সুউচ্চ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য, শাদা মেঘেদের দলের একদম হাতছোঁয়া দূরত্বে চলে আসা, চারদিকে চোখজুড়ানো সবুজের সমারোহ, পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসা সুশীতল ঝর্না, ঝর্নার জলে সৃষ্টি হওয়া স্বচ্ছ হ্রদ, ঘাসের গালিচা বিছানো সৈকতে সাগরের আছড়েপড়া ঢেউ আর শরীর ও মনকে দোলা দেয়া প্রাকৃতিক নির্মল হাওয়া - এই সবকিছুর সমন্বয় যদি একটা উপজেলাতেই পাওয়া যায় তাহলে কেমন হয়? হ্যাঁ, আজকে সেই গল্পটিই বলবো। লিখব চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সৌন্দর্যগাঁথা।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বেড়ানো হয়েছে আগেই। কিন্তু সীতাকুণ্ড যাওয়া হয়নি কখনোই। পর্বতারোহী ও পর্যটকদের কাছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গল্প এত শুনেছি, ছবি ও ভিডিওতে এত দেখেছি যে বহু আগে থেকেই আগ্রহ ছিল সীতাকুণ্ড ভ্রমণের। কিন্তু সময় ও সুযোগ হচ্ছিল না কিছুতেই। অবশেষে সেই সুযোগ হলো গত ২৫শে অগাস্ট। সিলেটের একটা জনপ্রিয় ট্রাভেল গ্রুপের সঙ্গী হয়েছিলাম আমি। সাথে ছিলেন বন্ধুবর জাকারিয়া কবির, যিনি একাধারে ব্যাংকার ও ভ্রমণপ্রেমীও।
২৪শে অগাস্ট বৃহস্পতিবার রাত ৮.৪৫মিনিটের ট্রেন ছিল আমাদের। আটটার মধ্যে রাতের খাবার সেরে চলে গেলাম সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে। সেখান থেকে আমরা পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে সীতাকুণ্ড যাব। স্টেশনে যাওয়ার পর আমাদের গ্রুপের সবাই একে একে চলে এলেন। পরিচিতিপর্ব শেষে হোস্টসহ মোট ১৩জনের একটি বহর ট্রেনে উঠে পড়লাম। লাল-সবুজ রঙের চমৎকার এই ট্রেনটির এসি সিটে আমাদের টিকেট কাটা হয়েছিল। এই গরমে একটু আরামে যেতেই এই আয়োজন। ট্রেনে ওঠার আগে গ্রুপ ফটোগ্রাফি করে নিলাম সবাই। একদম যথাসময়েই ২নাম্বার প্ল্যাটফর্ম থেকে আমাদের ট্রেনটি ছেড়ে দিলো চট্টগ্রামের উদ্দেশে।
ট্রেন জার্নি বরাবরই আরামদায়ক। কারণ যানজট নেই, এবড়োখেবড়ো রাস্তা নেই, পর্যাপ্ত খাবার, পানি ও ওয়াশরুমের ব্যবস্থা আছে। ট্রেনে তাই দীর্ঘ জার্নিতেও ক্লান্তি আসে না একটুও। ট্রেনে ওঠে গল্প করতে করতে ছুটে চলেছি। রাত হওয়ায় ট্রেনের জানালা দিয়ে সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাওয়ার উপায় ছিল না। একের পর এক জংশন পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। কুলাউড়া, শমসেরনগর পেরিয়ে শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে শায়েস্তাগঞ্জ, আখাউড়া, কুমিল্লা পেরিয়ে ফেনী। একেকটা জংশনে ট্রেন থামছিল আর আমরা নেমে চা, কফি, চিপস খেয়েছি। তবে ট্রেনের এসিতে ঠাণ্ডা ছিল অনেক। ঘন্টাখানেক চলার পর শীত শীত লাগতে শুরু করল। একটা টি-শার্ট পরে সেই শীত যাচ্ছিল না। অ্যাটেন্ডেন্সকে একটা কম্বল দিতে বললাম। সে জানালো কম্বল শুধু এসি কেবিনে দেয়া হয়। আমাদেরকে দিলে আরও অনেকেই চাইবে, যা দেয়া সম্ভব নয়। অগত্যা সাথে থাকা গামছা দিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করলাম।
ভোর পাঁচটার দিকে ফেনীতে নেমে পড়লাম আমরা। ট্রেন চট্টগ্রামে গেলেও আমরা ফেনী থেকে বাসে সীতাকুণ্ড যাব, তাই নেমে গেলাম। সীতাকুণ্ড জংশনে লোকাল ও মেইল ট্রেন থামলেও আন্তঃনগর থামে না। তাই ফেনী থেকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত। স্টেশন থেকে বেরিয়ে সিএনজি নিয়ে ফেনীর মহিপালে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে বাসের টিকেট কাটলাম, সকাল ছয়টায় বাস ছাড়বে। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে রং চা খেয়ে নিলাম শরীরটাকে চাঙা করতে। ছয়টা দশে বাস ছাড়ল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে, চারলেন রাস্তার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ছুটে চললাম সীতাকুণ্ডের পথে। সাড়ে সাতটায় পৌঁছে গেলাম সীতাকুণ্ড বাজারে। সিদ্ধান্ত হলো সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে, নাশতা খেয়ে রওনা দেব চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে। যেই কথা সেই কাজ। ভোজ রেস্টুরেন্ট নামক হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হলাম, পালটে নিলাম কাপড়ও। তারপর নাশতা খেলাম। বেশিরভাগ রুটি, সবজি খেলেও আমি আর জাকারিয়া ভাই গরম ভুনা খিচুড়ি, ডিম আর চিকেন খেলাম। পাহাড়ে ট্রেকিং করতে হবে, শরীরে এনার্জি দরকার। যাই হোক, খেয়েদেয়ে সিএনজি রিজার্ভ করে নেয়া হলো সারাদিনের জন্য। তিনটি সিএনজি আজ সারাদিন আমাদেরকে নিয়ে ঘুরবে, যাবে কাঙ্ক্ষিত স্পটগুলোতে। শুরুতেই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যাওয়ার প্ল্যান। তাই সেখানেই গেলাম।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পদযাত্রার কাছে গিয়ে আমাদের ব্যাগগুলো সিএনজিতে রেখে নেমে পড়লাম। পাশের দোকান থেকে লাঠি কিনে নিলাম। পাহাড় ট্রেকিংয়ে লাঠি খুবই উপকারী ও কার্যকর। লাঠি ৩০টাকা করে। ফেরার সময় লাঠি ফেরত দিয়ে দিলে ২০টাকা পাওয়া যাবে। লাঠি কিনে, পানি সাথে নিয়ে রওনা হলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১৫২ফুট উচ্চতার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে।
চন্দ্রনাথ পাহাড়
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার জন্য দুটো রাস্তা আছে। একটা ডানদিকে সিঁড়ির রাস্তা, অপরটি বাঁদিকে প্রাকৃতিক রাস্তা। সিঁড়ির রাস্তার চেয়ে প্রাকৃতিক রাস্তা দিয়ে ওপরে ওঠা তুলনামূলক কম কষ্টের, আবার নামার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামা বেশি নিরাপদ। আমরা বাঁ দিকের রাস্তাটিই ধরলাম ওঠার জন্য। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে একের পর এক ধাপ অতিক্রম করছিলাম, আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কিন্তু মিনিটবিশেক চলার পর দেখলাম পা আর চলছে না, বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। বারবার পানি খাচ্ছি, তবু চলতে কষ্ট হচ্ছিল। দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ততার কারণে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠার কষ্ট বেড়ে যায় অনেক। তবে আশার কথা হলো বিভিন্ন পয়েন্টে দোকান আছে স্থানীয়দের। সেগুলোতে লেবুর শরবত, কোমল পানীয়, স্যালাইন, পানি, ডাব, পাহাড়ি নানা ফল কিনতে পাওয়া যায়। যাত্রাপথে রেস্ট নিয়ে নিয়ে সেগুলোর টেস্ট নেয়া ভালোই লাগে। ঘেমে টেমে একাকার হয়েও আমরা ধৈর্য ধরে উঠছিলাম একের পর এক ধাপ। পথিমধ্যে দেখলাম অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আর উঠতেই পারছে না। কিন্তু আমরা থেমে যাইনি। কষ্ট হচ্ছিল অনেক, তবু চলছি তো চলছি।প্রায় ১-১.৫ ঘণ্টা ট্রেকিং করার পর দেখা মিলল শ্রী শ্রী বিরূপাক্ষ মন্দিরের। জানা যায় প্রতিবছর এই মন্দিরে শিবরাত্রি তথা শিবচতুর্দশী তিথিতে বিশেষ পূজা হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডে বিশাল মেলা হয়। চন্দ্রনাথ পাহাড় ও সীতাকুণ্ডের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর বাংলা ফাল্গুন মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) বড় ধরনের একটি মেলার আয়োজন করে থাকেন। যেটি শিবচতুদর্শী মেলা নামে পরিচিত। এই মেলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সাধু এবং নারী-পুরুষ যোগদান করে থাকেন।
বিরূপাক্ষ মন্দিরে এসে অনেকে আর ওপরে না ওঠে নেমে যেতে শুরু করেন। অথচ সেখান থেকে চন্দ্রনাথের চূড়া মাত্র ১৫০ফুট ওপরে। যদিও সেই রাস্তার প্রায় পুরোটায় খাড়া। সেটা দেখেই হয়তো অনেকে আর ওঠেন না। কিন্তু আমরা এতদূর এসে পুরোটা দেখেই নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিরূপাক্ষ মন্দিরের আশপাশে কিছু ছবি তুলে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিলাম চন্দ্রনাথের চূড়ার দিকে। আমাদের গ্রুপের অনেকেই নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও আমরা উঠতে শুরু করলাম। খাড়া পথটা বেয়ে উঠতে কষ্ট হলেও চারপাশের সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর শাদা মেঘের সারি দেখে মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। প্রকৃতি দেখতে দেখতে অবশেষে পৌঁছে গেলাম চন্দ্রনাথের চূড়ায়। সেখানকার মুগ্ধ করা রূপ দেখে ট্রেকিংয়ের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথ মন্দিরের পাশে বিভিন্ন ভিউ পয়েন্ট। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মন্দিরে ঢুকে প্রার্থনা করছেন অনেকে। আমরা প্রকৃতি দেখা আর ছবি তোলায় মনোনিবেশ করলাম।
পাহাড় থেকে নেমে লাঠিগুলো ফিরিয়ে দিলাম, সেই টাকা দিয়ে কোমলপানীয় কিনে নিলাম। এরপর উঠলাম আমাদের রেখে যাওয়া সিএনজিতে। এবার গন্তব্য সহস্রধারা-২ ঝর্না। পাহাড় বেয়ে ওঠার ক্লান্তি নিবারণ করবো ঝর্নার শীতল জলে গোসল করে।
পাঁচ মিনিট পরেই আমাদেরকে নামিয়ে দিলো ঝর্নার কাছে। লেক থেকে ঝর্না পর্যন্ত আপডাউন ভাড়া জনপ্রতি ৮০টাকা দিতে হয়, যা দূরত্বের তুলনায় কিছুটা বেশিই মনে হলো।
ঝর্নায় আরও অনেকে এসেছেন। যদিও পানি কিছুটা কম ছিল। বৃষ্টির হার এবার সীতাকুণ্ডে কম থাকায় ঝর্নাগুলোতে পানি অনেক কম। তবে সহস্রধারা-২ ঝর্নায় মোটামুটি পানি থাকায় আমরা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরটাকে জুড়িয়ে নিতে সোজা নেমে গেলাম জলে। ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক শাওয়ারে ভিজলাম অনেকক্ষণ। শরীর হিম করা শীতল জলে পাহাড়ে আরোহনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো নিমিষেই। গোসল সেরে নিলাম সবাই।
গুলিয়াখালি সমুদ্রসৈকত
চারটার দিকে খাওয়াদাওয়া শেষ করে গুলিয়াখালি সমুদ্রসৈকতের দিকে হাঁটা দিলাম। গুলিয়াখালি সমুদ্রসৈকত স্থানীয়দের কাছে 'মুরাদপুর বিচ' নামেও পরিচিত। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে এটি মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বিকেলের সময়টা কাটাতে এখানে রোজ হাজারও পর্যটক যান। একদিকে দিগন্ত-বিস্তৃত সমুদ্রের জলরাশি, অন্যদিকে কেওড়া বন এই সৈকতকে করেছে অনন্য। সৈকতের একপাশে ঘন গাছপালা যখন পানিতে ডুবে থাকে, মনে হয় এটি একটি সামুদ্রিক সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলাবন। এরপর আছে সবুজ ঘাসের গালিচা। বালির সৈকত আমরা সবখানেই দেখি। এখানে বালির ওপর ঘাসের গালিচা যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে। ঘাসের মাঝে মাঝে ছোট ছোট নালা, যেগুলো বর্ষায় পানিতে ভরে ওঠে। সাগরের বিশাল গর্জন না থাকলেও বিশুদ্ধ বাতাস হৃদয়কে প্রশান্ত করে দেয় সহজেই। চাইলে জেলেদের বোটে করে সমুদ্রে ঘুরেও আসা যায়। প্রাপ্তিসাপেক্ষে জেলেদের সাথে কথা বলে যাওয়া যায়। জলে পা না ভিজিয়েও ঘাসের বিছানায় বসে মনটাকে উদাস করে পুরো বিকেলটা কাটিয়ে ফেরা যায়। আমরাও সেটাই করেছি। একটি স্নিগ্ধ, সুন্দর বিকেল কাটিয়ে গোধূলিবেলায় ধরলাম ফেরার পথ। তখনও অনেকে সৈকতে যাচ্ছিল, অনেকে ফিরছিলও।
সীতাকুণ্ড বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের সহস্রধারা-২ লেকটি অসাধারণ। এখানে কায়াকিংও করার ব্যবস্থা আছে। ছবিঃ লেখক |
অতঃপর ফেরা
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সিএনজিতে উঠে বসলাম। রাত পৌনে দশটায় আমাদের ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করবে। সীতাকুণ্ড থেকে বাসে চট্টগ্রাম ফিরতে সময় বেশি লাগবে, তার ওপর জ্যাম ট্যাম থাকতে পারে। সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ড জংশন থেকে মেইল ট্রেন পাওয়া যায়। ট্রেনে চট্টগ্রাম আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিএনজি আমাদেরকে সীতাকুণ্ড জংশনে নামিয়ে দিয়ে গেলো। ১০মিনিটের মধ্যেই ট্রেন চলে এলো। বিভিন্ন বগিতে উঠতে হলো আমাদের, যেহেতু প্রচুর ভিড় থাকে। সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে এলাম। চট্টগ্রামের কাছাকাছি এসে সিট পেলাম, শেষ মিনিটদশেক বসে এলাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করলাম।চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে বের হলাম। রিকশায় রাতের শহরটা একটু ঘুরে ঘুরে রেস্টুরেন্ট খুঁজতে থাকলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেই একটা রেস্টুরেন্ট পেলাম। সেটাতে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তান্দুরি রুটি, বিফ কারি, চিকেন কারি আর মুগডাল দিয়ে সারলাম খাওয়া। খেয়েদেয়ে রিকশা নিয়ে আবার স্টেশনে চলে এলাম। স্টেশনের ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে আড্ডা দিলাম।
ট্রেনও চলে এসেছে প্ল্যাটফর্মে। সবাই একে একে উঠে পড়লাম। শোভন চেয়ারে আমাদের সিট ছিল। ট্রেন ছাড়ল একদম অনটাইমে, রাত ৯.৪৫মিনিটেই। রেল পুলিশ ও অ্যাটেন্ডেন্স এসে বারবার মোবাইল সাবধানে চালাতে নির্দেশ দিলো আমাদেরকে, বিশেষ করে যারা জানালার কাছে বসেছেন। কারণ প্রায়ই মোবাইল ছিনতাই হয় ট্রেনে।
আগের রাত নির্ঘুম ছিলাম, তার ওপর সারাদিনের ক্লান্তি, সবাই ট্রেনে ঘুমিয়ে গেলো। আমি যেহেতু ট্রেনে, বাসে খুবই কম ঘুমুতে পারি, আমার ঘুম আসছিল না। যদিও ঘুম লাগে একটু, আবার ভেঙে যায় কিছুক্ষণ পরেই। এভাবেই চলছিল। নির্মিতব্য একটা স্টেশনে একবার ক্রসিংয়ের জন্য অনেকক্ষণ থামল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নেমে হাঁটলাম একটু। আবার ট্রেন ছাড়ল। কুমিল্লা স্টেশনে এসে ঘটল দুর্ঘটনা। আমার বামের সারিতে একজন নারী জানালার কাছে বসে মোবাইল চালাচ্ছিলেন। মাত্র সামান্য চোখটা লেগে এসেছে। রাত তখন ২টার বেশি। হঠাৎ সেই নারীর চিৎকার। ঘুম ভেঙে গেলো। দেখি তার হাত রক্তাক্ত। মোবাইল নিয়ে গেছে। সম্ভবত ব্লেড দিয়ে হাতে টান দিয়েছে। ট্রেনও চলতে শুরু করেছে। কারও কিছু করার ছিল না। সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া ঐ নারীটিকে আর কিছু বলার ছিল না। একটু অসাবধানতার জন্য মোবাইলটা চলে গেলো। থানায় জিডি করার পরামর্শ দিলাম।
আখাউড়া স্টেশনে এসে ট্রেনের ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলো, সব লাইট অফ হয়ে গেলো। ঘন্টাদেড়েক সেখানেই ছিলাম থেমে, অন্ধকার ট্রেনে। স্টেশনে না হয়ে অন্যকোথাও হলে বিপদে পড়তাম। ইঞ্জিন ঠিক করে চললাম আবারও। চারটায় পৌঁছানোর কথা থাকলেও শ্রীমঙ্গল স্টেশনে এসে পৌঁছলাম সকাল সাড়ে ছয়টায়। আমি সেখানেই নেমে গেলাম, অন্যরা সিলেটে নামবে। প্রচণ্ড গরমে যাত্রা শুরু করে একটি পুরো দিন প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটিয়ে বৃষ্টিস্নাত এক সকালে এসে পৌঁছলাম গন্তব্যে। মনটা পড়ে রইল সেই সাগর, পাহাড় আর ঝর্নারাজিতেই।
রেলওয়ে, রেললাইন, কোচ, ইঞ্জিন, বগিগুলো অনেক উন্নত হচ্ছে আমাদের দেশে। কিন্তু আজও রেলে ছিনতাই হয়। প্রায়ই মোবাইল ফোন ছিনতাই হওয়ার খবর দেখি। স্টেশনগুলোতেই সমস্যা হয় বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও জোড়ালো কার্যক্রমই কেবল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। ট্রেনযাত্রা আরামদায়ক, তাই মানুষের কাছে জনপ্রিয়। কিন্তু কিছু সমস্যা দূর করা জরুরি। যেমন প্রতিটি স্টেশনেই একদল হিজড়া উঠবে, টাকা চাইবে মানুষের কাছে। না দিলে প্রায়ই সমস্যায় পড়ে অনেকে। এগুলো শান্তির ট্রেন জার্নিকে অশান্তিময় করে দিতে পারে। সরকারের নজর দেয়া জরুরি।
0 মন্তব্যসমূহ