বাঘিনীদের জয়ে জাগবে কি বাংলার ফুটবল?


"যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথীদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরো নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই

পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।"


সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে জাতীয় দলের তারকা ফুটবলার সানজিদা আক্তারের পোস্টের অংশবিশেষ ছিল এটা। এই পোস্টে যে প্রত্যয় আর লড়াকু মনোভাব ফুটে ওঠেছিল, সেটিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেন আজ বাংলার বাঘিনীরা। অভিনন্দন তাদের!

সাফে পুরুষরা একবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, ২০০৩সালে। সে টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচের, প্রতিটি মিনিট দেখেছি। এরপর তো ফুটবল শুধু তলানিতেই গেছে। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে মাঝে মাঝে সাফল্য এসেছে, পুরুষ-নারী উভয়েরই। কিন্তু জাতীয় দলে সাফল্য বলতে কিচ্ছু নেই। এবার সে ইতিহাস পালটে গেলো। আমাদের নারীরা প্রমাণ করে দিলেন আমরাও পারি! এক্ষেত্রে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। পুরুষ ও নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিততে দেখার ভাগ্য ক'জনের হয়!

এই যে নারীরা আজকে চ্যাম্পিয়ন হলএন, এরা না পান কোনো সুযোগ-সুবিধা, না পান অর্থ, না পান সমাজ-দেশ থেকে সমর্থন। উলটো তাদের ওপর চলে ফতোয়াবাজি। সমাজ থেকে জুটে টিটকারি। পুরুষ তো বটেই, অনেক নারীও তাদের খেলাধুলার ঘোর বিরোধী। অথচ তারাই এখন আমাদের দেশকে, দেশের পতাকাকে উচ্চকিত করলেন। কিন্তু আমরা দেখেছি নারী ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধ হওয়ার জন্য এ দেশে ধর্মান্ধদের মিছিল!

সাফে একক আধিপত্য ছিল ভারতের। আমাদের নারী দল একবারই ফাইনাল খেলেছিল, ২০১৬সালে। হেরেছিল সেখানেও। এর আগে ভারত ছাড়া আর কেউই চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি সাফ ফুটবলে। তার ওপর নারী র‍্যাঙ্কিংয়ে ভারত ৫৮নাম্বারে, নেপাল ১০২নাম্বারে থাকলেও আমরা ছিলাম ১৪৭নাম্বারে।তবু এবার বাংলাদেশ যেভাবে আধিপত্য তৈরি করে, একের পর এক ভালো পারফরম্যান্স দিয়ে জয় করে নিলো সব, তাতে তাদের কৃতিত্বটা দিতেই হবে। তারা এবার কতটা ভালো ছিলেন বোঝার জন্য একটা পরিসংখ্যান যথেষ্ট। পুরো টুর্নামেন্টে ২৩গোল দিয়ে খেয়েছে মাত্র ১টা, তাও ফাইনালে এসে! ফাইনালের আগ পর্যন্ত ক্লিনশিট ছিল তাদের, ভাবা যায়!

এই জয়ের ক্রেডিট অনেকে নেবে, নিতে চাইবে। বোর্ড প্রেসিডেন্ট কাজী সালাউদ্দীন নিজের সাফল্য হিসেবে এটাকে প্রচার করবেন। অথচ বাস্তবতা হলো এই মেয়েরা লোকাল বাসে চড়ে এখনও। তাদের এসি গাড়িতে আনা-নেয়া করা হয় না, তারা নাকি বমি করে ফেলবে এই যুক্তিতে। আর তাদের আয়, সম্মানী এগুলোর কথা বললে তো লজ্জাই পেতে হবে। বিদেশী কোচ নাই, পর্যাপ্ত প্র‍্যাকটিস ফ্যাসিলিটিজ নাই। বাফুফে ছেলেদের জন্য এখন পর্যন্ত একটা জিম করতে পারেনি, নারীদের আর কী ফ্যাসিলিটিজ দেবে? তবু এরা জিতেছে। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন এদের ছোটবেলা থেকে গড়ে তুলেছেন, ওদের একান্ত প্রচেষ্টা আর পরিশ্রমেই এই জয়। বাফুফের ক্রেডিট এখানে সামান্যই

হয়তো এদের বাফুফে এবার বোনাস দেবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করতে পারেন পুরস্কৃতও। কিন্তু এগুলো কোনোটাই ওদের কাজে লাগবে না যদি ঠিকমত পরিচর্যা করা না হয় পরবর্তী সময়গুলোতে। এখন তাদের দুটো জিনিস প্রয়োজন। ভালো কোচিং আর আন্তর্জাতিকমানের ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ। সাথে আর্থিক নিরাপত্তাও। আমার বিশ্বাস এরা বিশ্বকাপও খেলে ফেলতে পারে যদি ছেলেদের ১০ভাগের মাত্র একভাগ সুবিধাও পায়। সেইসাথে পাইপলাইন রেডি করার জন্য এই মেয়েদের বিদেশী কোচের হাতে দিয়ে গোলাম রব্বানী ছোটনকে দেশের নানাপ্রান্তে পাঠিয়ে দিয়ে আরও প্রতিভাবান মেয়েদের তুলে আনার দায়িত্ব দেয়া হোক

ক্রিকেটে আমরা কিছুই জিতিনি। তিনবার ফাইনালে খেললেও একটা এশিয়া কাপ ঘরে আসেনি। কিন্তু সেই ক্রিকেটেই মেয়েরা প্রথমবারেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এশিয়া কাপে, ভারতকে হারিয়ে। এবার ফুটবলেও দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হলাম। ক্রিকেট কিংবা ফুটবল- আমাদের বারবার চ্যাম্পিয়ন করছে মেয়েরাই। অথচ তারা কতটা অবহেলিত! ক্রিকেটে একবার শুনেছিলাম লিগে মেয়েরা দৈনিক ৬০০টাকা সম্মানী পায়। এখন কী অবস্থা জানি না। অথচ পুরুষদের টিকটক ক্রিকেট আর ফুটবল দলের প্লেয়ারদের কত টাকা! জাতীয় ফুটবলাররা লিগ খেলে আয় করেন প্রতি মৌসুমে ৫০লাখ থেকে ১কোটি টাকা। ক্রিকেটাররা তো ম্যাচপ্রতি লাখ লাখ টাকা পান। তাদের আয়ের হিসেব সবাই জানেন

এ দেশে নারীদের কর্মক্ষেত্রে বাধা, পড়ালেখায় বাধা, স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বাধা আর খেলাধুলায় তো রীতিমতো বাধার দেয়াল তৈরি থাকে। তবু মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সকল প্রতিকূলতা জয় করেও। ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত স্কুল কলসিন্দুর থেকে কিংবা পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম পাহাড় থেকে ওঠে আসা নারীরা শত বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে এখন দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসে আছেন। তাদের এই জাগরণে যদি ফুটবলটা নতুন করে জেগে ওঠে তবেই এই জয়ের সার্থকতা। স্যালুট আমাদের নারী ফুটবলারদের!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ