিয়ে থাকলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ১লাখ ৬০হাজার বা এমন সংখ্যক সদস্যের ভোট চাওয়া হয় (ভোট দেওয়ার জন্য তাদের ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বা নাগরিক হওয়া জরুরি নয়) দলের এসব সদস্য তাদের এমপিদের ভোটের ফল পাল্টে দেন। সেখানে লিজ ট্রাস পান ৫৭শতাংশ ভোট এবং ঋষি সুনাক ৪৩শতাংশ। ফলে সেবার ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। কিন্তু নিয়তি মাত্র ৪৫দিনের মাথায় পাশার দান এমনভাবে উলটে দিলো যে, অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্রিটেনের মসনদে বসে গেলেন ঋষি সুনাক।

ঋষি সুনাকের জন্ম ইংল্যান্ডের বন্দরনগরী সাউদাম্পটনে। তার বাবা যশবীর সুনাক পেশায় একজন ডাক্তার মা ফার্মাসিস্ট। অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের বর্তমান পাকিস্তান অংশ থেকে দাঙ্গায় অতিষ্ট হয়ে ঋষি সুনাকের পূর্বপুরুষেরা পূর্ব আফ্রিকায় পালিয়ে যান। সেখান থেকে একসময় ব্রিটেনে যান, নাগরিকত্ব নেন। ১৯৮০সালে ঋষি সুনাকের সেখানেই জন্ম হয়। ঋষি সুনাক একজন প্র্যাকটিসিং হিন্দু পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত হলেও জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক। স্কুল কলেজ পেরিয়ে বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি (পিপিই) পড়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেন। এরপর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে এমবিএ করেন। ২০০৯সালে তিনি বিয়ে করেন ভারতের টেক জায়ান্ট কোম্পানি ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তির মেয়ে অক্ষতা মূর্তিকে। তাদের দুজন কন্যা সন্তান আছে। ভারতীয় মিডিয়ার ভাষ্যমতে, তিনি কিশোর বয়সে একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কুটি মিয়ার রেস্টুরেন্টে তিনি কাজ করেছিলেন ছাত্রজীবনে। কুটি মিয়া ঋষি সুনাক দুজনেই স্থানীয় গণমাধ্যমে সেটা স্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য, ব্রিটেনে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলোকেইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টহিসেবে সবাই চিনে থাকেন।

ঋষি সুনাক কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী হিসেবে রিচমন্ড (ইয়র্কশায়ার) থেকে ২০১৫সালে প্রথম এমপি হন। তখন তার বয়স ৩৫বছর ছিল। এরপর মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে তিনি আজ ব্রিটেনের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটেনের গত ২১০বছরের ইতিহাসে ঋষি সুনাকই সবচেয়ে কমবয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মসনদে আরোহন করলেন। এর আগে তিনি ২০২০সালে কোভিডকালে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সচিব পরে অর্থমন্ত্রী হন। মূলত তখন থেকেই তাকে ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছিল। অবশ্য এত তাড়াতাড়ি এই পদে আসীন হবেন সেটা অনেকেই কল্পনা করেনি।

ঋষি সুনাক এমন একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন যখন রাজনৈতিক অর্থনৈতিকভাবে অস্থির একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার দেশ। বিশেষ করে করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নার্সদের বেতন না পাওয়া মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলেও আয় না বাড়াসহ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে শাসকদল কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি। বিভিন্ন জরিপে বিরোধীদল লেবার পার্টির এগিয়ে থাকাও তার দলের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার প্রমাণ দেয়। তার ওপর তাকে ঘিরে আছে কিছু অযাচিত বিতর্কও। যেমন তার স্ত্রী ইনফোসিসের শেয়ার হোল্ডার হিসেবে যে অর্থ আয় করে ব্রিটেনে নিয়ে আসেন, সেগুলোর ট্যাক্স না দেয়ার জন্য ব্রিটেনের নাগরিকত্ব না নেয়া, নিজে আমেরিকার গ্রিনকার্ড নিয়েও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া, কোভিডবিধি লঙ্ঘন কর জরিমানা দেয়া এবং একজন ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে সাধারণের কাতারে কতটা মিশতে পারবেন কী না- সেসব বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। ব্যক্তিগত বিতর্ক রাজনৈতিক নানা অস্থিরতা মোকাবেলা করে কতদিন তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব করতে পারবেন, আগামী দুই বছর কনজারভেটিভ পার্টির মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবেন কী না সেটা নিয়ে আছে ঘোরতর সন্দেহ। অবশ্য এই চ্যালেঞ্জগুলো উৎরে যেতে পারবেন কী না, রাজনীতিতে তার আদর্শ সাবেক প্রধানমন্ত্রীলৌহমানবীখ্যাত মার্গারেট থ্যাচারের মতো ইতিহাসের অমর অধ্যায় হতে পারবেন কী না সেটা সময় বলে দেবে।

ঋষি সুনাক এশিয়ান কী না, ভারতীয় বংশোদ্ভূত কী না এটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু এই বিতর্কটা অহেতুক। কারণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত আর ভারতীয় এই দুটোতে তফাৎ আছে। তারা দাদা পাঞ্জাবের মানুষ ছিলেন, সে হিসেবে তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন এটা ব্রিটিশরাও মেনে নিয়েছে। তারাও তাকে সেভাবেই পরিচয় দিচ্ছে। যেমন শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক . অ্যান্ড্রু বার্কলেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল প্রথম অশ্বেতাঙ্গ ও অভিবাসী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারের সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন ঋষি সুনাক। এটা তাকে কোনো রকম বাড়তি সুবিধা দেবে কি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, “ঋষি সুনাক যে ব্রিটেনের প্রথম এশীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী, এটা হচ্ছে বাস্তবতা। সবগুলো দলের নেতারা তার নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে। তার নিয়োগ ব্রিটিশ রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের অগ্রগতির প্রমাণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এটা একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ যে তাকে নিয়োগ করেছে কনজারভেটিভ পার্টি, যার বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে উপেক্ষা করার অভিযোগ চলে আসছিল। এ কারণে ব্রিটিশ এশিয়ানদের একটা বড় অংশ এত দিন লেবার পার্টিকে ভোট দিয়েছে।”

ঋষি সুনাক ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশের কোনো লাভ হবে না। কারণ ব্রিটেনের মতো দেশে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের মৌলিক আইন ও পররাষ্ট্রনীতিগুলো একই থাকে। ব্রিটেনেরও সেটা থাকবে। তার ওপর তিনি এমন দল থেকে এসেছেন যেটা সবসময় অভিবাসনবিরোধী। সুতরাং তিনি তার দেশ ও দলের স্বার্থ দেখবেন এটাই স্বাভাবিক।

ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আমাদের লাভ না হলেও শেখার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে উপমহাদেশের রাজনীতিতে যেভাবে গণতন্ত্র, উদার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সহনশীলতার অভাব, সেখানে ব্রিটেন একজন সংখ্যালঘুকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ধর্ম, বর্ণের চেয়ে যোগ্যতা ও নেতৃত্ব দেয়ার দক্ষতাই আসল। একবার চিন্তা করুন, বাংলাদেশে কি কোনো হিন্দু কিংবা অন্যধর্মের কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে? অথবা ভারতে মুসলিম কিংবা অন্য সম্প্রদায়ের কেউ? সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সে জায়গায় যেতে হলে এই উপমহাদেশের আরও হয়তো শত শত বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ চারদিকে যেভাবে উগ্রতার চাষ দেখি, তাতে আশাহত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অনেকে বলবেন ভারতে কয়েকজন প্রেসিডেন্ট মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট কিন্তু শুধুই আলঙ্কারিক পদ।

ব্রিটেনে যেতে, অভিবাসী হতে আগ্রহী মানুষ প্রচুর আছেন দেশে। কিন্তু নিজের দেশে ব্রিটেনের মতো উদার নীতি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে নিতে আগ্রহী নন অনেকেই। ঋষি সুনাক কতদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, কতটা সফল হবেন সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া আমাদের এই বার্তাই দেয়, মানুষকে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন করতে হবে। তার ধর্ম, বর্ণ কিংবা জাত দেখে নয়। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ