পদ্মাসেতুর শেষ স্প্যানঃ স্বপ্নপূরণের পথে বাংলাদেশ

আজ বসানো হলো পদ্মাসেতুর ৪১তম স্প্যান। সেইসাথে দৃশ্যমান হলো পুরো সেতুটাই। এখন শুধু সময়ের পালা। আগামী এক বছরের মধ্যে এই সেতুতে গাড়ি চলবে, এরপর চলবে ট্রেনও। সে অপেক্ষায় এখন জাতি।

একটি সেতু কীভাবে একটি জাতির স্বপ্ন হতে পারে সেটা পদ্মা সেতুই বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের। বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী এই পদ্মা (অ্যামাজন প্রথম)। এই নদীতে সেতু তৈরি করা যাবে কেউ ভাবতে পারেনি একসময়। বিশ্বের নামিদামি সব কোম্পানি নদীটি দেখে বলে অসম্ভব। মানা করে দেয় তারা। অনেক দেন-দরবারের পর অবশেষে বিশ্বব্যাংক রাজি হয় সেতুর অর্থায়নে। কিন্তু একজন নোবেল-বিজয়ী তার বান্ধবী হিলারি ক্লিনটনের মাধ্যমে তাতে বাগড়া দেন। নজিরবিহীন বিরোধিতার মাধ্যমে নিজের দেশের উন্নয়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া পৃথিবীর প্রথম নোবেল বিজয়ী হওয়ার 'গৌরব' অর্জন করেন তিনি। ঋণের কোনো টাকা না দেয়ার আগেই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋণ স্থগিত করে। বিশ্বব্যাংকের এমন নজিরবিহীন ও নিয়মবহির্ভূত ঋণ আটকে দেয়ায় হতভম্ব হয়ে যায় বাংলাদেশ। তাদেরকে খুশি করতে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু তাতেও মন গলে না বিশ্বব্যাংকের। হিলারি-ইউনুস গংয়ের চাপে তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে।

এরপর ঘটে আরেকটি নজিরবিহীন ঘটনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ ঘোষণ দেন নিজেদের টাকায় হবে পদ্মাসেতু। শুনে অনেকেই হাসে, ট্রল করতে শুরু করে। স্বয়ং মন্ত্রীসভার অনেকেই বিশ্বাস করে না কথাটা। কিন্তু শেখ হাসিনার শরীরে বঙ্গবন্ধুর রক্ত বইছে। হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে যিনি স্বাধীনতা দিতে পারেন, তার মেয়ে তো হেরে যেতে পারেন না।

শুরু হলো নানা উদ্যোগ। কাজ পেলো চীনের বিশ্বখ্যাত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'চায়না মেজর ব্রিজ'৷ নদীদশাসনের কাজ পেলো চীনেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোতে লাগল কাজ। ২০১৭সালে বসে গেলো প্রথন স্প্যান। তখনই মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল পদ্মাসেতু সত্যিই হচ্ছে। তিন বছরের ব্যবধানে আজ সবগুলো স্প্যান বসে গেলো। আমাদের অতি গর্বের সেতুটি দাঁড়িয়ে গেলো মাথা উঁচু করে।

সেই বিশ্বব্যাংকও একসময় ফিরতে চাইল। কানাডার আদালতে প্রমাণ হয়ে গেলো বাংলাদেশে পদ্মাসেতু নিয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি। উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া তথ্যে বেরিয়ে এলো ইউনুস-হিলারি গংয়ের ষড়যন্ত্রের কথা। নাকে খত দিয়ে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর টাকা অন্য প্রজেক্টে বিনিয়োগ করতে চাইল। কিন্তু শেখ হাসিনা অনড়। এখন বিশ্বব্যাংকও জানে 'বাঘে ধরলে ছাড়ে শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না'।

পদ্মাসেতু নিয়ে এখনও অনেক 'পাকিস্তানি বংশদ্ভূত বাংলাদেশি' ট্রল করে। একেকটি স্প্যানের নিউজের নিচে আমরা দেখি তাদের ট্রলের বহর। এগুলো দেখলে আমরা হাসি। কারণ তাদের কেন জ্বলে, কোথায় জ্বলে আমরা ভালো করেই জানি। দেশের উন্নয়ন তারা সহ্য করতে পারে না কারণ তাদের প্রিয় দল ক্ষমতায় নেই। তাদের কাছে দেশের উন্নয়ন কিছু না, ক্ষমতায় থাকাটাই সব। তাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে যেভাবে পদ্মাসেতু হলো, সেভাবে হবে মেট্রোরেল, পাতাল রেল, মহাসড়কের ৬/৮/১০লেন, বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অসংখ্য উন্নয়ন। আমরা কোনো দল না করলেও এসব উন্নয়নকাজের জন্য শেখ হাসিনাকে বাহবা দিই। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও তিনি যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন সেটা বাহবা পাবার যোগ্য।

এসব উন্নয়নের সাথে আরও চ্যালেঞ্জ আছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। নইলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশকে বিশৃঙ্খলামুক্ত, শান্তির জন্য একটি মডেলে দেশে পরিণত করতে হলে সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। সেগুলো কীভাবে মোকাবেলা করবে বাংলাদেশ সেটাই এখন দেখার বিষয়।

পদ্মার ওপারে যারা থাকেন তাদের কাছে এই সেতুটি একটি আবেগের নাম। তারা জানেন একটি সেতু না থাকায় কীভাবে তাদের জীবনযাত্রা থমকে যায়। তারা জানেন কীভাবে দুই ঘন্টার পথ বিশ ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করেন। আমরা যারা এটার ভুক্তভোগী নই তারা জীবনেও বুঝতে পারবো এর যাতনাটা। কিন্তু প্রমত্তা পদ্মা দিয়ে যারা জীবনে একবার হলেও চলাচল করেছি, তারা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারি সেই যন্ত্রণাটা। পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন তাই স্বপ্নের এক মহাসীমানায় পৌঁছে যাওয়ার নাম।

পদ্মাসেতু দেশের অর্থনীতিতে বদলে দেবে। জিডিপি বাড়বে পদ্মার ওপারের অঞ্চলে ৩ভাগ, সারাদেশে অন্তত ১ভাগ। এই সেতুটি তাই বাংলাদেশকে পৌঁছে দেবে নেক্সট লেভেলে, পরবর্তী গন্তব্যে।

আমাদের নিজের টাকায় এই স্বপ্নপূরণের জন্য ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধন্যবাদ দেশের মেহনতি মানুষকে। যাদের ঘামে আর শ্রমে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল একটি জাতির স্বপ্ন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ