প্রতিদিনের মত আজও চা খেতে অফিসের নিচের চায়ের দোকানটাতে গেলেন সাংবাদিক সবুজ রহমান। আশপাশে বেশ কটি চায়ের দোকান থাকলেও এই দোকানের চা খুবই ভালো লাগে তার। রোজ অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে এসে মাথাটা ফ্রেশ করার জন্য এই দোকানে এসে চায়ে চুমুক দেন তিনি। দোকানের নাম দয়াল টি কর্নার। দোকানের মালিক রমিজ মিয়াও ওনার অফিসের সব সাংবাদিকের চেয়ে ওনাকে খাতিরযত্ন একটু বেশিই করে। কারণ আজ পর্যন্ত সবুজ সাহেব এই দোকানে এক টাকাও বাকি খাননি।
রমিজ মিয়ার চায়ের দোকানে অনেক ভীড় থাকে। এজন্য দুটো ছেলে কাজ করে। বেশ কিছুদিন ধরে নতুন আরেকটি ছেলেকে লক্ষ্য করছেন সবুজ সাহেব। ছেলেটির নাম অপু। বয়স ১০/১১ হবে। সাধারণত চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলেদের দেখলেই বোঝা যায় এরা কাজের ছেলে। কিন্তু এই ছেলেটা একটু অন্যরকম। কাজের ছেলে মনেই হয় না। অনেক ভালো ঘরের ছেলে মনে হয়। আচার-আচরণও ভালো। সবুজ সাহেব রোজ ভাবেন ছেলেটির সাথে একটু কথা বলবেন৷ কিন্তু বলা হয় না। তাড়া থাকে। চা টা খেয়েই তাকে অফিসে দৌড়াতে হয়। ফলে কথা বলাটা আর হয়ে ওঠে না।
আজ পঁচিশে মার্চ। দুপুর দুটো বাজে। আগামীকাল স্বাধীনতা দিবসের জন্য একটা স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট ছিল সবুজ সাহেবের। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটা স্টোরি করার কথা। কিন্তু সেটা করতে পারেননি। কারণ ঐ মুক্তিযোদ্ধার বাসায় গিয়ে তাকে পাননি। উনি নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এসে চায়ের দোকানে বসেন তিনি। আজ কী নিয়ে লিখবেন চিন্তা করছেন বসে। এক কাপ চা খেতে খেতে হঠাৎ মনে হলো চায়ের দোকানে আসা নতুন ছেলেটার কথা। আজকে তার সাথে একটু কথা বলাই যায়, যেহেতু হাতে কোনো কাজ নেই।
অপু, এদিকে এসো তো? চা-টা শেষ করেই ডাক দিলেন সবুজ সাহেব।
সামনে থাকা একটি চেয়ার দেখিয়ে সবুজ সাহেব অপুকে বসতে বললেন। কিন্তু সে কিছুতেই বসবে না। অনেক বুঝিয়ে বসাতে পারলেন।
-আচ্ছা অপু, তোমার বাড়ি কই?
-গ্রামের নাম অনন্তপুর স্যার। আর কিছু জানি না।
-মা-বাবা, ভাই-বোন সব আছে স্যার। গ্রামে আছে।
-আমি তাগোরে হারাইয়া ফালাইসি। তাগো কোনো খোঁজ জানি না স্যার।
সবুজ সাহেব শুনে অবাক হলেন। অপু ছেলেটার কাহিনি বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে তার কাছে। রমিজ মিয়াকে ডেকে আনলেন সামনে। আগে রমিজ মিয়ার সাথে কিছু কথা বলা দরকার।
-আচ্ছা রমিজ মিয়া, অপুকে আপনি কোথায় পেলেন?
-স্যার আর কইয়েন না। এই পোলাডা কীভাবে যে এইখানে আইলো আমিও জানি না। একদিন সকালে এসে দোকান খুলতেসি, এমন সময় দেখি দোকানের বারন্দায় একটা পোলা শুইয়া আছে। ভাবলাম, টোকাই মোকাই হবে। কিন্তু ভালো করে দেখে টোকাই মনে হইলো না। পরে তারে ঘুম থিইকা তুইলা জিগাইলাম বাড়ি কই। খালি নিজের নাম, গেরামের নাম, বাপ-মা আর ভাইবোনের নাম কইতে পারে। আর কিছু পারে না। কোন থানা, কোন জেলা, কোন ইউনিয়ন কিচ্ছু কইতে পারে না। ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতেসিল। আমার মায়া লাগে। তাই এখানে কাম দেই আর এখানেই থাকতে দেই। দিনে কাম করে, রাতে এইখানে ঘুমায়। কোন মা-বাপের পোলা, আল্লাহই ভালো জানে স্যার!
রমিজ মিয়ার কথা শুনে অবাক হন সবুজ সাহেব। অপুকে আরও কিছু প্রশ্ন করবেন বলে মনস্থির করেন। রমিজ মিয়াকে ক্যাশে পাঠিয়ে আরেক কাপ চা নেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই জিজ্ঞেস করেন।
-আচ্ছা অপু, তুমি ঢাকা শহরে এলে কীভাবে?
-স্যার আমার মনে নাই সব। খালি মনে আছে, আমি রেলগাড়িতে কইরা আইছিলাম। টেরেইনে উঠসি রাইতের বেলায়, সকালে আইসা নামসি ঢাকায়।
এবার আরও অবাক হন সবুজ সাহেব। একটা ছেলে একা কেন ট্রেনে উঠবে? সে যদি ঢাকায় কোনো কাজে বা বেড়াতে আসে, তার মা-বাবার সাথে আসবে। এই রহস্য জানতেই হবে তাকে!
-আচ্ছা অপু, তোমার গ্রামের বাড়ির কথা মনে আছে কিছু? তুমি কি স্কুলে যেতে সেখানে?
-হ স্যার। আমি আমাগো গ্রামের ইশকুলে চাইর নাম্বার কেলাশে পড়তাম। তয় আমার পড়ালেহা ভাল্লাগতো না। আমার ভাল্লাগতো গাছে চইড়া ফল পাড়তে, পুস্কুনি আর গাঙে গোসল করতে, সাতরাইতে, ব্রিজ থেইকা লাফ দিয়া নদীতে পড়তে, সারাদিন বন্ধুগো লগে মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতে।
-এসব করে বেড়াতে, তাহলে তোমার বাবা-মা তোমাকে কিছু বলতেন না?
-কইত না আবার! একদিন ইশকুল কামাই করলে বাবা বাইন্ধা মাইর দিত। মাও মারত। তয় বাবা বেশি মারত। তাগো কথা হইলো, কোনো খেলাধুলা করইন যাইব না। খালি পড়া আর পড়া। স্যার, এত পড়া ভাল্লাগে কি, আপনিই কন?
-তোমার বাবা কী করতেন অপু?
-বাবার স'মিলের ব্যবসা আছিল। গাছ চিড়াইত।
এবার সবুজ সাহেবের কাছে পরিস্কার হয় বিষয়টা। অপু কীভাবে ঢাকায় এলো তিনি অনেকটাই অনুমান করতে পারেন। খুব সম্ভবত সে রাগ করে পালিয়ে এসেছে। তার পড়াশোনা ভালো লাগত না, খেলাধুলা আর দুরন্তপনায় মেতে থাকা ভালো লাগত। এজন্য মা-বাবার হাতে রোজ মার খেত। এভাবেই একদিন হয়তো সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু ঢাকায় এলো কীভাবে? ট্রেনেই বা উঠল কেমন করে? নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জিজ্ঞেস করলেন-
-আচ্ছা অপু, তোমার গ্রামে কি রেললাইন আছে?
-হ, আছে তো। বাজারের পাশে ইস্টিশন আছে।
এবার সব বুঝে যান তিনি। হয়তো রাগ করে একদিন ঢাকাগামী কোনো একটা ট্রেনে ওঠে পড়েছিল সে। পরে আর ফিরতে পারেনি।
অপুর কথা শুনে এটা পরিস্কার হলো সে আসলে ছোট্ট জীবনে পরাধীনতার শিকলে বন্দী থাকতে চায়নি। সে স্বাধীনতা চেয়েছিল, সে বাবা-মায়ের শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল। কিন্তু নিজের অজান্তেই সে স্বাধীন একটা জগৎ থেকে আবারও পরাধীন জগতে চলে এসেছে! এই চায়ের দোকানে চাকরি করার চেয়ে তো তার গ্রামের জীবন অনেক ভালো ছিল। হয়তো মা-বাবা বেশি শাসন করেছেন তাকে, তবু তো সে জীবনটা এই জীবনের চেয়ে ভালো ছিল। যাই হোক, সবুজ সাহেব আজকের স্টোরি পেয়ে যান। অপুকে নিয়েই কালকে স্টোরি হবে তার।
আচ্ছা অপু, তুমি কি তোমার গ্রামে ফিরে যেতে চাও? বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাও?
-হ স্যার। চায়ের দোকানে কাম করতে ভাল্লাগে না। পাশের গলিতে আমার মত পোলা-মাইয়ারা ইশকুলে যায়, আমার ইশকুলের কথা মনে পইড়া যায়। আমি যদি আবার ইশকুলে যাইবার পারতাম!
-শুনো অপু, তুমি গ্রামের ছেলে। এই শহরের চেয়ে অনেক ভালো পরিবেশে তুমি থাকতে। এই যে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে দেখো, তাদের তো পড়া আর পড়া ছাড়া কিছুই নেই। তুমি তো গ্রামে খেলাধুলা ও পড়াশোনা দুটোই করতে পারতে। কিন্তু তুমি বেশি স্বাধীনতা চেয়েছিলে। স্বাধীনতা মানে কিন্তু যা খুশি তা করা নয়। তোমার এখন পড়াশোনার বয়স, খেলাধুলা করারও বয়স। পড়াশোনা শেষে যে সময় থাকে সে সময় খেলাধুলা করা উচিত, পড়াশোনা বাদ দিয়ে নয়। এই যে শহরের ছেলেমেয়েরা কোনো খেলাধুলার সুযোগই পায় না। কিন্তু তুমি পেতে। সমস্যা হলো তুমি পড়াশোনা বাদ দিয়ে খেলাধুলা করতে বলেই মা-বাবা শাসন করতেন। যদি তুমি বাবা-মাকে ফিরে পাও, অবশ্যই এরপর থেকে তাদের কথামত চলবে।
পরদিন ২৬শে মার্চ, স্বাধীনতা দিবসে পত্রিকার প্রথম পাতায় বক্স আকারে সংবাদ বেরুলো- 'স্বাধীন দেশে পরাধীন অপু ঘরে ফিরতে চায়' শিরোনামে। সাথে অপুর একটা ছবিও। সবুজ রহমান স্টোরিটা কাভার করেছেন মূলত দুটি উদ্দেশ্যে। অপুর মা-বাবা কিংবা আত্মীয়-স্বজনের চোখে পড়লে যাতে সে তাদের কাছে ফিরে যেতে পারে। অপরটি হলো বাবা-মার অতিরিক্ত পড়ার বোঝা চাপিয়ে দেয়ার কারণে বাচ্চাদের জীবনের স্বাধীনতাগুলো কীভাবে নষ্ট হয়, এর প্রতিকার কী- সেগুলোও তুলে ধরা। সম্পাদক সাহেব বেশ গুরুত্ব-সহকারে স্টোরিটা ছেপেছেন।
পরদিন অফিসে বসে কাজ করছিলেন সবুজ সাহেব। হঠাৎ ফোন এলো। অপুর বাবা-মা ফোন করেছেন। অপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাদের সংবাদটা দেখিয়েছেন। গত একটা বছর অপুকে কোথায় কোথায় খুঁজেছেন, সেগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। সবুজ সাহেব তাদেরকে ঢাকায় আসতে বলেন। সেইসাথে অপুকে যেন এখন থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও একটু স্বাধীনতাও দেন সে সম্পর্কেও বলেন। বেশি শাসনে শিশুরা যে বখে যায় সেটাও বোঝান। ওনারা কথা দেন এবার থেকে আর কখনো তার গায়ে হাত তুলবেন না। শাসনের নামে তার স্বাধীনতাও নষ্ট করবেন না।
২৮শে মার্চ দুপুর। অপু কাজ করছিল রমিজ মিয়ার চায়ের দোকানে। হঠাৎ তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় মা-বাবাকে দেখে। আনন্দে তার চোখে পানি চলে আসে। দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের কোলে। এক অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হয় শহরের ব্যস্ত গলিতে। সবুজ সাহেব, রমিজ মিয়া ও আশপাশের অনেকের চোখই এই দৃশ্য দেখে ছলছল করে ওঠে।
0 মন্তব্যসমূহ