রূপালি হাসি



বাবা, খাইতে আসো। দাদি ভাত বাইড়া দিছে।
-আইতাছি রে মা, তুই খাইতে বয়।
-তাড়াতাড়ি আসো!
হারিকেনের আলোয় ছেঁড়া জালটা মেরামত করছিলেন রহিম মাঝি। মেয়ের ডাক শুনে খেতে যেতে আর দেরি করেন না। মেয়েটা রেগে গেলে ভীষণ বিপদ!
পুঁটিমাছ ভাজা, ডাটাশাক আর ডাল দিয়ে মেয়ে টুনটুনি আর মা আমেনা বেগমের সাথে বসে রাতের খাবার খাচ্ছেন রহিম মাঝি। হঠাৎ টুনটুনি বলল, বাবা, পুঁটিমাছ খাইতে মন চায় না, একটা বড় ইলিশ আনবার পারো না?
আমেনা বেগম মুখ টিপে হাসেন নাতনির কথা শুনে। রহিম মাঝিও হাসেন। হাসতে হাসতেই বলেন, 'আমার মা ইলিশ খাইতে কইছে আর আমি আনুম না? এইবার ইলিশের জাল গাঙে পড়লেই মহাজনরে কইয়া তোর লাইগা বড় একটা ইলিশ আনুম।
-মনে থাকব তো?
-হ রে মা, মনে থাকব।

সন্ধ্যা হতেই পুরো চর এলাকাটি অন্ধকারে ছেয়ে যায়। পদ্মানদীতে যতগুলো চরে বসতি আছে তার মধ্যে চর ভরসা  নামের এই চরটিতে বসতি হয়েছে সবার শেষে। পুরোনো ও বেশি লোক বসতির অনেক চরে বিদ্যুৎ এলেও এই চরে বিদ্যুৎ, রাস্তা-ঘাট কিছুই নেই। মাত্র ৩০/৩৫টা পরিবার থাকে, যাদের প্রায় সবাই জেলে। কেউ কেউ মাঝিও। মহাজনের নৌকায় জেলে ও মাঝির কাজ করেই সংসার চলে তাদের। দারিদ্রতা তাদের নিত্যসঙ্গী বটে।

রহিম মাঝি এই চরেরই বাসিন্দা। নদীভাঙনে একসময় ঘরবাড়ি সব হারিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় এই চরে এসে উঠেছিলেন। একমাত্র মেয়ে টুনটুনি আর মাকে নিয়েই সংসার তার৷ মেয়ের বয়স ৭ বছর। টুনটুনির মা তাকে তিন বছর বয়সে রেখে একরাতের জ্বরেই মারা যান। রহিম মাঝি সাগরসম পদ্মা পাড়ি দিয়ে রাতের বেলায় ডাক্তারের কাছে বউকে নিয়ে যেতে পারেননি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর মা অনেকবার আবার বিয়ে দিতে বললেও রহিম মাঝি টুনটুনির কথা চিন্তা করে বিয়ে করেননি এখনও। টুনটুনির জন্য কখনোই সৎ মা আনতে পারবেন না তিনি।

রহিম মাঝি মহাজানের বড় নৌকায় মাঝিগিরি করেন ইলিশের মৌসুমে। অন্য সময় নিজের ছোট্ট নৌকায় করে জাল পেতে মাছ ধরেন৷ কোনোমতে দিন চলে যায় আর অপেক্ষা করেন ইলিশের মৌসুমের। কারণ ইলিশের মৌসুমে আয়-রোজগার ভালো হয়। ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালি ইলিশ যখন জালের ভেতর ধরা পড়ে, তখন মাঝি, জেলে এমনকি মহাজনেরও খুশিতে চোখ চিকচিক করে ওঠে!

আগামীকাল ইলিশ ধরার বিশেষ নৌকা নামবে নদীতে। একদিন আগেই মা-মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রহিম মাঝি মহাজনের নৌকায় যান। টুনটুনির মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ বাবা এখন থেকে আর নিয়মিত বাড়িতে আসবে না। বাবার কানে কানে গিয়ে আবারও ইলিশের কথা মনে করিয়ে দেয় সে। হেসে হেসে রহিম মাঝি টুনটুনির কপালে চুমু খায় আর বলে, আনুম রে মা আনুম, এইবার ভুল হইব না আর!

বেশ কয়েকদিন পর সন্ধ্যায় রহিম মাঝি ঘরে ফেরেন। এবার অনেক ইলিশ পড়েছে জালে। হারুন মহাজনের বেশ ভালোই ব্যবসা হয়েছে। মাঝি ও জেলেদের মজুরিও তাই ছিল ভালো। কিন্তু মেয়ের জন্য এবারও ইলিশ আনতে পারেননি। হারুন মহাজন আগেই বলে দিয়েছিল এবার সে একটা ইলিশও কাউকে নিতে দেবে না। গত ছয়মাস বসে বসে খেয়ে তার অনেক দেনা হয়ে গেছে। সেগুলো শোধ না করা পর্যন্ত কেউ ইলিশ নিতে পারবে না। এমনকি মহাজন নিজেও নেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। এসব শোনার পর রহিম মাঝি মহাজনকে ইলিশের কথা বলতে পারেননি। ভেবেছিলেন টাকা পেলে কিনে আনবেন, মেয়ের আবদার বলে কথা। কিন্তু ইলিশের দাম শুনেই তার মাথায় চক্কর দিলো। বাড়ির বাজার-সদাই আর জরুরি জিনিষপত্র কিনে যে টাকা থাকল সেটা দিয়ে আগামি দুই মাস চলতে হবে। ইলিশ কিনে টাকা 'নষ্ট' করার মত টাকা কই!

টুনটুনি ঘুমিয়ে গিয়েছিল। রহিম মাঝি মেয়েকে না জাগিয়ে খেয়েদেয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে যান। মা ইলিশ বাচ্চা ছাড়বে, তাই দু মাসের জন্য ইলিশ ধরা বন্ধ। দু মাস পরে আবার ডাক এলে ইলিশের নৌকায় যাবেন। সকালে টুনটুনি ঘুম থেকে ওঠে দেখে, বাবা তার জন্য লাল চুড়ি, চুলের ফিতে, আলতা, নেইলপলিশ কিনে এনেছেন। সেগুলো পেয়ে খুব খুশি হয় সে। বাবাকে ডেকে তোলে। অনেকদিন পর বাবা-মেয়ের একসাথে হওয়ার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে কুঁড়েঘরের চারপাশে।

দুপুরে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে একসাথে খেতে বসে টুনটুনি, রহিম মাঝি ও দাদি। ছোটমাছ, সবজি আর ডাল রান্না করা হয়েছে। টুনটুনি সেগুলো দেখেই বাবাকে জিজ্ঞেস করে- বাবা, ইলিশ আনো নাই?
মেয়ের প্রশ্ন শুনেই পেটে মোচড় দিয়ে উঠল রহিম মাঝির। মিথ্যে করে বললেন, নারে মা, এবার ইলিশ বেশি পড়ে নাই। আবার গেলে আনুম।
-না, আমি ইলিশ খামু। ইলিশ ছাড়া ভাত খামু না।
-খাইয়া লও মা, আবার গেলে আর ভুল হইব না।
-কইছি না ইলিশ ছাড়া খামু না- বলেই প্লেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যায় ঘরে। গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। রহিম মাঝি ও তার মা অনেক বোঝান। কিন্তু টুনটুনি কিছুতেই খায় না। তার এক কথা, ইলিশ ছাড়া খাবে না!

রহিম মাঝি মহা ভাবনায় পড়ে যান। সারাদিন যায়, রাত হয়ে আসে, কিন্তু মেয়ে কিছু মুখে দেয় না। খালি পেটেই ঘুমিয়ে পড়ে। রহিম মাঝি মা মরা মেয়েটার সারাদিন না খেয়ে থাকা দেখে সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু ইলিশ কই পাবেন তিনি? এখন তো হাটেও যাওয়া সম্ভব না আর গেলেও কিছু পাবেন না। মেয়েটার জন্য কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

রাত গভীর হতেই রহিম মাঝি নিজের ছোট জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। শৌখিন মাছ ধরার জাল মাঝি ও জেলেদের সবার ঘরেই থাকে। পাশের বাড়ির আনোয়ার জেলেকে মেয়ের অবস্থা বলে অনুরোধ করে সাথে নিয়ে যান। রহিম মাঝি নৌকা বেয়ে নদীর একটু গভীরে যান। যেহেতু নদীতে জাল ফেলা সরকারের নিষেধ, তাই গভীর রাতেই তারা জাল ফেলেন। পাম্প লাইটের মৃদু আলোয় জাল ফেলতে থাকেন। কই, মলা, পুঁটিসহ অনেক ছোটমাছ ধরা পড়লেও ইলিশ পড়ে না। একের পর এক জাল ফেলেন। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে, কিন্তু ইলিশের দেখা পান না তারা। একরাশ হতাশা আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফেরার পথ ধরেন রহিম মাঝি ও জেলে আনোয়ার।

অর্ধেক পথ যেতেই হঠাৎ বাতাস বইতে শুরু করে। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে গুড়ুম গুড়ুম ডাকও শুরু হয়। ঝড়ের মৌসুম এখন রহিম মাঝি জানতেন। তবু মেয়ের জন্য এতরাতে তিনি বেরিয়েছেন। বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে, রহিম মাঝি দ্রুত নৌকা চালান। জেলে আনোয়ারও হাত লাগায়। কিন্তু পথ যে আর ফুরোয় না! ভীষণ দুলতে থাকে নৌকা। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয় প্রচণ্ডবেগে। অনেক কষ্টে তীরে নৌকা ভেড়ান তারা।

পরদিন সকালে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে রহিম মাঝির। আমেনা বেগম ছেলের গায়ে হাত দিয়ে চমকে ওঠেন। কয়েকটা কাঁথা দিয়ে শরীর ঢেকে দেন তার। সাথে মাথায় জল ঢালতে শুরু করেন। এদিকে টুনটুনি প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে রাতের ভিজিয়ে রাখা পান্তা খেয়ে বাবার কাছে আসে। বাবাকে কাঁপতে দেখে একটা হাত ধরে বসে বসে কাঁদতে শুরু করে আর বলতে থাকে- বাবা, আমি আর ইলিশের কথা কমু না। আমি ইলিশ চাই না। আমি তোমারে চাই বাবা। আমার মা আমারে ছাইড়া চইলা গেছে, তুমি যাইয়ো না বাবা!
টুনটুনির কথা শুনে আমেনা বেগম কান্না আটকে রাখতে পারেন না। জ্বরের ঘোরে প্রায় অচেতন রহিম মাঝির দু চোখ বেয়েও অশ্রুর ধারা বইতে থাকে।

তিনদিন ভয়ানক জ্বরের পর রহিম মাঝির শরীরে ঘাম হয়, জ্বর ছাড়ে। আমেনা বেগমের অনেক সেবাযত্ন আর জেলে আনোয়ারকে দিয়ে গঞ্জের বাজার থেকে আনা ওষুধ খেয়ে জ্বর নামে তার। আর টুনটুনি তো বাবার কাছ থেকে প্রায় সরেইনি এই তিনদিন। এখন রহিম মাঝি একটু ওঠে বসতে পারেন।  আরও দু দিন পর বাইরেও বের হন।

আজ মোটামুটি সুস্থ রহিম মাঝি। দুপুরে খেতে বসেছেন মা ও টুনটুনিকে নিয়ে। এমন সময় মহাজনের গলার আওয়াজ শুনতে পান। রহিম, ঘরে আছ নাকি?
ঘর থেকে বেরিয়ে হারুন মহাজনকে দেখে রহিম মাঝি অবাক হন। আরে, মহাজন সাব যে! কী মনে কইরা?
-তুমি তো লোক ভালা না মিয়া?
-কী হইসে মহাজন সাব? কোনো ভুল করসি?
-ভুল তো করসোই মিয়া। একমাত্র মাইয়া একটা ইলিশ খাইতে চাইসে আর সেইটাও আমারে কইতে পারলা না মিয়া? তুমি ক্যামন বাপ!
-আসলে মহাজন সাব...
-হইসে, আর ভণিতা করতে হইব না। এই নাও, ইলিশ দুইটা তোমার মাইয়ারে নিয়া দাও!
-মহাজনের হাতে ইলিশ দেখে অবাক হন রহিম মাঝি।
-মহাজন সাব, ইলিশ...
-আরে মিয়া, আনোয়ার না কইলে তো আমি জানতামই না মাইয়ার আবদার মিটাইতে গিয়া মরতে বইছিলা তুমি। ভাগ্যিস, গঞ্জে আনোয়াররে পাইসিলাম। তাই ইলিশ দু খানা কিইনা লইয়া আইলাম। আর শুনো মিয়া, আমি ইলিশ আনতে মানা করসিলাম মানে এইটা না যে ছোট্ট মাইয়া আবদার করলেও আনবা না। আমারে মাইয়ার কথা কইলে আমি কি না করতাম? আমি কি খুব খারাপ মানুষ? আমারও তো পোলা-মাইয়া আছে!
-না মহাজন সাব, আপনের লাহান মানুষ অয় না। আপনে আইজ আমাগো লগে দুইটা ভাত খাইয়া যাইবেন।
-আইজ সময় নাই। আবার গাঙে জাল পড়লে নিজের জালের মাছ দিয়া তোমার বাড়িতে আইয়া একদিন খাইয়া যাইমু।

আনোয়ার মাঝি হারুন মহাজনকে বিদায় করে টুনটুনিকে ডেকে এনে তার হাতে ইলিশ দুটো তুলে দেয়। ইলিশ দেখে খুশিতে সে আত্মহারা হয়ে যায়। রূপালি হাসিতে ছোট্ট মুখটি ভরে ওঠে তার। টুনটুনির খুশি দেখে রহিম মাঝি আর আমেনা বেগমের মনেও আনন্দের ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ