পাহাড়ের বুকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য

 


আগেরদিন বেশ কয়েকবার ছোট ছোট ভূকম্প অনুভূত হয়েছে সিলেট শহর ও এর আশপাশে। আজকে ভোরেও একদফা কম্পন অনুভূত হয়েছে। পুরো নগরজুড়েই আতঙ্ক। মানুষের মধ্যে একটা চাপা ভয় কাজ করছে। তার ওপর গ্রীষ্মের এই সময়টায় প্রচণ্ড গরম দেশজুড়েই। তাপমাত্রা ৩৫-৩৭ পর্যন্ত ওঠে যাচ্ছে প্রায়ই। যদিও 'ফিল' হচ্ছে ৪৫ডিগ্রির মতো। এমন অসহ্য গরম আর ভূমিকম্পের ভয় মাথায় নিয়ে সিলেটের উপশহরের বিখ্যাত রোজভিউ হোটেলের সামনে থেকে আমরা ছয়জনের একটা দল আজ যাচ্ছি আনারস বাগানে বেড়াতে।

হাইয়েস মাইক্রোবাসে করে রওনা হলাম বিকেল সাড়ে তিনটায়। দুপুর দুটোয় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড রোদের কারণে একটু পিছিয়ে তিনটেয় যাওয়ার কথা থাকলেও সবাই আসতে আসতে সাড়ে তিনটা বেজে গেলো। হাইয়েসের বড় ভার্শন এই মাইক্রোতে মোটামুটি ১৫জন লোক অনায়াসে বসতে পারে। কিন্তু করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধির বাধ্যবাধকতা থাকায় আমরা ছয়জন ও একটা বাচ্চাসহ মোট সাতজন যাচ্ছি। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের দত্তরাইল গ্রামের চেয়ারম্যান বাড়ি হলো আমাদের গন্তব্য। সেখানে ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর দৃষ্টিনন্দন আনারস বাগান দেখতে আর রসালো ও মিষ্টি আনারসের স্বাদ নিতেই আজকের এই যাত্রা।

এক ঘন্টারও কম সময়ে আমরা দত্তরাইল গ্রামে পৌঁছে গেলাম৷ আনারস বাগানে যাওয়ার একটু আগেই গ্রামের ছোট্ট রাস্তায় জ্যাম লেগে গেলো। ফলে আমাদের গাড়ি এগোতে পারছিল না। কিন্তু আমাদের ট্যুর অপারেটর বশির ভাই নেমে অদ্ভুত দক্ষতায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক করিয়ে দিলেন আবারও। ফলে খুব দ্রুতই বাগানের মূল গেটে পৌঁছে গেলাম।

গাড়ির ভেতরে এসি থাকায় গরমটা অনুভূত না হলেও গাড়ি থেকে নামতেই আবারও তীব্র গরম এসে পুরো শরীরটাকে ঘর্মাক্ত করে দিলো। দু'পাশে ছোটবড় পাহাড়, মাঝখানে রাস্তা। তার পাশেই আব্দুল মতিন ওরফে হাজি চাঁন মিয়ার বাড়ি। দু'বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন মরহুম আব্দুল মতিন সাহেব। ফলে বাড়িটিকে চেয়ারম্যান বাড়ি নামেও ডাকা হয়।

চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন চাঁনমিয়ার বাড়ি লাগোয়া অনেকগুলো পাহাড়। অবশ্য এগুলোকে টিলা বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। টিলাগুলো বেশ বড় বলে পাহাড়ের মতোই লাগে। সেসব টিলার ওপর প্রায় ৬০বিঘা জায়গা নিয়ে পারিবারিকভাবে এ আনারস বাগানটি গড়ে তুলেছেন আব্দুল মতিন চাঁনমিয়ার সন্তানেরা। বৃহৎ আকারে গোলাপগঞ্জ উপজেলায় এটিই মূলত একমাত্র আনারসের বাগান।

জলঢুপী জাতের এ আনারসের বাগানটি গড়ে ওঠে ২০১৯ সালে। শখের বসে গড়ে তোলা বাগানে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার আনারসের গাছ আছে বলে জানা যায়। কোনো ধরনের রাসায়নিক ছাড়া প্রায় ১৮মাস পরিচর্যা করার পর গেলো কিছুদিন ধরে ফলন শুরু হয়েছে, সেইসাথে হচ্ছে বিক্রিও। প্রতিদিন গড়ে হাজারপাঁচেক পাকা আনারস বিক্রি হচ্ছে। তবে এই আনারস বিক্রি করে আয়ের সব টাকা জমা হচ্ছে মরহুম আব্দুল মতিন চাঁনমিয়ার নামে গঠিত ‘আব্দুল মতিন চাঁনমিয়া এডুকেশন ট্রাস্ট'-এর ফান্ডে। যে ট্রাস্ট শিক্ষাসহ এলাকার অসহায় মানুষের কল্যাণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু আনারস বাগানই নয়, এখানে আগে থেকেই কলা, পেয়ারা, লিচু, তেজপাতা ইত্যাদি বাগানও গড়ে তুলেছেন তারা।

মরহুম আব্দুল মতিন চাঁনমিয়ার আট পুত্র। তাদের কেউ যুক্তরাজ্য এবং কেউ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তারা সকলেই প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত এবং বিভিন্ন কমিউনিটির সাথে যুক্ত। ৫ম পুত্র রাসেল আহমদ প্রবাসে থাকলেও দেশে পড়ে থাকা টিলা কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেই চিন্তা থেকেই আনারস বাগান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। ২০১৮সালে শ্রীমঙ্গলের বাগানগুলো ঘুরে আসেন এবং পরিবারের অন্যান্যদের সহযোগিতা ও মতামতের ভিত্তিতে আনারস চারা রোপন করতে শুরু করেন, যা আজ উচ্চফলনশীল এক বাগানে পরিণত হয়েছে। শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা ও ব্যাংক কর্মকর্তা রইছ উদ্দিনের উৎসাহ ও তত্ত্বাবধানে বাগানটি এই পর্যায়ে এসেছে। যিনি বাগানের লভ্যাংশের ৩০শতাংশ মালিকও।

পাহাড়ের কোলজুড়ে সারিসারি আনারস গাছ। মাঝখানে হাঁটাপথ ধরে একেবারে ওপরে ওঠার রাস্তা। কাঁটাযুক্ত সবুজ আনারস পাতার মাঝখানে কাঁচাপাকা আনারসগুলো ফুলের মত প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। এমন নান্দনিকতা মুগ্ধ করবে যে কাউকে। আমাদেরও করেছে। তার ওপর আছে পুরো এলাকাজুড়ে প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। টিলার একেবারে ওপরে ওঠে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পুরো বাগান দেখছিলাম আর স্বর্গীয় এক অনুভূতি মনকে আচ্ছন্ন করে রাখছিল। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। শেষ বিকেলের পশ্চিমে হেলেপড়া সূর্যটা মোহনীয় এক আনন্দে আন্দোলিত করছিল বারবার। আনারস শ্রমিকদের ক্লান্তিহীন আনারস তোলার কাজ চলছিল অবিরাম। আমাদের মতো আরও অসংখ্য ভ্রমণবিলাসী মানুষ কেউ কেউ ছবি তুলছিল, ভিডিও করছিল আবার অনেকে টিকটকের জন্য নানা বিকৃত ভঙ্গিমায় অভিনয় করছিল। টিকটক/লাইকি নামের অপসংস্কৃতিগুলো কবে যে বন্ধ হবে কে জানে! আরেকটা কথা না বললেই নয়। এমন চমৎকার একটা পরিবেশ নোংরা-আবর্জন ফেলে আমরা নষ্ট করতে শুরু করেছি। অনেক জায়গায় দেখলাম পানির বোতল, পলিথিন আর ফেইস মাস্ক পড়ে আছে। আমরা আর কবে সচেতন হব?

পাহাড়ের কোলে সাধারণত ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকে, তার ওপর শেষ বিকেলে সূর্যের তেজও কমে আসে। কিন্তু আজ এত গরম ছিল, এত উত্তপ্ত ছিল পুরো পরিবেশ যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সবাই। সন্ধ্যার কিছুটা আগেই তাই বাগান থেকে বেরিয়ে এলাম। বাগানের পাশেই দুটো দোকান। একটাতে আনারস, লেবু, কলাসহ বাগানের ফলগুলো বিক্রি হচ্ছে। অন্যটাতে আনারস ভর্তা ও জুস বিক্রি হচ্ছে। আনারস বাগানে এসে আনারস না খেয়ে তো যাওয়া যাবে না। যার যার পছন্দমত আনারসের ভর্তা ও জুস খেয়ে নিলাম। এখানেও দেখলাম ভর্তা ও জুস খেয়ে প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম গ্লাসগুলো সর্বত্র ফেলে পরিবেশ নোংরা করছে লোকজন। অথচ সেখানে ডাস্টবিন ছিল কয়েকটা!

সন্ধ্যা ঘনাতেই ফিরতি পথ ধরলাম। গাড়িতে ওঠে এসির ঠাণ্ডায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ক্লান্তি চলে এলো দেহে, মনে। এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সিলেট শহরে। পেছনে রেখে এলাম একটি মায়াময় বিকেল।

যেভাবে যাবেনঃ ব্যক্তিগত গাড়ি, বাইক বা লোকাল বাসে বাগানে যাওয়া যায়। সিএনজি, মাইক্রোবাস ও কার রিজার্ভ করেও যাওয়া যাবে। সিএনজিতে গেলে ভাড়া পড়বে ৪০টাকা, বাসে গেলে ৩০টাকা। রিজার্ভ সিএনজি ১০০০টাকা ও কার/মাইক্রো ১৫০০-২০০০ টাকার মতো লাগতে পারে। সিলেট কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে গোলাপগঞ্জ চৌমুহনী হয়ে ঢাকাদক্ষিণ বাজারে যাওয়ার পূর্বে ব্র‍্যাক ব্যাংকের (ঢাকাদক্ষিণ শাখা) সামনে এসে নামতে হবে। এখান থেকে বিএনকে সড়ক ধরে আধা কিলোমিটার গেলেই রাস্তার পাশে দেখা যাবে 'চেয়ারম্যান বাড়ি' লেখা গেইট। সেখান থেকে একটু ভেতরে গেলেই দেখা মিলবে বেশ কয়েকটি উঁচু-নিচু টিলা। সেসব টিলাতেই গড়ে তোলা হয়েছে আনারস বাগান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ