সবুজে ঘেরা শমসেরনগর

প্রকৃতি এ দেশের আনাচেকানাচে কত যে সৌন্দর্য লুকিয়ে রেখেছে তার কয়টাই বা আমরা জানি। আমরা মূলত ঘুরতে যাই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামে। এর বাইরে সিলেট বিভাগের অতিপরিচিত কিছু জায়গাতে আমাদের বিচরণ। কিন্তু এর বাইরেও দেশের অপ্রকাশিত অনেক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদেরকে মুগ্ধ করবে, আমাদের চোখের তৃষ্ণাকে নিবারণ করবে দারুণভাবে। এমনই একটা জায়গা হলো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর। সেদিন ঘুরতে গিয়েছিলাম সেখানেই। ফিরেছি একরাশ মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে। আজ সেই গল্পটাই বলবো।

১০ফেব্রুয়ারি সকাল সাতটা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবস্থিত সিলেট বিভাগের প্রাণকেন্দ্রখ্যাত শেরপুর থেকে আমরা তিনজন ভ্রমণপ্রেমী মানুষ রওনা দিলাম মৌলভীবাজারের দিকে। উদ্দেশ্য কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর। মৌলভীবাজার জেলার বেশিরভাগ ভ্রমণ গন্তব্যে বিভিন্ন সময় ভ্রমণ করা হলেও শমসেরনগরে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাইনি কখনো। দুয়েকবার গেলেও কাজে গিয়েছি, ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ব্যাংকার বন্ধুবর জাকারিয়া কবিরের বাড়ি শামসেরনগরে। তিনি কয়েকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তার এলাকায় যাওয়ার জন্য। গত বছরতিনেক শুধু কথাই দিয়েছি, যাওয়া হয়নি আর। আসলে শমসেরনগরর সাধারণত পর্যটক খুব একটা যায় না। সবাই শ্রীমঙ্গল ও মাধবকুণ্ডে যেতে চায়। কিন্তু আমি নতুন জায়গা অনুসন্ধান করতে ভালোবাসি বলে আমার আগ্রহ ছিল বরাবরই। শুধু সময় আর সুযোগ হচ্ছিল না। এবার একটু ফুরসত পেতেই বেরিয়ে পড়লাম। সাথে ছিলেন বন্ধু নোমান সাদী ও ট্রাভেলার জাকির হোসেন।

শেরপুর মুনলাইট রেস্টুরেন্টে সকালে চিকেন ভুনা খিচুড়ি দিয়ে নাশতা সেরে, গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ভাড়া করা একটি প্রাইভেটকারে করে রওয়ানা দিলাম। আটটার মধ্যেই মৌলভীবাজার পৌঁছে গেলাম। সেখানে গিয়ে গাড়িতে সিএনজি লোড করতে হলো। এরপর শমসেরনগর রোড ধরে চলতে শুরু করলাম। মৌলভীবাজার-শমসেরনগর সড়কটি খুব একটা ভালো না। বিভিন্ন জায়গায় ভাঙাচোরা, অনেক জায়গায় গর্ত, কোথাও কোথাও কাজও চলমান। তাই গাড়ি ভালোভাবে চালানো যাচ্ছিল না। অনেক ধীরগতিতে চালিয়েও সকাল নয়টার দিকে পৌঁছে গেলাম শমসেরনগর বাজারে। সেখানেই অপেক্ষা করছিলেন জাকারিয়া ভাই। ওনাকে গাড়িতে নিয়ে নিলাম আমাদের সাথে। আজ আমরা ওনারই অতিথি। যেহেতু এলাকাটা তার চেনা, তার শৈশব-কৈশোর এখানেই কেটেছে, তার নির্দেশনাতেই তাই আজকে ঘোরাঘুরি চলবে সারাদিন।

আজকে দিনটা প্রচণ্ড কুয়াশাঘেরা, ঠাণ্ডাও প্রচুর। এত বেলা হলেও কোথাও রোদের সামান্যতম দেখাও নেই। সূর্যমামা কোথাও একটু উঁকিও দিচ্ছে না। কনকনে শীতে সবুজের সমারোহে আমরা প্রবেশ করলাম একটি চা-বাগানের রাস্তায়। যেখানে ছোটবড় অনেক টিলার মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। চারপাশে সবুজ চায়ের গাছ, মাঝখান দিয়ে রাস্তা। একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। আমাদের উদ্দেশ্য শমসেরনগর চা বাগানের মধ্যে একটা অচেনা, অদেখা লেইকের সৌন্দর্যে অবগাহন করা।

বিসলার বান বা ক্যামেলিয়া লেইক। যার পরতে পরতে অবারিত সৌন্দর্যের হাতছানি। ছবিঃ লেখক



ক্যামেলিয়া লেইক

টিলা কেটে মাঝখান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। রাস্তার পাশে সবুজ চায়ের পাতাগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা এগিয়ে চলেছি ডানকান ব্রাদার্সের শমসেরনগর চা বাগানের ভেতর দিয়ে। উদ্দেশ্য 'বিসলার বান' বা ক্যামেলিয়া লেইক। এটিকে ক্যামেলিয়া বাঁধও বলা হয়। তবে এর মূল নাম ক্যামেলিয়া লেইক। যেহেতু এখানে আমরা নতুন, তাই জিজ্ঞেস করে করে যাচ্ছিলাম। চা শ্রমিক ও বাগানের কিছু কর্মচারী আন্তরিকতার সাথে আমাদের ক্যামেলিয়া লেইকে নিয়ে গেলো। চা বাগানের ভেতরে এত চমৎকার লেইক না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। লেইকের স্বচ্ছ জল আর দর্শনার্থীদের জন্য লেইকের ওপর পাকা স্থাপনা, লেইকে নামার জন্য ঘাট, লেইকের পাড়ে বসার জন্য ছাউনি ও বেঞ্চগুলো দেখে দারুণ লাগল। জলে নামার প্রস্তুতি ছিল না, তার ওপর কনকনে ঠাণ্ডা। বাগানের ভেতরে তো আরও বেশি ঠাণ্ডা। তাই জলে নামার সাহস করলাম না। সারাদিন বসে থাকার মতো একটি লেইক। কিন্তু আজকে সময় কম। ঘন্টাখানেক লেইকে কাটিয়ে সুন্দর সহযোগিতার জন্য বাগানের শ্রমিকদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে এলাম।

ক্যামেলিয়া হাসপাতালের আঙিনায় দারুণ কিছু ফুলের বাগান আছে। ছবিঃ লেখক



ক্যামেলিয়া হাসপাতাল

চা বাগানের শ্রমিক ও আশপাশের বাসিন্দাদের চিকিৎসার জন্য ১৯৯৪সালে ডানকান ব্রাদার্স ফাউন্ডেশন ক্যামেলিয়া হাসপাতাল নামে একটি চমৎকার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই হাসপাতাল এলাকার সৌন্দর্য দারুণ মুগ্ধ করার মতো।
হাসপাতালটির নামকরণ করা হয়েছে ডানকান ব্রাদার্সের মাদার কোম্পানি ক্যামেলিয়া পিএলসির নামানুসারে। ক্যামেলিয়া পিএলসি লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীব্যাপী তাদের কর্মীসংখ্যা ৭৫হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশে তাদের কর্মী সংখ্যা ২০হাজারের মতো। সেই হাসপাতাল দেখতেই ক্যামেলিয়া লেইক থেকে বের হয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। থামলাম গিয়ে হাসপাতালের গেটের সামনে। গেটে গিয়ে দেখি নোটিশ ঝুলছে- 'করোনার জন্য দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ ও কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা ও ভিডিও করা নিষেধ'। কিন্তু আমরাও দমে যাবার পাত্র নই। সিকিউরিটি গার্ডকে বলে ভেতরে গেলাম অনুমতি নিতে। আন্তরিকভাবে বলতেই অনুমতি পেয়ে গেলাম। শুধু মূল হাসপাতাল বিল্ডিং বাদে পুরো এলাকার ছবি ও ভিডিও নেয়া যাবে।

হাসপাতাল বিল্ডিং চমৎকারভাবে নির্মিত। চারপাশে সবুজের সমারোহ আর ফুলের বাগান। ভেতরে ডাক্তার, নার্স ও রোগীদের আনাগোনায় মুখর থাকলেও বাইরে অনেকটাই নির্জন। পুষ্পশোভিত, সবুজ ঘাসের গালিচায় আচ্ছাদিত হাসপাতাল এলাকাটি দেখে মনেই হয় না এটি হাসপাতাল। মনে হয় এটিও একটি পর্যটনকেন্দ্র। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এই পরিবেশ এতটাই মুগ্ধ করেছে যে মনেই হয়নি এটা আমাদের দেশে অবস্থিত। একটা বিদেশ বিদেশ অনুভূতি হচ্ছিল সারাক্ষণ। পৌনে একঘন্টা সময় কীভাবে চলে গেলো টেরই পেলাম না। আমাদেরকে সুযোগ দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে।

শমসেরনগর গলফ ক্লাব। টিলা ও সবুজ ঘাসের গালিচায় যেন পুরো মাঠটিই আচ্ছাদিত। ছবিঃ লেখক



শমসেরনগর গলফ ক্লাব

চা অধ্যুষিত শমসেরনগরের পুরো এলাকাটাই যেন চা বাগান। যে রাস্তাতেই উঠি সেটাই মুগ্ধ করে। সেই মুগ্ধতা দেখতে দেখতে এবার চলে গেলাম শমসেরনগর গলফ ক্লাবে। সুন্দর ও বিশালাকার গলফ মাঠটিতে যেন কেউ ঘাসের গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। কয়েকটা টিলার ওপর বসার ছাউনি, গলফের বিভিন্ন নির্দেশনা আর চারপাশে চা বাগান। গলফ মাঠ ও চা বাগানের মাঝখানে বিশাল বটবৃক্ষ চোখে পড়ল। বটগাছের সাথে লাগোয়া কিছু মূর্তি চোখে পড়ল। হয়তো এখানে শ্রমিকেরা পূজো দেয়, তাই মূর্তিগুলো রেখে দিয়েছে। পুরো এলাকাটা ঘুরলাম, তবে অনুমতি নিতে হলো এখানেও। এখানকার দায়িত্বে থাকা লোক নিজেই সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাল আমাদের।

গলফ অভিজাতদের খেলা, সাধারণ লোকজন বুঝে খুবই কম। শুকনো মৌসুমে ঘাসগুলো লালচে হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় তাই গোবর দিয়ে জল দেয়া হচ্ছে যাতে ঘাসগুলো সবুজ হয়। এখন খেলা চলছে না, তাই পুরো গলফ কোর্সটিই খালি। স্থানীয় বাচ্চারা এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে শুধু। কেউ কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, আবার অনেকে ক্রিকেট-ফুটবল খেলছে। এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ জাকারিয়া ভাই বললেন সামনে একটা কাঠের সুন্দর সেতু আছে। সেই সেতু দেখতে তাই চলে গেলাম। শমসেরনগর ও আলীনগর টি এস্টেটকে আলাদা করেছে সেতুটি। 'ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ' নামের সেই সেতুটি দেখে ভালোই লাগল। ছবি তুললাম সেখানেও। এরপর ধরলাম ফেরার পথ। এবার গন্তব্য শমসেরনগর বাজার।

ব্রিটিশ আমলে নির্মিত শমসেরনগর বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালুর দাবি দীর্ঘদিনের। ছবিঃ লেখক



শমসেরনগর বিমানবন্দর

শমসেরনগর ঐতিহাসিক একটি এলাকা। স্থানীয় পর্যায়ে এটি ইউনিয়ন হলেও কমলগঞ্জ উপজেলার সবচেয়ে বড় বাজার বা শহর এটি। দুপুর একটার দিকে বাজারে গেলাম। সেখানকার একটা হোটেলে চা, ডালপুরি খেলাম। এরপর চলে গেলাম শমসেরনগর এয়ারপোর্ট দেখতে। এয়ারপোর্টের রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই একটা স্কুল চোখে পড়ল। বিএএফ শাহীন স্কুল ও কলেজ নামের স্কুলটি স্থানীয় পর্যায়ে সেরা স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পরিবেশ দেখে অবাক হলাম। এত সুন্দর স্কুল অনেক বড় শহরেও দেখা যায় না। করোনার জন্য বন্ধ থাকায় ভেতরে যাওয়া হলো না। এরপর গেলাম শমসেরনগর এয়ারপোর্টের গেটে। সেখানেও করোনার বিধিনিষেধ ও নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রবেশ করা গেলো না। অনুমতি চেয়ে পাওয়া যায়নি। এয়ারফোর্সের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেলো শুধু মেলার সময় ওখানে সাধারণ্যের প্রবেশাধিকার থাকে। নইলে বিশেষ কারণ ছাড়া ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। অগত্যা বাইরে থেকে কিছু ছবি নিয়ে ফিরে এলাম।

উল্লেখ্য, "১৯৪৫সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় অভিযান চালানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার মৌলভীবাজারের শমশেরনগর চা বাগানের ৬২২একর ভূমি অধিগ্রহণ করে একটি বিমানবন্দর গড়ে তোলে। ব্রিটিশ আমলে ওই বিমানবন্দরটি ‘দিলজান্দ বন্দর’ নামেই পরিচিত ছিল। বিমানবন্দরটিতে ৬হাজার ফুট দীর্ঘ ও ৭৫ফুট প্রশস্ত রানওয়ে রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর বিমানবন্দরটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘শমসেরনগর বিমানবন্দর’। সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা থাকায় বিমানবন্দরে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত বিমান ওঠানামা করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বিমানবন্দরটিতে যাত্রীবাহী বিমান ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৯৫ সালে শমসেরনগর বিমানবন্দর থেকে এ্যারোবেঙ্গল এয়ার সার্ভিসের ফ্লাইট চালু করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকায় এ ফ্লাইট সার্ভিসটি যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। ফলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নানা সময়ে এটি চালুর কথা শুনলেও আজও কোনো উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।

এখানে বিমানবাহিনীর রিক্রুটমেন্ট অফিস খোলা হয়েছে। সংস্কার করা হয়েছে রানওয়ের অল্প কিছু অংশও। বিমানবন্দরটিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জাতীয় ক্যাডেট কোর বিমান শাখার সদস্যদের অগ্নিনির্বাপণ, প্রাথমিক চিকিৎসা, রাডার নিরাপত্তা, ফায়ারিংসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিমানবন্দরটি পুনরায় চালুর সকল অবকাঠামো রয়েছে। এটি চালু হলে ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করলে প্রবাসী-অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের পুরো জেলাবাসীই এর সুবিধা পেত।"

অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে শহিদদের স্মৃতি-বিজড়িত শমসেরনগর বধ্যভূমি। ছবিঃ লেখক



শমসেরনগর বধ্যভূমি

এয়ারপোর্টের সীমানা পেরিয়েই একটা বধ্যভূমি আছে। একাত্তরের গণহত্যার শিকার কিছু স্বাধীনতাকামী মানুষের গণকবর দেখতে ও তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে গেলাম। কিন্তু গিয়ে অবাক হলাম খুব। একটা বধ্যভূমিকে চিহ্নিত করে সেটাকে সংরক্ষণ করা হয়েছে, শহিদদের নামের তালিকা টাঙানো হয়েছে, কিন্তু সেখানকার ইতিহাস কোথাও খুঁজে পেলাম না। জানতে পারলাম না এখানে আসলে কী ঘটেছিল, কেন এতগুলো মানুষকে মেরে এখানে জড়ো করা হয়েছিল। গুগল ঘেঁটেও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া গেল না!

অপরিচ্ছন্ন, জঞ্জালঘেরা সংরক্ষিত স্থানটি অনেকদিন পরিস্কার করে না কেউ। ভুল বানানে লেখা নামফলকে যাদের নাম পেলাম তারা হলেন পিযুষ পাল–সোনাপুর গ্রাম , প্রতাপ পাল-সোনাপুর গ্রাম, মোঃ রুস্তম মিয়া–কেছ্লুটি গ্রাম, মোঃ আমজদ আলী-শমশেরনগর বাজার, মোঃ মবশ্বীর আলী-সোনাপুর গ্রাম, আব্দুল হাই–শিংরাউলী গ্রাম, মরহুমা জহুরা হাই-শিংরাউলী গ্রাম, মোতাহির আলী–শিংরাউলী গ্রাম, হাজী সাদ উল্ল্যা-ভাদাইরদেউল গ্রাম, ডাঃ হোসেন আহমদ-ভাদাইরদেউল গ্রাম।

যাদের ত্যাগে, যাদের বুকের তাজা রক্তে, যাদের মহামূল্যবান প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ, স্বাধীনতা তারা এমন অবহেলায় পড়ে আছেন এটা খুব কষ্ট দিলো আমাদেরকে। বিনম্র শ্রদ্ধায় তাদেরকে স্মরণ করে ফেরার পথ ধরলাম।

বিখ্যাত স্পেশাল মালাই চা, স্বাদটা সত্যি চমৎকার! ছবিঃ লেখক


শমসেরনগর বাজার ও মিনি শহর

শমসেরনগর বাজারে ফেরার পথে একটা ফলের বাগানে থামলাম। সেখান থেকে মাত্রই পেড়ে আনা ফ্রেশ কুলবরই কিনলাম বাসার জন্য, খেলাম নিজেরাও। আমাদের পাঁচজনের জন্য মোট দশকেজি বরই গাড়ির ভ্যানে ঢুকিয়ে চলে এলাম শমসেরনগর বাজার তথা মিনি শহরে। এখানে রেললাইন আছে; আছে স্টেশনও। সেই স্টেশনে কিছুটা সময় কাটানোর ইচ্ছে জাগল৷ অনেক পুরোনো স্টেশন। তবে নিয়মিত ট্রেন থামে। ঢাকা-সিলেট রেললাইনের একটি অন্যতম স্টেশন এই শমসেরনগর। স্টেশনের আশপাশে ঘুরলাম কিছুক্ষণ। শুনলাম এই স্টেশনসহ সিলেটের বেশকিছু স্টেশন আধুনিকায়ন করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করি শিগগিরই কাজ শুরু হবে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাজারের ভেতরে একটা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার অফার করলেন জাকারিয়া ভাই। আমরা তিনজন তাকে অনুসরণ করলাম। বাজারের বিভিন্ন গলি ধরে একদম ভেতরের দিকে সেই চা স্টল, নাম- সুজন টি স্টল। নানা ধরনের চা পাওয়া যায়। তার মধ্যে মালাই চা খেতে ইচ্ছে হলো। মালাই চা-ও কয়েক ধরনের। মালাই চা, চকলেট মালাই চা, স্পেশাল মালাই চা ইত্যাদি। সাথে দুধ চা, রং চা, গ্রিন চাসহ অনেক প্রকারের চায়ের সমাহার। আমরা নিলাম স্পেশাল মালাই চা। দাম ত্রিশ টাকা। খেতে বেশ ভালো। অতি সাধারণ একটি দোকান। কিন্তু বেশ পরিচ্ছন্ন। আট বছর ধরে এই দোকান চলছে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকে চা খেতে ছুটে আসে।

চায়ের স্বাদ মুখে নিয়ে এবার জাকারিয়া ভাইয়ের বাসার উদ্দেশে রওনা হলাম। শমসেরনগর এসেছি আর ওনার বাসায় যাব না এটা উনি মেনে নিতে রাজি নন, তাই যেতেই হলো। গিয়ে দেখি দুপুরের খাবারের জন্য এলাহি কাণ্ড করে বসেছেন। নানা পদের আইটেম রান্না করিয়ে উনি রেখে দিয়েছেন আমরা খাব বলে। পেটপুরে খেলাম। রেস্টুরেন্টে খেয়ে এত তৃপ্তি পেতাম না বোধহয়। খালা, ভাবি (জাকারিয়া ভাইয়ের স্ত্রী) এত কষ্ট করে এত সুস্বাদু রান্না করেছেন, এজন্য ওনাদের মন থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, ওনার সদ্যোজাত বাচ্চাকে অনেক আদর জানিয়ে বের হয়ে এলাম।

চোখজুড়ানো সৌন্দর্যের পদ্মছড়া লেইক পর্যটকদের কাছে এখনও সেভাবে পরিচিতি পায়নি এটা বিস্ময়ের। ছবিঃ লেখক



পদ্মছড়া লেইক

বিকেল ঘনিয়ে আসছে। সারাদিনে রোদের দেখা নেই একটুও। তার ওপর শুরু হলো ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। তার মধ্যেই আমরা রওনা হলাম কমলগঞ্জের মাধবপুরে অবস্থিত পদ্মছড়া লেইকের দিকে। আদমপুর, মাধবপুর মূলত মণিপুরী অধ্যুষিত দুটো এলাকা। বাংলাদেশে মণিপুরী নৃগোষ্ঠীর প্রায় সবাই মৌলভীবাজার জেলার বাসিন্দা। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জেই বেশি বাস করেন তারা। মাধবপুর ও আদমপুরে মণিপুরীদের মহারাসলীলা অনেক বিখ্যাত। প্রতি বছর হাজার হাজার লোক সারাদেশ থেকে এই উৎসবে আসেন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুর ইউনিয়নের শিব বাজারে নির্মাণাধীন মণিপুরী ললিতকলা অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষণ সেন্টার, প্রশাসনিক ভবন, গেস্ট হাউজ ও ডর্মিটরি বিল্ডিং রয়েছে। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মনিপুরী সম্প্রদায় জাঁকজমকভাবে রাস উৎসব পালন করে। মণিপুরী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব এই মহারাসলীলা।

শমসেরনগর থেকে ভানুগাছ বাজার অতিক্রম করে আমরা কমলগঞ্জের মাধবপুরের মণিপুরী ললিতকলা অ্যাকাডেমি হয়ে পদ্মছড়া লেইকের দিকে এগোলাম। ভানুগাছ বাজার থেকে দক্ষিণে শহিদ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান সড়ক ধরে পদ্মছড়া ভাষানীগাঁও রোডে গিয়ে পদ্মছড়া চা বাগানের ভেতরে এই পদ্মছড়া লেইক। এটি মাধবপুর চা বাগানের ফাঁড়ি পদ্মছড়া বাগানের ৬নাম্বার সেকশনে অবস্থিত। মাধবপুর লেইক থেকে প্রায় ৪/৫ কিলোমিটার দূরে সবুজে ঘেরা চা বাগানের মাঝখানে বিশাল এই লেইক। বাগানের প্রবেশপথে গাড়ি রেখে হেঁটেই রওনা দিলাম। যদিও গাড়ি নিয়েও যাওয়া যেত, তবু হেঁটে হেঁটেই লেইকের পাড়ে গেলাম। চা বাগানের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা, পাশে মসজিদ, স্কুল, বাসিন্দাদের বাড়িঘর। বিভিন্ন টিলার চূড়ায় অনেক বাড়িঘর দেখলাম। সেগুলো দেখে অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো। দু'পাশে টিলা, মাঝে রাস্তা। কয়েক মিনিট হাঁটতেই পদ্মছড়া লেইক পেয়ে গেলাম। লেইকের চারপাশে পাহাড়ের মতো উঁচু সব টিলা এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। পুরো লেইকটাই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে দেবে যে কোনো সৌন্দর্য-পিপাসুকেও।

ঘুরে ঘুরে লেইক দেখলাম। মূল লেইকের পাশে পুকুরের মতো ছোট একটা লেইকে পদ্মেরও দেখা মিলল। তাতে লেইকের সার্থকতাটাই ফুটে উঠল।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তাই বেশিক্ষণ না থাকলেও লেইকটির প্রতি ভালোলাগা ছিল অবিরাম। লেইকটির কথা এখনও অনেকে জানে না। তাই এটি নিরিবিলি ও ভালো পরিবেশ বিরাজ করছে। সবাই যেতে শুরু করলে কী হবে সেটা আগাম না জানলেও আন্দাজ করা কঠিন নয়। যাই হোক, এখানে আবারও আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করে লেইক থেকে বেরিয়ে এলাম। গাড়িতে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এলো। কনকনে ঠাণ্ডা বেড়ে গেলো অনেক। কিন্তু গাড়িতে সেটা অনুভব করার সুযোগ নেই।

অতঃপর ফেরা

রাতের আঁধারে মাধবপুর থেকে বেরিয়ে শ্রীমঙ্গল রোড ধরলাম আমরা। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মাঝ দিয়ে মসৃণ, পিচঢালা রাস্তায় উঠতেই একটা অপার্থিব সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন হলাম। বনের মাঝখানে এই রাস্তাটি ধরে চলাচল করলে মনেই হয় না দেশে আছি!

শ্রীমঙ্গলে এসে আদি নীলকণ্ঠ চা কেবিনে চা খেতে গেলাম। চমৎকার স্বাদের গ্রিন টি খেয়ে শীতের রাতে দারুণ উষ্ণতা অনুভব করলাম। নীলকণ্ঠ থেকে বেরিয়ে সোজা ফেরার পথ ধরলাম। সারাদিনের এক আনন্দঘেরা, স্মৃতিময় ঘোরাঘুরির পর ঘোরলাগা এক সন্ধ্যায় যার যার গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম। শমসেরনগর অভিযানের এই সুন্দর দিনটা সারাজীবন স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে এটা বলে দেয়াই যায়।


যেভাবে যাবেনঃ ট্রেনে কিংবা বাসে শমসেরনগর যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে শমসেরনগর স্টেশনে নিয়মিত বিভিন্ন অন্তঃনগর ও লোকাল ট্রেন থামে। বাসে যেতে হলে মৌলভীবাজার অথবা শ্রীমঙ্গলে সরাসরি বাসে এসে সেখান থেকে সিএনজি, কার কিংবা মাইক্রোবাস ভাড়া করে পুরো শমসেরনগর ঘুরে দেখা যাবে।

যেখানে থাকবেনঃ শমসেরনগর এয়ারপোর্টের পাশেই সুইস ভ্যালি রিসোর্ট নামে একটা নান্দনিক রিসোর্ট আছে। সেখানে থাকা যাবে। শ্রীমঙ্গলেও চাইলে থাকা যায়। অসংখ্য ছোট, বড়, মাঝারি রিসোর্ট আছে। পাঁচ তারকা মান থেকে একদম সাধারণমানের হোটেলও আছে শ্রীমঙ্গলে। বাজেট অনুযায়ী থাকতে চাইলে শ্রীমঙ্গলেই থাকা উচিত।

যেখানে খাবেনঃ শমসেরনগরে লোকাল অনেক রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে খেতে না চাইলে শ্রীমঙ্গলে পানসী রেস্টুরেন্টসহ বেশকিছু ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। মৌলভীবাজার
হয়ে ফিরলেও সেখানে ভালোমানের প্রচুর রেস্টুরেন্ট আছে। নিজের রুচি অনুযায়ী যে কোনো রেস্টুরেন্টেই খাওয়া যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ