ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু

উপমহাদেশে দাঙ্গার ইতিহাস অনেক পুরোনো। মুঘল আমল পর্যন্ত মোটামুটি সম্প্রীতি বজায় থাকলেও ব্রিটিশরাজের সময় এই উপমহাদেশ হয়ে ওঠে ধর্মীয় ও জাতিগত দাঙ্গার উর্বরভূমি। ১৯০বছরের ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে ঠুনকো কারণে ও গুজব ছড়িয়ে অসংখ্য ছোট-বড় দাঙ্গা লাগানো হয়। একসময় ব্রিটিশরাজ নিজেরাই সে দাঙ্গার উৎস হয়ে ওঠে। কারণ তাদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতির প্রয়োগ। দেশভাগের আগের বছর, ১৯৪৬সালে কলকাতায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয় তার সাক্ষী ছিলেন স্বয়ং আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে সেই দাঙ্গার কথা লিখে গেছেন। কলকাতার রাস্তায় শুধু লাশ আর লাশ দেখে তিনি আফসোস করেছেন এই বলে যে 'মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে!' কলকাতার পর নোয়াখালিতে পালটা দাঙ্গায়ও বহু লোক মারা যায়। স্বয়ং গান্ধিকেও ছুটে আসতে হয়েছিল যে দাঙ্গা থামাতে। সেসব দাঙ্গা স্বচক্ষে দেখা ও ধর্মীয় বিভেদ আর হানাহানি থেকে শিক্ষা নিয়েই বঙ্গবন্ধু আজীবন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে গেছেন। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ ছিঁড়ে ফেলে একটা ধর্মনিরপেক্ষ, উদার ও অসাম্প্রদায়িক দেশ আমাদের জন্য উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই দেশ এখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন করছে, অথচ এখনও এই দেশে দাঙ্গা হয়, ধর্মের নামে মানুষ মরে, এরচেয়ে আর বড় দুঃখ কী হতে পারে!

হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে এবার বাংলাদেশে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেলো তাতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ টার্মটা মারাত্মক প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। ঘটনার শুরু কুমিল্লা থেকে। সেখানকার একটা পূজা মণ্ডপে কেউ একজন একটা হনুমানের মূর্তির পায়ের কাছে মুসলমানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ রেখে এসেছে। সেটা শুরুতে পূজা কমিটির চোখে পড়ে। খবর যায় থানায়। ওসি এসে সেই কোরআন উদ্ধার করেন। সেই উদ্ধারের ভিডিও লাইভ করে একজন ফেসবুকে আপলোড করে। আর যায় কোথায়! কোরআন অবমাননার অভিযোগে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ভাঙচুর করে অসংখ্য পূজামণ্ডপ। পুরো কুমিল্লা হয়ে ওঠে অশান্ত। কুমিল্লার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আরও অনেক জায়গায়।

একটা পূজামণ্ডপে মূর্তির পায়ে কোরআন রেখে দেয়া অবমাননাকর হলে সেটা যে করেছে তাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া যেত। সেজন্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার ও প্রশাসন যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সেটাকে উপলক্ষ করে দেশের নানা জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, পূজামণ্ডপ ও মন্দির ভাঙচুর, হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এগুলো কোনো সভ্য সমাজে, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। কুমিল্লায় যে অপরাধ করেছে, তাকে আইডেন্টিফাই করার আগেই চাঁদপুর, নোয়াখালি, ফেনী ও সর্বশেষ রংপুরে যে তাণ্ডব চালানো হলো তাতে এটা পরিস্কার প্রতীয়মান হয় যে এসব ঘটনা কোনো ধর্মীয় কারণে ঘটেনি। পুরো ব্যাপারটাই হয়তো সাজানো ও পরিকল্পিত। দেশে দাঙ্গা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে কোনো একটা চক্র পুরো ঘটনাটি সাজিয়েছে বলে অনুমান করি। গত কয়েক বছরে যে ক'টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে সেগুলো পর্যালোচনা করলে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মোটিভ অনুমান করা কঠিন কিছু মনে হয় না।

২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে একদম নীরিহ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলা হয়েছিল সেটার মূলে ছিল ধর্ম অবামননার গুজব। ফেসবুকে একজন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকের নামে ভুয়া একটা অ্যাকাউন্ট তৈরি করে সেখান থেকে ধর্ম নিয়ে নোংরা পোস্ট দেয়। তার জের ধরে সংঘবদ্ধভাবে বৌদ্ধপল্লি, বৌদ্ধবিহারে তাণ্ডব চালানো হয়। তছনছ করে দেয়া হয় মানুষের ঘরবাড়ি, মন্দির আর দীর্ঘদিনের সম্প্রীতিকেও। রামুর পর ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরেও ঘটে একই কাণ্ড। অশিক্ষিত জেলে রসরাজের নামে এক কম্পিউটার দোকানের ব্যবসায়ী ভুয়া ফেসবুক আইডি তৈরি করে ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট করে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়। তার জেরে কথিত 'তৌহিদি জনতা' বিপুল জোশে গিয়ে হামলা চালায় হিন্দুদের বাড়িঘরে। তিনশো বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়। আর সম্প্রতি সুনামগঞ্জের শাল্লায় যে ঘটনা ঘটল এটা তো চোখের সামনেই। এসব ঘটনাই ঘটেছে ধর্ম অবমাননা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার গুজব ছড়িয়ে। সাম্প্রতিক শারদীয় দুর্গাপূজার ঘটনাটাও একই মনে হচ্ছে। আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত এই রহস্য উন্মোচন করবে।

এই যে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের বিষয় বা ধর্ম অবমাননা, এটার জন্য আইন আছে, শাস্তির ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই যারা ধর্মপ্রাণ মানুষকে উসকানি দিয়ে উত্তেজিত করে, হামলা চালাতে ইন্ধন দেয় তারা মূলত ধর্মের জন্য এসব করে না। করে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসার জন্য। নইলে ধর্মানুভূতি সব জায়গায় একই হয় না কেন?

যে কোরআন অবমাননার অভিযোগে আজ বাংলাদেশে আগুন জ্বলছে, সে কোরআন অবমাননা  কি তখন হয় না যখন বায়তুল মোকাররমে শত শত ধর্মীয় গ্রন্থাদি ও কোরআনে আগুন দেয়া হয়? তখনও হয় না যখন পবিত্র কোরআন কেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে পাচার করা হয়? তখনও হয় না যখন মাদরাসায় শিশু বলাৎকার করে কাউকে না বলার জন্য সে শিশুকে কোরআন ছুঁইয়ে শপথ করানো হয়? সে কাজগুলো যারা করেছে তারা তো চিহ্নিত ছিল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কাউকে তো আন্দোলন করতে দেখলাম না, বিচারও চাইতে দেখলাম না; দেখলাম না কোনো হামলা চালাতেও। অথচ মূর্তির পায়ে কে কোরআন রেখেছে সেটা চিহ্নিত না করেই এমন তাণ্ডব চালানোর উদ্দেশ্য কী?

আমাদের দেশে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়া ও তার প্রতিবাদ করাটাও সিলেক্টিভ। একই কাজ করেও কারও বেলায় প্রতিবাদ হয়, কারও বেলায় হয় না। যেমন প্রথম আলোর ফান ম্যাগাজিন আলপিনে একটা নীরিহ কার্টুন ছাপানোর জন্য কার্টুনিস্ট জেলে গিয়েছিল, আলপিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, বিভাগীয় সম্পাদকের চাকরি গিয়েছিল, সম্পাদক খতিবের কাছে মাফও চেয়েছিলেন। অথচ সেইম কার্টুন এর অনেক আগেই কৌতুক আকারে শিবিরের মুখপত্রখ্যাত কিশোরকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়াই হয়নি। মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকি ধর্ম নিয়ে কিছু 'অযাচিত' মন্তব্য করে মন্ত্রীত্ব খুইয়েছিলেন, রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ উঠলেও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের অসংখ্য বইয়ে ধর্মের অপব্যাখ্যা ও ইসলামের নানা বিষয়ে বিতর্কিত কথাবার্তা থাকার পরও কেউ ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনে না। এসব ঘটনায় পরিস্কার বোঝা যায় ধর্মানুভূতিতে আঘাত ও ধর্ম অবমাননা একটা রাজনৈতিক টার্ম, কোনো ধর্মীয় টার্ম নয়।

আবার ফিরি দাঙ্গায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য একটা সংবিধান প্রনয়ণ করেছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছিলেন নিষিদ্ধ। কিন্তু তাকে সপরিবারে হত্যার পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ফিরে আসে দেশে। অবৈধ সেনাশাসকেরা সংবিধান সংশোধন করে সাম্প্রদায়িক করে ফেলে রাষ্ট্রকে। এর ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচার এরশাদ তার শাসনামলের শেষদিকে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম যোগ করে যান। সে সময় রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতায় প্রতিবাদ করে বিএনপি, আওয়ামি লিগ এমনকি জামায়াতও। হরতাল ও আন্দোলনও হয় তখন। খালেদা জিয়া বলেন, 'রাষ্ট্রধর্ম জাতিকে বিভক্ত করার জন্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রধর্মের প্রয়োজন নেই'। শেখ হাসিনা বলেন, 'সংবিধানের সংশোধন জনগণ মানবে না'। আর জামায়াত বিবৃতি দেয়, 'ইসলামি আন্দোলন প্রতিহত করাই রাষ্ট্রধর্মের উদ্দেশ্য'। মূলত সেই রাষ্ট্রধর্ম প্রনয়ণ করার ফলে অন্যধর্মের লোকেরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হন। তখন থেকেই দাঙ্গা ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে দেশে।

১৯৯২ সালে ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ও তাদের সমমনারা অযোদ্ধার চারশো বছরের পুরোনো বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে, সেখানে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। এই ঘটনার জেরে বাংলাদেশে শুরু হয় বড় আকারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী সরাসরি মাঠে নামার সুযোগ পায়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য এদেশের হিন্দুরা দায়ী না হলেও উগ্রবাদী গোষ্ঠী এখানকার অনেক মন্দির ধ্বংস করে, হিন্দুদের ওপর নারকীয় সব ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এরপর থেকেই মূলত ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি বাড়তে থাকে দেশে আর সেইসাথে বাড়তে থাকে দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। ২০০১ নির্বাচনের পর সারাদেশে তাণ্ডব দেখেছি আমরা। আর গত কয়েক বছর ধরে দেখছি গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক  সহিংসতার নানা ঘটনা। এবার ঘটনাগুলো পূর্বের অনেক ঘটনাকেও ছাড়িয়ে গেলো!

এসব ঘটনা ও সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। প্রতিটি ঘটনা ঘটার পর কিছু মানুষের নামে মামলা হয়, তাদের ধরা হয় এবং তারা কিছুদিন পর জামিনে বের হয়ে এসে সমাজে সদম্ভে বিচরণ করে। কারও কোনো শাস্তি হয় না। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলে, কিন্তু মামলার সমাপ্তি হয় না। অপরাধ পৃথিবীর সবখানেই ঘটে। কিন্তু একটা সভ্য আর অসভ্য রাষ্ট্রের তফাৎ এটাই যে সভ্য রাষ্ট্রে সব অপরাধের বিচার হয়, দোষীদের কঠোর সাজা হয়, ফলে সেখানে অপরাধ কমে আসে। অসভ্য রাষ্ট্রে কঠোর সাজা দূরের কথা, কোনো সাজাই হয় না। ফলে অপরাধীরা উৎসাহিত হয়, দোর্দণ্ড প্রতাপে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে আইন-আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোও ঠিক সে কারণেই ঘটছে বলে আমরা মনে করি।

তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ হিসেবে ও উপমহাদেশের অতীত চরিত্র অনুযায়ী এটা বলা যায় যে এই জনপদ এত তাড়াতাড়ি সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরিয়ে আসবে এটা আশা করা বোকামি। তার ওপর দীর্ঘ টানা একুশ বছর সাম্প্রদায়িক ও সামরিক শাসনের কবলে থাকায় রাষ্ট্রের চরিত্রই যেখানে বদলে গিয়েছিল সেখানে এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক হবেও না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের সমাজে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বাচ্চাদের মননে যে ধরনের অসাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে ভবিষ্যতের অসাম্প্রদায়িক প্রজন্ম তৈরি করার কথা ছিল রাষ্ট্র তার কিছুই করেনি এখন পর্যন্ত। রাষ্ট্র এখন ব্যস্ত ইট-পাথরের উন্নয়নে। মানুষের মগজের উন্নয়নের দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত বিরাট জনগোষ্ঠীকে উদার, সহনশীল, পরমতসহিষ্ণু করে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের বিনিয়োগ খুব সামান্যই চোখে পড়ে। ধার্মিকতার আগে মনুষ্যত্বের শিক্ষা দেয়াটা যে সবচেয়ে জরুরি এটা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। নইলে বড় বড় রাস্তাঘাট, ব্রিজ, অবকাঠামো উন্নত হবে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মানসিকতা পড়ে থাকবে সেই ভাগাড়েই!

যে ধর্মই আমরা মানি, যে ধর্মই পালন করি, সবার আগে মানুষ হওয়া জরুরি। পৃথিবীতে যত মহান মানুষ এসেছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তারা ধর্মের অনুসারী হওয়ার আগেও একজন মানুষ ছিলেন। মনুষ্যত্বের চর্চা করেছেন, দীক্ষা দিয়েছেন আগে, তারপর ধর্ম পালন করেছেন। এমনকি ইসলামের নবি হজরত মুহাম্মদও (সা.) নবুওয়াত পাওয়ার আগপর্যন্ত দীর্ঘ চল্লিশ বছর মানুষ হওয়ার দীক্ষা নিয়েছেন। ওহি আসার আগ পর্যন্ত তিনি জানতেন না তার ধর্ম কী কিংবা কোন ধর্মের নবি তিনি। ততদিন তাহলে তিনি কী করেছেন? হ্যাঁ, মনুষ্যত্ব আয়ত্ব করেছেন, চর্চা করেছেন, শিখিয়েছেন। 'আল আমিন' বা বিশ্বাসী উপাধি তিনি নবি হওয়ার আগেই পৌত্তলিক আরবদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তিনিই হিলফুল ফুজুল বা শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে জাতিগত, গোষ্ঠীগত অনেক রক্তক্ষয়ী সংঘাত দূর করে সে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন। সত্যবাদিতা, পরোপকারী, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার নেতৃত্ব তিনি নবি হওয়ার আগেই দিয়েছেন এবং সেটা মানুষ হিসেবে। তাই আগে মানুষ পরে ধর্ম এটাই তার শিক্ষা ছিল।

আর্য ইরানি কবি ওমর খৈয়ামকে সাহিত্যপ্রেমী মানুষমাত্রই চেনেন। মুসলিমরা তাকে নিয়ে বেশ গর্বও করেন। কিন্তু উনিও সবার আগে একজন মানুষ মনে করতেন নিজেকে। ওনার লেখালেখিতে বীতশ্রদ্ধ একজন লোক একবার জিজ্ঞেস করল, আপনি যে এসব লেখালেখি করেন, আপনি কি মুসলমান নন? উনি বললেন, আমি মানুষ। লোকটি বললো, তাহলে কি আপনি কাফের? তিনি বললেন, না, আমি সেটাও নই। আচ্ছা, আপনি? আমি মুসলমান- লোকটি সদম্ভে বলে ওঠে। ওমর খৈয়াম স্মিত হেসে তাকে বললেন, হ্যাঁ মুসলমান, কিন্তু মানুষ তো নন!

সমাজপতি আর বকধার্মিকদের অত্যাচারে কবি ওমর খৈয়াম যখন লোকালয় ছেড়ে নির্জন একটা কুটিরে বাস করছিলেন তখনও ভক্তরা তার কাছে হরদম যাতায়াত করতে লাগল। এ দৃশ্য সহ্য হলো না সেই বকধার্মিকদের। তারা হাজির হলো খৈয়ামের সেই নির্জন কুটিরেও। সাধারণ মানুষদের 'কুপথে' চালিতে করার অভিযোগে তারা জ্বালিয়ে দিল কবির জীর্ণ কুটির, বইপত্র সবকিছু। কবি এসব দৃশ্য অবলোকন করে খুবই কষ্ট পেয়ে মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দই করলেন, হে আল্লাহ! সেটা শুনে এক অগ্নিসংযোগকারী বললো, আপনি আল্লাহও বিশ্বাস করেন? খৈয়াম বললেন 'অবশ্যই। আল্লাহ তো দয়ালু। তার সৃষ্ট বান্দারা এত নির্দয় কেন?'

খৈয়ামের এই কথা ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল সমাজপতি ও ধর্মান্ধদের। আল্লাহ তো সত্যি অনেক দয়ালু। কিন্তু তার অবারিত দয়ার ভাণ্ডার শুধু মুসলিমদের ওপরই বর্ষিত হচ্ছে না, হচ্ছে সমগ্র মানবজাতি ও প্রাণিকুলের ওপর। আল্লাহ-সৃষ্ট মানবকুলের একটা অংশ (হিন্দু-বৌদ্ধ) মূর্তি বানিয়ে তার পূজো করছে তাতে আল্লাহর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি? হচ্ছে না। সমস্যা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীনতা দিয়ে পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। সে কী করবে না করবে সেটার হিসেব নেবেন শেষ বিচারের দিন। কিন্তু আল্লাহর সমস্যা না হলেও সমস্যা হচ্ছে বকধার্মিকদের, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা করা লোকদের। কারণ এরা ধর্মান্ধ হতে পেরেছে হয়তো, কিন্তু আজও মানুষ হতে পারেনি; পারেনি ধার্মিক হতেও। প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের কবি নজরুল তার 'মানুষ' কবিতায় ওদের জন্যই বলে গেছেন- 'মানুষেরে ঘৃণা করি/ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি/ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে/যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল!–মুর্খরা সব শোনো/মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।'

আমরা যাদের নিয়ে গর্ব করি, যাদের অনুসরণ করি সেই মুসলিম মনীষীদের সবাই নিজেদের মানুষই মনে করতেন। মানবতাকেই সবার ওপরে স্থান দিতেন। কিন্তু আমাদের মানবতা আজ কোথায়? দিন-দিন কেন আমরা শুধুই অমানবিক হয়ে উঠছি; হয়ে উঠছি নিদারুণ অসহিষ্ণুও? প্রশ্ন রেখে গেলাম জাতির বিবেকের কাছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ