পদ্মাসেতুঃ বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক


'সর্বানাশা পদ্মানদী, তোর কাছে শুধাই, বল আমারে তোর কি রে আর কুল-কিনারা নাই, কুল-কিনারা নাই'। গীতিকবি আব্দুল লতিফের কথা ও সুরে কিংবদন্তি শিল্পী আব্দুল আলিমের কণ্ঠে পদ্মানদী নিয়ে এই আকুতিটাই ঝরে পড়েছিল একসময়। পদ্মানদী সত্যিই সর্বনাশা এক নদীর নাম। যারা পদ্মাপাড়ে বাস করেন, তারাই শুধু জানেন এই নদীটি কতটা ভয়ঙ্কর, কতটা প্রমত্তা, কতটা খরস্রোতা। এই সর্বনাশা নদীটির বুকেই এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা স্বপ্নের সেতু, পদ্মাসেতু।

একটু পেছন ফিরে যাই। ২০০৯সালে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর উদ্যোগ নিয়েছিল প্রমত্তা পদ্মার বুকে একটি সেতু করার। সে উদ্যোগের বাস্তবায়নে বিভিন্ন দাতাসংস্থার দ্বারস্ত হয় বাংলাদেশ। নদীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে অনেক দাতাগোষ্ঠী অর্থায়ন করতে আগ্রহী হয়নি তখন। তারা সেতুটাকে অসম্ভব কল্পনা মনে করে। একমাত্র বিশ্বব্যাংক আগ্রহী হয় শেষ পর্যন্ত। সেতুর জন্য চুক্তিও করে। কিন্তু হঠাৎ করেই অভিযোগ ওঠে দুর্নীতির। কোনো টাকা ছাড় না দেয়া সত্ত্বেও, সেতুর কোনো টেন্ডার না হওয়ার পরও বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অযৌক্তিক অভিযোগ তুলে পদ্মাসেতু থেকে সরে যায়। তৎকালীন বিশ্বব্যাংক প্রধান তার শেষ কর্মদিবসে ঋণ বাতিল করে যান। বিশ্বব্যাংকের কথায় দুর্নীতি না করা সত্ত্বেও তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিবকে সরিয়ে দেয়া হয়। তবু তাদের মন গলে না, তারা সরে যায়।

বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়ে সর্বানাশা পদ্মানদীর এক গভীর ঝড়ে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে সরকার তখন দিশেহারা। একজন নোবেলজয়ী, একজন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর বিরাট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাদের সর্বস্ব দিয়ে ঋণ আটকে দেন। কিন্তু বাংলাদেশ দমে যায় না। ধ্বংসস্তুপ থেকে ঘুরে দঁড়ানোর ইতিহাস বাংলাদেশের আগেও ছিল। বায়ান্ন, একাত্তর আমাদের সেই ইতিহাসের সাক্ষী দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতির কন্যা শেখ হাসিনা জেদ ধরেন পদ্মাসেতু হবে নিজের টাকায়, দেশের টাকায়। চারদিকে হাসিহাসি আর বিদ্রুপের বন্যা শুরু হয়। পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয় বাঁশ দিয়ে পদ্মাসেতু বানানোর বিদ্রুপাত্মক কার্টুনও। দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ আর সুশীল সমাজ তখন এটা অসম্ভব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। নিজের টাকায় পদ্মাসেতু বানানোর অবাস্তব কল্পনা থেকে সরে আসতে সরকারকে আহবান করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী তো তার প্রতিটি বক্তব্যেই বলেন 'সরকার পদ্মাসেতু করতে পারবে না।'

কিন্তু যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে তিনি শুরু করেন কাজ। একঝাঁক উদ্যমী মানুষদের নিয়ে স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু করেন। দেশের মানুষদের এগিয়ে আসতে আহবান জানান। সবাই এগিয়ে আসে। সিলেটের কৃতি সন্তান প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও প্রয়াত প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী থাকেন পুরো প্রকল্পের অগ্রভাগে। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং ও চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি দুটোকে যথাক্রমে নদীশাসন ও মূল ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রতি বছর বাজেট থেকে একটা বড় অঙ্কের অর্থ দেয়া হয় পদ্মাসেতুর জন্য। কাজ শুরু হয় স্বপ্নের সেতুর।

এরমধ্যেই কানাডার আদালতে প্রমাণ হয় পদ্মাসেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। পুরোটাই ছিল ষড়যন্ত্র। বিশ্বব্যাংক অনেকটা নাকে খত দিয়ে প্রকল্পে ফিরতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেয়, অন্য প্রকল্পে অর্থায়ন করতে অনুরোধ জানায়। কারণ এর অনেক আগেই পদ্মাসেতুর কাজ শুরু হয়ে গেছে।

বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় পদ্মার দুইপ্রান্ত মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরিয়তপুরের জাজিরায়। সেই যজ্ঞে অংশ নেন হাজার হাজার শ্রমিক। 'আনপ্রেডিক্টেবল পদ্মার' নানা জটিলতা কাটিয়ে পাইলিং শুরু হয়, পিলার বসে একের পর এক। একদিন সেই পিলারে বসে প্রথম স্প্যান। একে একে সবগুলো স্প্যানই বসে যায়। স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় বাংলাদেশ। ১০ডিসেম্বর ২০২০সালে ৪১তম স্প্যানটি বসে যাওয়ার পরই পদ্মাসেতুর মূল ও জটিল কাজটি মূলত শেষ হয়ে যায়। এরপর বাকি কাজগুলো দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে। আজ ২৫শে জুন এসে সেই কাজগুলো শেষ করে উদ্বোধন হলো স্বপ্নের সেই সেতুর। এই দীর্ঘ স্বপ্নযাত্রার সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। পুরো পৃথিবী চেয়ে চেয়ে দেখল বাংলাদেশ কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, নিজেদের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে।

পদ্মাসেতু নিয়ে এখনও অনেকে নানা বিদ্রুপ করছে। এরা শুধু রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের একটা বিরাট অর্জনকে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। এটা নিজেদের মানসিক দৈন্যতা ছাড়া কিছুই নয়। এই সেতু শেখ হাসিনার প্রতিজ্ঞার ফসল হতে পারে, কিন্তু এটি তো আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই সেতু আমাদের নিজেদের টাকায় হয়েছে। এটা নিয়ে গর্ব করা উচিত প্রতিটি বঙালির। দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই গৌরবের সমান অংশীদার।

যে নোবেল লরিয়েট ব্যক্তিস্বার্থে পদ্মাসেতু নিয়ে মহা-ষড়যন্ত্র করেছিলেন, এই সেতুটি তারও সেতু। যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সেতু নিয়ে ক্রমাগত বিদ্রুপ করতেন, এই সেতুটি তারও। যে লোকেরা পদ্মাসেতুর প্রতিটি সংবাদের নিচে হাহা রিয়্যাক্ট আর বিদ্রুপের বন্যা বইয়ে দিত, এই সেতুটি তাদেরও। যে মিডিয়াগুলো পদ্মাসেতুর দুর্নীতির বায়োবীয় তথ্য প্রকাশ করেছিল, এই সেতুটি তাদেরও। যেসব বুদ্ধিজীবী দেশী অর্থায়নে পদ্মাসেতুকে অসম্ভব বলে আখ্যায়িত করেছিলেন এই সেতুটি তাদেরও। একটা সেতু কীভাবে একটা জাতিকে এক সুতোয় বেধে দিয়েছে, একটা জাতির স্বপ্নের সীমানায় বাস্তবতাকে মিলিয়ে দিয়েছে এটা ভাবলে এখন আর অসম্ভব লাগে না কিছুই। মনে হয় পৃথিবীতে সবই সম্ভব।

দক্ষিণবঙ্গের ২১টা জেলাকে রাজধানী তথা দেশের নানাপ্রান্তের সাথে সংযোগ ঘটিয়েছে পদ্মাসেতু। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কতটা দুর্ভোগে ছিল একটা সেতুর কারণে সেটা জীবনে একবার হলেও যারা প্রমত্তা পদ্মা পাড়িয়ে দিয়েছেন তারাই শুধু জানেন। যারা ঘন্টার পর ঘন্টা ফেরিতে আটকে, যানজটে নাকাল হয়ে তিন ঘন্টার রাস্তা ১৩ঘন্টায় পাড়ি দিতেন, যারা রোগী নিয়ে ফেরিঘাটে আটকা পড়ে রোগীর অবস্থা নাজেহাল হওয়াটা চেয়ে চেয়ে দেখতেন, যাদের স্বজন ফেরির অপেক্ষায় এপারে আসতে গিয়ে মারা যেতেন তাদের কাছে এই সেতুটির চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। আমরা রাজনৈতিক ও মানসিক দৈন্যতার কারণে দূর থেকে সেতু নিয়ে, টোল নিয়ে ট্রল করতে পারি, কিন্তু তাদের কষ্টটা অনুধাবন করতে পারবো না কখনোই। পদ্মাসেতু নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাসটাই বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।

অনেকে পদ্মানদীর খরচ নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। কিলোমিটার হিসেব করে অন্য সেতুর সাথে তুলনা দিয়ে বলছেন এখানে এত টাকা খরচ হলো কীভাবে। হয়তো তারা রাজনৈতিক স্বার্থে অন্ধ হয়ে গেছেন অথবা আদতেই তারা অন্ধ। তারা বোধহয় জানে না, অ্যামাজন নদীর পর পদ্মানদী দুনিয়ার সবচেয়ে খরস্রোতা নদী। এই নদীর তলদেশ কখনো পলিময়, কখনো গভীর। অননুমেয় এই নদীর ওপর সেতু নির্মাণটাই যেখানে অসম্ভব বলে অনেকে আখ্যায়িত করেছিল, সেখানে কী পরিমাণ কারিগরি ব্যয় হতে পারে অনেকের ধারণা নেই। এই সেতুর একেকটি পাইলের গভীরতা, পিলারগুলো যে পরিমাণ নিচে স্থাপন করা হয়েছে তা শুধু সংশ্লিষ্টরাই জানেন। আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যার সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে এই সেতুতে। নদীশাসনের কারণেও সেতুর খরচ বেড়েছে। পদ্মা শুধু একটা সেতু নয়, একটা বহুমুখী প্রকল্প। দু'পাশের সংযোগ সড়ক, অনেক ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমিদাতাদের স্থায়ী পুনর্বাসন, নদীশাসন ও মূলসেতুকে নিয়েই খরচের হিসেবটা আসে। মূল সেতুর খরচ বারো হাজার কোটি টাকার বেশি হলেও পুরো প্রকল্পের খরচটা ত্রিশ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়েছে। বিশেষজ্ঞ না হলে আমাদের পক্ষে এই খরচ নিয়ে মতামত দেয়া সম্ভব না। যদিও বাংলাদেশে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।

পদ্মাসেতুর কাজ শেষ, উদ্বোধনও। এখনও রেলসেতুর কাজ বাকি যদিও, আশা করি দ্রুত সেটা শেষ হবে। পদ্মাসেতু দক্ষিণবঙ্গবাসীর অর্থনীতিকে বদলে দেবে, যার প্রভাব পড়বে পুরো দেশের ওপর। জিডিপি বাড়বে সারাদেশের। বাড়বে মাথাপিছু আয়। সব ছাপিয়ে মানুষের শত শত বছরের দুর্ভোগ আর লাঞ্চনার অবসান হবে এটাই সবেচেয়ে আনন্দের। আমাদের হাজারও সমস্যা থাকতে পারে, সেজন্য আমরা সমালোচনা করবো সরকারের। কিন্তু এমন একটা অর্জনে আনন্দিত হতে না পারলে বুঝে নিতে হবে আমাদের আসলে আনন্দিত হওয়ার ক্ষমতাটাই হারিয়ে গেছে।

পদ্মাসেতু কতটা গৌরবের তা বোঝা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন এটার প্রশংসা করে। স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যখন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে পদ্মাসেতুর জন্য অভিনন্দন জানান, তখন বোঝা যায় এই সেতুটি বাংলাদেশের মর্যাদা কতটা বাড়িয়েছে, কীভাবে আমাদের সক্ষমতাকে জানান দিয়েছে বিশ্বের সামনে। বিশ্বের কেউ কিংবা কোনো ঋণদাতা সংস্থা অদূর ভবিষ্যতে আর বাংলাদেশকে অবহেলা করতে পারবে না, বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। পদ্মাসেতুর সার্থকতাটা আসলে এখানেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ