শাদারঙের ছোট, বড়, মাঝারি অজস্র পাথর। জমাটবাধা, ছড়ানো-ছিটানো পাথরের স্তুপ। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে স্বচ্ছ, শীতল জলের ধারা। চারপাশে সারি বালুর তপ্ত মরুময় প্রান্তর, পেছনে মেঘালয় পাহাড়। মেঘ আর নীল আকাশের মিতালিতে চোখজুড়ানো অপূর্ব এক মোহনীয় সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ছিল সর্বত্র। একজন প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে এ যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশ। এমনই এক মোহাচ্ছন্ন আবহে পুরো একটা দিন কাটানো শরীর ও মনের জন্য কতটা প্রশান্তিময় তা বর্ণনা করা সহজ নয়। আজ এই সৌন্দর্যের রাজ্যে অবগাহনের গল্পটিই বলবো।
কবি নূরুল নাভেদ। পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক সমকালে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। গত ৮ই জানুয়ারি ছিল তার জন্ম অর্ধশত বার্ষিকী। সে উপলক্ষ্যে তাকে সম্মাননা জানাতে একটা চড়ুইভাতি আয়োজনের পরিকল্পনা করি আমরা। সমাজ ও সংস্কৃতিকর্মী বড়ভাই মনোজ দত্ত, জাহাঙ্গীর খান ও নাট্যনির্দেশক আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে মাত্র সপ্তাহখানেক সময় হাতে নিয়েই কাজে নেমে পড়ি। পঁয়ত্রিশ জনের একটা গ্রুপ রেডি হয়ে যায়। ২৩শে জানুয়ারি সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ শাদাপাথরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই।
ভ্রমণের দিন সকাল আটটায় সবাই শেরপুর জনতা রেস্টুরেন্টে চলে আসেন। আমাদের রিজার্ভ করা বাস ছাড়ে সাড়ে আটটায়। পথ চলতে শুরু করি। গোয়ালাবাজারে গিয়ে রাজভোজন রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতার জন্য থামি। শীতের সকালে ধোয়া ওঠা ভুনাখিচুড়ির সাথে চিকেন এবং চা খেয়ে আবারও বাসে ওঠে পড়ি। বাসের মধ্যে গান, হাসি, আনন্দ চলতে থাকে। সিলেট শহর পেরিয়ে চা বাগানের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিনন্দন এয়ারপোর্ট সড়ক ধরে ভোলাগঞ্জের পথ ধরি। সম্প্রতি সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কের কাজ হয়েছে নতুন করে। আরসিসি ঢালাইয়ে করা পুরো রাস্তাই চমৎকার। ফলে মাত্র তেত্রিশ কিলোমিটার দূরের পথ পেরোতে আমাদের বেশি সময় লাগে না। ভোলাগঞ্জ নৌকাঘাটে গিয়ে দুপুর ১২টার মধ্যেই পৌঁছে যাই।
ভোলাগঞ্জ নৌকাঘাট থেকে শাদাপাথর এলাকায় যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ আধঘন্টা, কিন্তু প্রতিটি নৌকার জন্য ভাড়া গুনতে হয় ৮০০টাকা করে। এটা ফিক্সড করা রেট, নির্ধারিত কাউন্টার থেকে ভাড়া করতে হয় নৌকা। প্রতি নৌকায় ৮জনের বেশি ওঠা যায় না। আমরা নৌকা ভাড়া করে সবাই চড়ে বসি। নৌকায় বসেই সবাইকে কমলা খেতে দেয়া হয়। এই সময়ের কমলা দারুণ মিষ্টি লাগে খেতে। শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকার বিকট শব্দে বিরক্ত হলেও চারপাশের মুগ্ধতা-জাগানিয়া পরিবেশ দেখতে দেখতে ধলাই নদীর বুক চিরে চলে গেলাম শাদাপাথর এলাকায়। কমলার স্বাদ মুখে নিয়ে নেমে পড়লাম নৌকা থেকে পাথরের রাজ্যে।
ভোলাগঞ্জ সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার একটি প্রসিদ্ধ জায়গা।। পাথর কোয়ারির জন্য এই জায়গাটি সারাদেশে আগে থেকেই পরিচিত। সিলেটের জাফলং ও ভোলাগঞ্জ এলাকার পাথর দেশের আনাচে-কানাচে যায়। নির্মাণকাজে এসব পাথর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাথে আছে সারিবালুও। এই ভোলাগঞ্জের সীমান্তবর্তী একটা এলাকা শাদাপাথর নামে পর্যটকদের কাছে সম্প্রতি দারুণ পরিচিতি পেয়েছে। দেশের নানাপ্রান্ত থেকে প্রকৃতিপ্রেমীরা এখানে অবসর সময় কাটাতে চলে আসেন। মেঘালয়ের উৎসমুখ থেকে নেমে আসা পাথুরে নদী ধরলার যেখান থেকে শুরু সেখানেই মূলত শাদাপাথর এলাকা। নদীর স্বচ্ছ জলের শীতলতায় কর্মব্যস্ত জীবনকে একটু চাঙা করতে সবাই ছুটে যায় সেখানে। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে এমন ঠাণ্ডা জলে স্নান করা ও সময় কাটানোই মূলত শাদাপাথরের মূল আকর্ষণ।
শাদাপাথর পৌঁছেই আমরা যে যার মত সময় কাটাতে লাগলাম। কেউ পানিতে গোসল ও সাঁতার কেটে, কেউ পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে ফটোসেশন করে, কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ প্যাডেলচালিত বোট ভাড়া করে সময় কাটালাম। ঠিক দুঘন্টা পর সবাই আবার মিলিত হলাম। ইতোমধ্যেই ক্ষুধা চাগিয়ে ওঠেছে। তাই আর দেরি না করে সাথে করে নিয়ে যাওয়া খাবার দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। বিরিয়ানি, চিকেন, ডিম, সালাদ দিয়ে ভরপেট খাওয়া হলো। খাওয়া শেষে হলো গ্রুপ ফটোসেশন। ফটোগ্রাফার ওখানেই পাওয়া যায়। টাকা দিলেই ডিএসএলআরে ছবি তুলে দেবে। প্রতি ছবি ২-৫টাকা নিয়ে থাকে।
বিকেল হয়ে আসছে, তাই আর দেরি না করে নৌকায় ফিরতি পথ ধরলাম। আবারও দারুণ প্রকৃতি দেখতে দেখতে নৌকাঘাটে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে বাস নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্কে যাত্রাবিরতি করলাম। নির্মানাধীন এই চমৎকার হাই-টেক পার্ক দেশের তথ্যপ্রযুক্তির জগতে একটি মাইলফলক হতে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের দেশে, সেটাকে নেক্সট লেভেল বা পরবর্তী গন্তব্যে নিয়ে যাবে এই হাই-টেক পার্কগুলো। প্রযুক্তিবিশ্বে বাংলাদেশ একসময় জায়ান্টরূপে আবির্ভুত হবে এটা আশা করাই যায়।
হাই-টেক পার্কে ঘোরাঘুরির পর একদম শেষ বিকেলে আমরা পার্কের একটা গেটের সামনে, সিলেট-ভোলাগঞ্জ রাস্তার পাশে মনোরম পরিবেশে সবাই বসে পড়লাম। এবার আমাদের যার সম্মানে এই আয়োজন সেই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব নূরুল নাভেদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, অনুভূতি প্রকাশ করলেন একে একে অনেকেই। জাহাঙ্গীর খানের সঞ্চালনায় সমাজকর্মী মনোজ দত্ত, নাট্যকার ও নির্মাতা যাদব সূত্রধর, কবি বিলাল হোসেন, ব্যবসায়ী জামাল আহমেদ, মিজানুর রহমান বাবলু, মামুন আহমেদ, শিক্ষক বদরুল আলম, শিহাবুর রহমান, আলাউদ্দীন ও এমএস আলম কবি নূরুল নাভেদের ৫০বছর পূর্তির এই আয়োজন নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করেন ও কবিকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। কবির মেয়ে নিশাত তাবাচ্ছুমও বাবার প্রতি নিজের ভালোবাসার প্রকাশ করেন। কবির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। পরে শ্রীহট্ট সাহিত্য সংসদের পক্ষ থেকে সম্মাননা স্মারক কবির হাতে তুলে দেয়া হয়। কবির নিজের অনিভূতি প্রকাশ ও র্যাফেল ড্রর মাধ্যমে পুরো পর্বটি শেষ হয়। পুরো আয়োজনে আরও সাথে ছিলেন ব্যবসায়ী পূর্ণেন্দু পোদ্দার, সিঙ্গার বাংলাদেশের আউটলেট ম্যানেজার টিপু সুলতান, ব্যাংক কর্মকর্তা জাকারিয়া কবির, মানবাধিকারকর্মী নোমান সাদী, গীতিকবি বিধান রায়, মার্কেটিং প্রতিনিধি সৈয়দ আবদাল হোসেন, মুক্তমনা লেখক লিটন দেব জয়, তরুণ নাট্যকর্মী দেবাশিস চৌধুরী, মাসুম আহমেদ, ট্রাভেলার জাকির হোসেন, রনি দেবসহ আরও অনেকে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এবার ফেরার পালা। পুরো
একটি দিনের অনেক মায়াময় স্মৃতিকে পেছনে ফেলে একদল স্বপ্নবাজ মানুষ এগিয়ে চলেছে
নিজের গন্তব্যে, পুরোনো সেই ব্যস্ত জীবনে। ফেরার পথেও সমানতালে গান আর আনন্দ
চলেছে। পথিমধ্যে শীতের সন্ধ্যায় ধুমায়িত চায়ের কাপে ঝড় তুলেছি একাধিকবার। সিঙ্গার
প্লাস শেরপুর আউটলেটের নতুন যোগ দেয়া ব্যবস্থাপক মারুফ সাহেব আয়োজনের শেষবেলায় যে
চায়ের আপ্যায়ন করলেন, সেটাও অনেকদিন মনে থাকবে স্মৃতির মণিকোঠায়।
যেভাবে যাবেনঃ সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে বাস কিংবা সিএনজিতে ভোলাগঞ্জ যেতে পারেন। বিআরটিসির ডাবল-ডেকার বাস নিয়মিত এই রুটে চলাচল করে। এছাড়া ট্যুরিস্ট বাসও চলাচল করে। ভাড়া পড়বে বাসভেদে ৬০-৭০টাকা। সিএনজিতে গেলে জনপ্রতি দিতে হবে ১৫০টাকা করে। চাইলে সিএনজি, লেগুনা, কার ও মাইক্রোবাস রিজার্ভ করে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে দুই থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হবে ভাড়া। ভোলাগঞ্জ নদীঘাট থেকে রিজার্ভ নৌকায় শাদাপাথরে চলে যাবেন।
কোথায় থাকবেনঃ সিলেট শহর থেকে মাত্র ৩৩কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ভোলাগঞ্জে থাকার প্রয়োজন নেই। সিলেট শহরের সর্বত্রই অসংখ্য হোটেল-মোটেল আছে। সবধরনের ক্যাটাগরির রুমই পাওয়া যাবে।
কোথায় খাবেনঃ খাবার সাথে করে নিয়ে না গেলে ভোলাগঞ্জেই বেশকিছু
রেস্তোরাঁ আছে। সেখানেই খাওয়া যাবে। তবে চাইলে সিলেট শহরে এসে পাঁচভাই, পানসীর মত
রেস্টুরেন্টের চমৎকার সব ভর্তার স্বাদও নিতে পারেন।
0 মন্তব্যসমূহ