সিনেমাঃ জানোয়ার
পরিচালকঃ রায়হান রাফি
IMDB: ৮/১০
ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৮/১০
মানুষ কখন জানোয়ার হয়? মানুষ কখন মনুষ্যত্ব ভুলে যায়? কী তার কারণ? অনুসন্ধান করে হয়তো অনেক অনেক কারণ বের করা যাবে। কিন্তু যারা মানুষ নামক জানোয়ারদের হিংস্রতা, পাশবিকতা আর বর্বরতার শিকার হয়, তাদের কাছে এসব অনুসন্ধানের কোনো কানাকড়িও মূল্য থাকে না। তাদের অন্তরাত্মা শুধু বিচার চায়, মুক্তি চায় জাগতিক সকল বন্ধন থেকে।
আমাদের দেশ বরাবরই অপরাধপ্রবণ। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি দেশই তাই। রাত পোহালেই এখানে পত্রিকা, টেলিভিশনে বড় বড় অপরাধের খবর দেখে আমরা অভ্যস্ত। কোনো কোনো ঘটনা আমাদেরকে নাড়া দেয়, কোনো কোনো ঘটনা চোখেই পড়ে না। গত বছরের এপ্রিলে গাজীপুরে ঘটেছিল এমনই একটি মর্মান্তিক ঘটনা, যেটি আলোড়িত হয়েছিল দেশজুড়ে। একই পরিবারের চারজনকে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছিল রাতের আঁধারে। মানুষরূপী হিংস্র কিছু জানোয়ার ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই পরিবারের ওপর। নির্দয়ভাবে পুরো পরিবারের ভবলীলা সাঙ্গ করেছিল তারা। আর এই ঘটনাটিকেই উপজীব্য করে পরিচালক রায়হান রাফি নির্মাণ করেছেন একটি ওয়েবফিল্ম, জানোয়ার যার নাম।
একটি সুখী পরিবার। মা, দুই মেয়ে এবং একটি অটিস্টিক ছেলে। পরিবারের কর্তা দেশের বাইরে থাকেন। এই করোনাকালে সবার মত এই পরিবারটিও লকডাউনে। এই অবস্থায় পরিবারের ছোট মেয়ে হাওয়ারিনের জন্মদিন আসে। করোনার জন্য বড় পরিসরে না হলেও জন্মদিন ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়। বড় মেয়ে নুরা সবকিছু সাজায়, ছোটবোনকে চমকে দেবে বলে। হাওয়ারিনের জন্মদিন শুরু হওয়ার আগেই তাদের পরিবারে নেমে আসে রোজ কেয়ামত। একদল ডাকাত ঢুকে পড়ে বাসায়। ডাকাতি করতে এসে টাকা, সোনাদানা লুটে নেয় প্রথমে। পরে পাশবিকতার চূড়ান্ত প্রদর্শন করে। মা ও দুই মেয়ের সম্ভ্রম লুটে নেয়। তাতেও ক্ষান্ত হয় না তারা। সবাইকেই জবাই করে ফেলে। এমনকি অটিস্টিক বোবা শিশুটাকেও রেহাই দেয় না!
আগেই বলেছি এটা সত্য ঘটনা। এমন পাশবিক কিংবা এরচেয়ে নির্মম সব ঘটনাও আমাদের দেশে ঘটেছে অতীতে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে চলচ্চিত্র হয় খুব কমই। রায়হান রাফিকে এজন্য ধন্যবাদ দিতেই হয় যে এমন ঘটনাকে পর্দায় এত সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন।
এই ওয়েব ফিল্মে খুব বড় কোনো অভিনেতা অভিনয় করেননি। মোটামুটি পরিচিত হিসেবে তাসকিন রহমান ও রাশেদ মামুন অপুকেই আমরা চিনি। বাকিদের অনেকেই চেনেন না। কিন্ত এই প্রায় অচেনা একটি ইউনিটের সবাই যেভাবে নিজেদের সেরাটা দিয়েছেন, তাতে অবাক হয়েছি খুব। বিশেষ করে রাশেদ মামুন অপুর কথা না বললেই নয়। ডাকাতদলের প্রধান হিসেবে তিনি যা দেখিয়েছেন এতে মুগ্ধতা ছিল ভীষণ। এতদিন রাজশাহীর 'তোতা মিয়া' হিসেবে যাকে চিনতাম আমরা, তিনি এরকম একটা সিরিয়াস চরিত্রে এত অসাধারণ অভিনয় করবেন সেটা ছিল কল্পনারও বাইরে। ডাকাতদলের বাকি সদস্যরাও দারুণ অভিনয় করেছেন। নিজেদের সেরাটা দিয়ে একদম ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন। পরিবারের গৃহিণী হিসেবে এলিনা শাম্মী, বড় মেয়ে হিসেবে মুনমুন আহমেদ, ছোট মেয়ে হিসেবে আরিয়া অরিত্র ও অটিস্টিক ছেলের চরিত্রে তানজিদ হোসাইন আকাশ সবাই সপ্রতিভ ছিলেন। একটা পরিবারের মত মিশে গিয়েছিলেন তারা পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে। বিশেষ করে মুনমুন আহমেদ ও এলিনা শাম্মীর কথা না বললেই নয়। ডাকাতদলের সাথে তাদের অভিনয় ছিল সমানতালে, দুর্দান্ত। ছোট মেয়ের চরিত্রে অরিত্র একটু ন্যাকামি করলেও, মাঝে মাঝে ওভার-অ্যাকটিং করলেও সেগুলো বাচ্চা হিসেবে মানিয়ে গেছে। তবে পুলিশের ইনগেস্টিগেশন অফিসার হিসেবে তাসকিন হতাশ করেছেন কিছুটা হলেও। ঢাকা অ্যাটাকের সেই দুর্দান্ত তাসকিনকে এখানে খুঁজে পাইনি মোটেও। পুলিশের একজন তদন্ত কর্মকর্তা যেভাবে রক্ত দেখে, ঘটনাটা কল্পনা করে শিউরে উঠছিলেন, বমি করতে চাচ্ছিলেন এটা অনেকটাই বেখাপ্পা লেগেছে। কারণ বাংলাদেশে পুলিশ হিসেবে কাজ করলে এগুলো অহরহ দেখতে হয়। তাই পুলিশ এতটা দুর্বল হয়ে পড়লে সেটা অস্বাভাবিক লাগে। তবে ঘটনা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে স্ত্রীকে ফোন করে নিজের পরিবারের খোঁজ নেয়াটা প্রমাণ করে, সবকিছুর শেষে পুলিশও মানুষ৷ তাদেরও পরিবার-পরিজন আছে, যাদের জন্য তারাও চিন্তিত থাকেন।
চলচ্চিত্রটির সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার ছিল। পুরো সিনেমাই আলো-আঁধারিতে দৃশ্যায়ন করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কালার গ্রেডিং আরেকটু ভালো হওয়া উচিত ছিল। তবে সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং 'যাক দিন' শিরোনামের গানটা অসাধারণ লেগেছে। গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীকে এক্ষেত্রে বিশেষ ধন্যবাদ দেয়াই যায়। নিউজে দেখলাম কাহিনির প্রয়োজনেই সিনেমার বেশিরভাগ শটই ওয়ান টেকে নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের প্রচুর পরিশ্রম ছিল বোঝাই যায়। পরিশ্রমটা সার্থক হয়েছে বলতে হয়।
রায়হান রাফি নির্মিত বেশিরভাগ কাজই দেখেছি। পরিচালক হিসেবে ওনার আবির্ভাব বেশিদিন আগের নয়। পারফেকশনিস্ট যাকে বলে সেটা এখনও নন তিনি। তবে তার চলচ্চিত্রে সমাজ-সচেতনতা ও বিষয় বৈচিত্র অনেক। জানোয়ারও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে কিছু আক্ষেপ থেকেই গেছে। যেমন কাহিনিটা সরলভাবে বলে গেছেন। সত্য ঘটনাটি হুবহু না দেখিয়ে মূল ঘটনা ঠিক রেখে কাহিনিতে কিছু টুইস্ট, ক্লাইম্যাক্স, থ্রিল যোগ করলে আরও ভালো লাগত। সামনে এরকম সত্য ঘটনা নিয়ে কাজ করলে কাহিনিকে আরেকটু সিনেম্যাটিক করবেন আশা রাখি। তবে আরও কিছু ব্যাপার না বললেই নয়। সিনেমায় ধর্ষণের মত দৃশ্যগুলো শরীর না দেখিয়ে, খুনের মত দৃশ্যগুলো রক্তের ফোয়ারা না ছুটিয়েও ভয়ঙ্করভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন পরিচালক। সংলাপে প্রচুর স্ল্যাং থাকায় অনেক বেশি বিপ ব্যবহার করেছেন, যা কানে লাগছিল। এক্ষেত্রে হয় স্ল্যাং কমিয়ে সংলাপ লেখা যেত, নয়তো বিপ আরও কমানো যেত। যেহেতু ওয়েব ফিল্ম, খুব সমস্যা হতো না। যাই হোক, রায়হান রাফির ওপর দেশি সিনেমার দর্শকদের যে আস্থা তৈরি হয়েছে তার প্রতিদান দিতে সামনে আরও ভালো ভালো কাজ উপহার দেবেন নিশ্চয়ই।
জানোয়ার কেন দেখবেন? কারণ জানোয়ার আমাদের দেশের গল্প, সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। লোভের কারণে সাধারণ কিছু মানুষও যে অমানুষ হয়ে উঠতে পারে তারই কাহিনি হলো জানোয়ার। একজন রিকশাচালক, একজন ট্রাক ড্রাইভার আর একেকজন কর্মক্ষম মানুষ অল্পতেই লাখ লাখ টাকা রোজগারের নেশায় একইসাথে ডাকাত, খুনি ও ধর্ষক কীভাবে হয়ে যায় সেটা জানতে হলেও জানোয়ার দেখতে হবে। আবার ধর্ষণের পর খুন করতে গিয়ে একেকজন যখন ভয়ে কুকড়ে যায়, স্বয়ং দলপ্রধানই বলে 'আমি কি কখনো খুন করেছি রে? ট্রাক চালাতে গিয়ে কুকুরকে চাপা দিয়ে তিনদিন ঘুমাতে পারিনি!' তখনই বোঝা যায় যে অপরাধী কখনো জন্ম থেকে তৈরি হয়ে আসে না। ঘটনায় পারিপার্শ্বিকতা মানুষকে অপরাধী বানিয়ে দেয়। জানোয়ারই তার বাস্তব উদাহরণ।
সিনেম্যাটিক নামক নতুন ওটিটিতে রিলিজ হয়েছে
জানোয়ার। একদিনের সাবস্ক্রিপশন নিয়ে মাত্র দুই টাকা খরচ করে দেখা যাচ্ছে ওয়েব
ফিল্মটি। হয়তো আপনার ভালো লাগবে, হয়তো খারাপ। কিন্তু দেশি সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখতে
মাত্র দুই টাকা খরচ করে সিনেমাটি দেখলে পরিচালক-প্রযোজককে আরও ভালো কাজ করতে উৎসাহ
যোগাবে নিশ্চিত।
0 মন্তব্যসমূহ