দ্য ডার্ক সাইড অফ ঢাকাঃ আলোর নিচে আঁধারের গল্প


মেগাসিটি ঢাকা দিনের আলোয় দারুণ কর্মব্যস্ত, যানজট আর মানুষের চাপে পিষ্ট। কিন্তু রাতের আলো ঝলমলে ঢাকার অন্যরকম একটা সৌন্দর্য আছে। রাতে যারা ঢাকায় ঘোরাঘুরি করেছেন তারা একবাক্যে মেনে নিতে বাধ্য হবেন রাতের ঢাকা অনেক বেশি সুন্দর। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালেও ঢাকার আছে অনেক অন্ধকার দিক। যেখানে ক্রাইম আছে, মাদক আছে, স্মাগলিং আছে, ছিনতাই আছে, খুন-খারাবি আর চোর-পুলিশ খেলাও আছে। দ্য ডার্ক সাইড অফ ঢাকা ওয়েব সিরিজে ঢাকার এরকম একটি চিত্রই উন্মোচন করেছেন তরুণ পরিচালক রায়হান রাফি।

পুরো সিনেমায় মোট পাঁচটি গল্প আছে, যেগুলো আলাদা আলাদা নামে পর্দায় এসেছে। কিন্তু পাঁচটি গল্পকেই পরিচালক কানেকটেড করেছেন খুব ভালোভাবেই। সব গল্প না হলেও কিছু কিছু গল্প আমাদের সবার চেনা এখানে। কিন্তু সেগুলো নির্মাণশৈলীর ভিন্নতার কারণে কখনো কখনো আনপ্রেডিক্টেবল মনে হচ্ছিল। ফলে সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত সমানতালে উত্তেজনা ধরে রাখতে পেরেছে। কোথাও একটু লুজ করেনি গল্প। এক নিঃশ্বাসে দেখে নেয়া গেছে।

বড় কোনো অভিনয় তারকা কিংবা কিংবদন্তি কেউ ছিলেন না। কিন্তু এই সিনেমার সবচেয়ে ভালো লাগার দিক ছিল অভিনয়। রাশেদ মামুন অপুর কথা প্রথমেই বলব। রাজশাহীর তোতা মিয়া নামক কমেডি চরিত্রে তাকে নাটকে সেই শুরু থেকেই দেখে আসছি। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে তিনি যে চরিত্রগুলোতে কাজ করছেন তাতে মনে হচ্ছে এতদিন তার প্রতি অবিচার করেছেন আমাদের নির্মাতারা। এর আগে রায়হান রাফির জানোয়ারে ডাকাতদলের সর্দার হিসেবে এত অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন যে জাস্ট মুগ্ধ ছিলাম। দ্য ডার্ক সাইড অফ ঢাকায় সেই মুগ্ধতা আরও অনেক বেড়ে গেলো। মর্গের ডোম চরিত্রে পুরো সিরিজে তার সরব উপস্থিতি ও অনবদ্য অভিনয় ছিল চোখে পড়ার মত। তার একটা সংলাপ ছিল এরকম- 'আজিব এ ঢাকা শহর। হালায় অন্ধকার হইতে না হইতেই মানুষ মরার জন্য সব লাইন দিয়া পড়ে'। এই একটি সংলাপে মূলত পুরো সিনেমাটাই ওঠে আসে।

মনোজ প্রামাণিক ভালো অভিনয় করেন। এই সিরিজেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। নাজিফা টুশি, সামিয়া অথৈসহ নাম না জানা প্রত্যেকেই ভালো ছিলেন। কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছেন তমা মির্জা। তমা মির্জা বাণিজ্যিক সিনেমা করেন, যেগুলো দেখা হয় খুবই কম। ফলে তার অভিনয় সেরকম দেখা হয়নি আগে। কিন্তু এই সিনেমায় তার অভিনয় দারুণ লেগেছে। তার পার্টটাতে ভালো একটা টুইস্ট ছিল। চরিত্র অনুযায়ী ড্রেসআপ-গেটআপও খুব মানানসই ছিল। সংলাপ বলার ধরন বেশ ভালো লেগেছে। এমনকি স্ল্যাংগুলোও।

সিনেমার প্রায় সকল দৃশ্যই রাতের। সে হিসেবে কালার গ্রেডিং ভালো ছিল যথেষ্ট। সিনেমাটোগ্রাফি ভালো লেগেছে, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও বেশ ভালো। ফ্রেমগুলোও সিনেম্যাটিক ছিল। অনেক সিরিজেই নাটক নাটক একটা ফিল চলে আসে। কিন্তু এখানে সেটা একদমই আসেনি, সিনেমাই মনে হয়েছে।

সিনেমায় প্রচুর স্ল্যাং ইউজ করা হয়েছে, কোথাও বিপ ব্যবহার করা হয়নি। অনেকে এটাকে নেতিবাচক বলতে পারেন, তবে আমার কাছে ঠিকঠাকই মনে হয়েছে। যে চরিত্রগুলো ছিল সেগুলোর সাথে মানিয়েও গেছে। বরং স্ল্যাংগুলোও না থাকলেই অস্বাভাবিক লাগত। কারণ অন্ধকার জগতের বাসিন্দারা বাস্তবে এরকমই কথা বলে। তবে সংলাপগুলো আন্ডার এইটিন কারও না দেখাই ভালো।

পুরো সিনেমার নেগেটিভ দিক একটাই মনে হয়েছে আমার কাছে। সেটা হলো এর লেংথ বা দৈর্ঘ। যে পাঁচটি গল্প দেখানো হয়েছে সেগুলোর একেকটি দিয়ে আলাদা আলাদা সিনেমা হতো। সেগুলোকে একসাথে দেখানো হয়েছে ভালো কথা, তাই বলে মাত্র ১ঘন্টা ১৭মিনিট দেখাবেন? অনায়াসে এটা ২ঘন্টায় নিয়ে যাওয়া যেত এবং কাহিনি তাতে একটুও লুজ করতো না আমি নিশ্চিত।

রায়হান রাফির জানোয়ার ওয়েব সিরিজ অনেকেরই দেখা। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সিনেম্যাটিক অ্যাপে মুক্তি পেয়েছিল, যেটি মাত্র দুই টাকায় দেখেছিলাম। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত সেই সিরিজের নির্মাণ ও অভিনয় দুটোই প্রশংসিত হয়েছিল। আমিও একটা রিভিউ করেছিলাম। দ্য ডার্ক সাইড অফ ঢাকা দেখা যাচ্ছে আরেকটি নতুন ওটিটি আই থিয়েটারে। মাত্র বিশ টাকা দিয়ে একদিনের সাবস্ক্রিপশন নিয়ে দেখে আসতে পারেন আপনিও।

রায়হান রাফির সামনে বেশকিছু কাজ আসছে। দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। বাংলা সিনেমার দিনবদলের অন্যতম সারথী হবেন এই পরিচালক, এটাই কামনা করি।

The Dark Side of Dhaka

Director: Raihan Rafi

Personal Rating: 8/10

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ