ছোটবেলায় আমাদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল দুটো। বইপড়া ও টিভি দেখা। টিভি বলতে শুধু বিটিভি। আমাদের শৈশবে স্যাটেলাইট টিভি সীমিত আকারে থাকলেও মফস্বলে ছিল না, শহরকেন্দ্রীক ছিল। আমরা তাই বিটিভিই দেখতাম। সেই বিটিভির সুবাদেই প্রথম হুমায়ূন আহমেদকে চেনা। বিশেষ বিশেষ দিবসে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও সিনেমা প্রচার হতো। আমাদের সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে সেগুলো দেখার জন্য বসে থাকতাম। কখনো হাসি, কখনো মন খারাপ, কখনো আবেগের খেয়ায় ভাসিয়ে দিতেন আমাদেরকে যিনি, তার নাম ছিল হুমায়ূন আহমেদ।
তখনও লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাথে পরিচয় হয়নি। জানতাম উনি একজন লেখক। কিন্তু তার নির্মাণে এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলাম যে একজন বইপোকা হয়েও হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ জন্মায়নি। আমরা শৈশব-কৈশোরে তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, দস্যু বনহুর, জাফর ইকবাল স্যারের বইগুলো পড়তাম। একটু বড় হওয়ার পর বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী বইগুলো পড়া শুরু করলাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, মাহমুদুল হক, আবু ইসহাক, জহির রায়হান, শহিদুল জহির, সেলিনা হোসেনদের বই আর ওপারে শরৎ, সুনীল, বিভূতিভূষণ, সমরেশদের বই গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম। কেন যেন হুমায়ূন আহমেদ তখনও পড়া হয়নি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কঠিন কঠিন লেখাগুলোও বুঝে কিংবা না বুঝেও পড়ছিলাম তখন।
হুমায়ূন আহমেদ পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মাল মূলত নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা পড়া শুরুর পর। টুকটাক লেখালেখি শুরু করেছি মাত্র। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে লেখা পাঠাই আর অপেক্ষা করতে থাকি লেখা প্রকাশের। যেহেতু অনেকগুলো পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম সেহেতু কোনটাতে কোন লেখা ছাপা হয়েছে সেটা দেখার জন্য ভোর হলেই পত্রিকা স্টলে ছুটতাম আর একের পর এক পত্রিকা পড়তে থাকতাম। ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হতো আর পত্রিকাগুলোর পাতা ভরে যেত একজন লোকের বইয়ের ছবিতে। যার বই সংগ্রহ করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ত, যিনি একদিন মেলায় গেলে তাকে একনজর দেখা ও অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য লাখ লাখ লোকের সমাগম হতো, যার জন্য মেলায় ভীড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গলদঘর্ম খেতে হতো, তার ছবিতে আর সংবাদে পত্রিকার পাতাগুলোতে থাকত বিশেষ বিশেষ আয়োজন। সেগুলো দেখেই আমার মূলত আগ্রহ জন্মে লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রতি। তার বই মূলত তখনই পড়া শুরু করি।
আমার পড়া হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বই ছিল ময়ূরাক্ষী। পরে জানতে পারি এটা ছিল হিমু সিরিজের প্রথম বই। হিমুকে নিয়ে লেখা প্রায় সবকটি বই পড়ে শেষ করেছিলাম তখন। একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে নিয়ে যেত হিমুর প্রতিটি বই। অনেকদিন সেই ঘোরের রেশ থেকে যেত। এরপর শুরু করি মিসির আলী পড়া। হিমুর সব অযৌক্তিক ও উদ্ভট কর্মকাণ্ডের বিপরীতে মিসির আলীর যুক্তিগুলো ও কঠিন কঠিন রহস্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যাগুলো অনেক স্ট্রং ছিল। যাই হোক, হিমু-মিসির আলীর বাইরে গোটাবিশেক বই হয়তো পড়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদের। বিনোদন হিসেবে সেগুলো আমাকে পূর্ণ বিনোদিত করেছিল বটে, কিন্তু সাহিত্যের সেই গভীরতম বোধের সন্ধান পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। পাঠক হিসেবে তৃপ্তিটাও মিলছিল না। তাই হুমায়ূন পড়া বন্ধ করে দিলাম।
আবারও হুমায়ূন পড়ার আগ্রহ জন্মাল কয়েক বছর পর। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে কোনো একটা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় তাকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করা হলো। সেটা পড়েই তার কিছু 'ভালো' উপন্যাসের সন্ধান পেলাম। এরপর সেগুলো সংগ্রহ করে পড়ে ফেললাম একে একে। নন্দিত নরকে, শঙখনীল কারাগার, গৌরিপুর জংশন, মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া, জোছনা ও জননীর গল্প, বাদশাহ নামদার বইগুলো পড়ে মনে হলো বাংলা সাহিত্যে এত অসাধারণ সংযোজন এই বইগুলো এতদিন পড়িনি কেন! এই বইগুলো পড়ার পর অবশ্য ভালোলাগার চেয়ে হতাশা বেশি কাজ করেছিল যে এত এত বই যিনি লিখেছেন, তার এরকম অসাধারণ বইয়ের সংখ্যা এত কম কেন!
হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়ধারার কথাসাহিত্যিক। মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখের আখ্যান সহজ-সরল ভাষায় মানুষের সামনে তুলে এনেছেন, সাধারণ্যের জীবনের ছবি এঁকেছেন নিজস্ব স্টাইলে। তার গল্প বলার ক্ষমতা অসাধারণ ছিল। তার গল্পগুলো পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নেবেই। কিন্তু তিনি তো জীবনের আরও গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। তাহলে কেন সবসময় হালকা চালেই জীবনকে তুলে আনলেন? জনপ্রিয়তা তো তার ছিলই। সেটাকে কাজে লাগিয়ে সাহিত্যের নিগুঢ় পাঠকসমাজ কিংবা সাহিত্য-সমালোচকদের মন জয় করার মতো বইয়ের সংখ্যা এত কম হলো কেন? জনপ্রিয়তা তো খারাপ কিছু না, সবাই জনপ্রিয় হতে চায়। উন্নত ও সভ্য দেশগুলোতে লেখকরা অনেক জনপ্রিয় হয়। কিন্তু জনপ্রিয়তার জন্য সেসব দেশের লেখকরা নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেন না, মানোত্তীর্ণ লেখা বন্ধ করে দেন না। বরং পাঠকদের মানকেই অনেক উঁচুতে নিয়ে যান তাদের চমৎকার সব লেখার মাধ্যমে। হুমায়ূন আহমেদ সেটা করলে পাঠক হিসেবে আমি সবচেয়ে খুশি হতাম।
হুমায়ূন আহমেদ অনেক পাঠক তৈরি করেছেন। অনেকে আছে পাঠ্যবইয়ের বাইরে কিছু পড়েনি জীবনে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়ে তারা পাঠক হয়েছে। এজন্য বাংলা সাহিত্য তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু সেসব পাঠকের কতভাগ হুমায়ূনকে ছেড়ে বাংলা সাহিত্যের, বিশ্বসাহিত্যের পাঠক হয়েছেন বলা মুশকিল। কারণ আমি অনেককে পেয়েছি তারা হুমায়ূন ছাড়া আর কারও লেখা পড়ে না, পড়তে আগ্রহী হয় না। এমনকি তারা যখন লেখে, হুমায়ূন আহমেদকেই অনুকরণ করে লেখে। তাদের অজান্তেই তাদের লেখায় হুমায়ূন আহমেদ চলে আসেন। আমরা যারা হুমায়ূন দিয়ে পড়া শুরু করিনি তাদের ভাগ্যটা এক্ষেত্রে ভালোই বলা চলে।
হুমায়ূন আহমেদ বিরল প্রতিভা ছিলেন। একাধারে লেখক, কবি, নাট্যকার, নির্মাতা, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার, চিত্রশিল্পী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু তিনি ছিলেন, দারুণভাবেই ছিলেন। তিনি লিখেছেন বেশি, বাকিগুলো করেছেন কম। ফলে তার লেখার চেয়ে অন্য কাজগুলো ছিল বেশি মানসম্পন্ন। তার নাটক, চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গানগুলো মুগ্ধ করেছে সাধারণ দর্শক থেকে বোদ্ধা সবাইকে। তিনি প্রচুর লিখেছেন, সেগুলো প্রচুর বিক্রি হয়েছে। সেই টাকা তিনি খরচ করেছেন তার নাটক, সিনেমায়। যেগুলো ছিল তার শখ। কিন্তু সেই শখের কাজগুলো এত সিরিয়াসলি করেছেন যে সেগুলোই এখন তাকে আলাদাভাবে চেনায়। তার মূল কাজ যেটা, মানে লেখালেখি, সেটা যদি এত সিরিয়াসলি করতেন তাহলে লেখক হিসেবে তার স্থান থাকত হিমালয়সম উচ্চতায়।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে সমালোচনা কিংবা বিশ্লেষণ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি সেরকম বিশেষজ্ঞও নই। আমার লেখাটা মূলত হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ। বোদ্ধারা আলোচনা-সমালোচনা করতে থাকুন। আমার কাছে হুমায়ূন আহমেদ মানে হলো হিমুর অদ্ভুতুড়ে সব কর্মকাণ্ড, হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি, মিসির আলীর জটিল সব বিষয় নিয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা, শুভ্রর শুদ্ধতম কর্মকাণ্ড, শ্রাবণ মেঘের দিনের জাহিদ হাসান, মেহের আফরোজ শাওনের শৈল্পিক অভিনয়, কোথাও কেউ নেই'তে বাকের ভাই-মুনার রসায়ন, অয়োময়, আগুনের পরশমণির আসাদুজ্জামান নূরের পর্দাকাঁপানো পারফরম্যান্স, তারা তিনজনের ফারুক আহমেদ, ড. এজাজ, স্বাধীন খসরুর মজার মজার কীর্তিকলাপ, উড়ে যায় বকপক্ষীর চ্যালেঞ্জারের সুনিপুণ অভিনয় আর পাখির কণ্ঠে শোনা 'তুই রাজাকার' স্লোগান।
হুমায়ূন আহমেদ কী দিয়েছেন, কী দিতে পারতেন সে আলোচনা বোদ্ধারাই করুন। আমি একজীবনে এই মানুষটার কাছ থেকে যা পেয়েছি তাতে একজন সত্যিকারের 'এন্টারটেইনার' হিসেবে তার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, করে যেতেই হবে। জয়তু হুমায়ূন আহমেদ!
0 মন্তব্যসমূহ