মাহমুদুন্নবীঃ সুরের ভুবনে অভিমানী পথচারী


পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে তৎকালীন পূর্ব- পাকিস্তানের মফস্বল শহর ফরিদপুর থেকে এক কলেজপড়ুয়া তরুণ হঠাৎ করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য গান শিখবেন, সংগীতের সুবিশাল আকাশে থরে থরে সাজানো অসংখ্য নক্ষত্ররাজির মধ্যে জায়গা করে নেবেন। প্রথমে চট্রগ্রামে, এরপর ঢাকা এবং সেখান থেকে মাত্র তিনশ টাকাকে সম্বল করে সোজা করাচি। একসময় সেই তরুণটি উর্দু সিনেমা থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমা সবজায়গায় নিজের সংগীত-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে লাগলেন। মানুষের হৃদয়ে গান দিয়ে জায়গা করে নিলেন চিরস্থায়ীভাবে। হয়ে গেলেন বাংলাদেশের এক কিংবদন্তি শিল্পী। যাকে সবাই চিনত মাহমুদুন্নবী নামে।

বাংলা সংগীত বরাবরই সমৃদ্ধ। পৃথিবীর নানা ভাষার গান নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা বাংলা গান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে একবাক্যে স্বীকার করেন, বাংলা গানের মত বৈচিত্রময় গানের ভাণ্ডার পৃথিবীর খুব কম ভাষার গানেই আছে। জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, পালাগান, বাউল গান, লোকগান, মুর্শিদি, গাজির গীত, লালন, হাছন, রবি, নজরুল থেকে শুরু করে ব্যান্ড, আধুনিক এমনকি ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতেও বাংলা গানের তুলনা হয় না। বাংলার মাটি বরাবরই তাই সংগীতের উর্বর জমিন। সেই উর্বরতা থেকে জন্ম নেয়া অসংখ্য সংগীত-সাধকের মধ্যে একজন হলেন মাহমুদুন্নবী।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের চর্চা শুরু হয় পপগুরু আজম খানের হাত ধরে। একসময় জোয়ার সৃষ্টি হয় ব্যান্ডের। নব্বই দশকে এসে সে জোয়ার পূর্ণতা পায়। কিন্তু ব্যান্ডের জোয়ারের আগে থেকেই এখানে আধুনিক মেলোডি গানের চাহিদা ছিলো ব্যাপক, বিশেষ করে বাংলা সিনেমার গানগুলো তখন মুখে মুখে ফিরত মানুষের। ব্যান্ডের জোয়ার এসেও সে চাহিদায় এতটুকু ঘাটতি ফেলতে পারেনি। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত আধুনিক গান ও চলচ্চিত্রের গানের স্বর্ণযুগ বলা যায়। অনেক কিংবদন্তি শিল্পীর জন্ম হয়েছে সে সময়টাতে। তার মধ্যে মাহমুদুন্নবী ছিলেন অন্যতম।

বাংলা সিনেমায় নায়করাজ একজনই। তিনি রাজ্জাক। তার যতগুলো কালজয়ী সিনেমার কালজয়ী গান আছে, তার মধ্যে বেশিরভাগ গানই গেয়েছেন মাহমুদুন্নবী। 'আয়নাতে ঐ মুখ', 'তুমি যে আমার কবিতা', 'গানেরই খাতায় স্বরলিপি', 'প্রেমের নাম বেদনা', 'ও মেয়ের নাম দেব কী', 'গীতিময় সেইদিন চিরদিন', 'তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ'সহ আরও অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় ও কালজয়ী গানে রাজ্জাক ঠোঁট মিলিয়েছিলেন মাহমুদুন্নবীর গানে। তাই বলা যায় মাহমুদুন্নবী আর রাজ্জাক মানেই ছিল সুপারহিট গানের এক চমৎকার কম্বিনেশন। গানের নেশায় ঘরপালানো এক গায়ক একদা তাই হয়ে উঠলেন ঢালিউডের সংগীত-মহীরুহ। যার জন্য গান লিখতেন ও সুর করতেন সব খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক, যার দরাজ গলার গান ও বিশুদ্ধ উচ্চারণ শুনে মুগ্ধ হতেন দর্শক-শ্রোতা থেকে শুরু করে সংগীত-বোদ্ধারাও। যাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর জন্য পাগল হয়ে থাকতেন বাঘা বাঘা সব প্রযোজক-পরিচালক এবং যার গানে ঠোঁট মেলাতেন জনপ্রিয় ও নন্দিত অভিনেতারা, তিনিই ছিলেন মাহমুদুন্নবী।

আধুনিক বাংলা গানের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্ম ব্রিটিশ ভারতে, ১৯৩৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের নানাবাড়িতে জন্ম নিলেও দাদাবাড়ি কেতু গ্রামে বড় হতে লাগলেন। কিন্তু সাতচল্লিশের দেশভাগের পর বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে পাড়ি জমান এপার বাংলা তথা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে। ফরিদপুরে এসে নতুন করে শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। শৈশব-কৈশোরে ডানপিটে ছিলেন ভীষণ। পাড়ায় পাড়ায় দাপিয়ে বেড়ানো আর এর-ওর গাছের ফল পেড়ে খাওয়া ছিলো নিত্যদিনের অভ্যেস। ফুটবল খেলতে দারুণ ভালোবাসতেন। কিন্তু গান ছিলো তার প্রথম পছন্দ। তখনকার সময়ে রেডিওতে গান শুনে শুনে প্র‍্যাকটিস করতেন আর গাইতেন গুনগুন করে। তারপর স্থানীয় এক ওস্তাদের কাছে নিতে শুরু করেন গানের তালিম। গান আর ফুটবল চলছিল সমানতালে। একদিন কলেজের এক স্যার বলে বসেন 'এত ভালো গাও, একদিন তুমি বড় শিল্পী হবে। কিন্তু ফুটবল খেললে তো বাবা গলা নষ্ট হয়ে যাবে!' সেদিনই খেলা ছেড়ে দিলেন। গানেই মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসছিল। হঠাৎ মাহমুদুন্নবীর মনে হলো পড়াশোনার চেয়ে গানে বেশি মনোযোগ দেবেন। পালিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। প্রথমে চট্রগ্রাম ও পরে ঢাকায় চলে গেলেন। ঢাকায় তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ওস্তাদ গফুর খাঁ তাকে গান শেখানোর দায়িত্ব নিলেন। সেখান থেকে আস্তে আস্তে গান শিখতে ও গাইতে লাগলেন, বাড়তে থাকল পরিচিতি। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গান গাইতে গিয়ে নজরে পড়ে যান গণসংগীত শিল্পী শেখ লুৎফুর রহমানের। তিনি থাকতেন করাচি। তার কাছে সাহায্য চাইলেন, বায়না ধরলেন করাচি যাওয়ার। ওনার সাহায্যে করাচি গিয়ে গাইতে শুরু করলেন গান। রেডিওতে প্রথমে গাইলেও পরে সুযোগ পেলেন উর্দু ছবিতে গাওয়ার। প্রথমেই গাইলেন 'জিনে ভি দো’ ছবিতে। এরপর ‘পিয়াসা’, ‘উলঝান’সহ আরও কিছু ছবিতেও কণ্ঠ দিলেন। মোটামুটি পরিচিতি পেতে থাকলেন, ডাক আসতে থাকল বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও।

একসময় উপলব্দি করলেন দেশে এসে দেশের মানুষের জন্য গান করবেন। ফিরে এলেন ঢাকায়। ষাটের শুরুতেই একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমার গানে কণ্ঠ দিতে থাকলেন, গাইতে থাকলেন রেডিওতে। 'আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে', 'সুরের ভুবনে আমি আজও পথচারী', 'ওগো মোর মধুমিতা', 'আমি ছন্দহারা এক নদীর মত', 'বড় একা একা লাগে তুমি পাশে নেই বলে', 'এই স্বপ্নঘেরা দিন রাখব ধরে', 'সালাম পৃথিবী তোমাকে সালাম', 'মনে তো পড়ে না কোনোদিন', 'আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই', 'ওগো রূপসী তোমারে ভালোবেসেছি', 'এক অন্তবিহীন স্বপ্ন ছিলো'সহ আরও অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলা সংগীতের ভুবনে যে উচ্চতায় যাওয়া অনেকের কাছে শুধু স্বপ্নই নয়, চরম আরাধ্যও।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাগরণী অনেক গান গেয়ে, লিখে, সুর করে উজ্জীবিত করেন জাতিকে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন আর সংগ্রামে নিজের সুর আর কণ্ঠকে ব্যবহার করে রাখেন অসামান্য অবদান। শুধু গান নয়, লেখার হাতও ছিলো তার দারুণ। একসময় নিয়মিত রম্য লিখতেন বিভিন্ন পত্রিকায়ও। সেই সাথে গানও লিখতেন সমানতালে। দুর্দান্ত এক প্রতিভা ছিলেন তিনি তাতেই বোঝা যায়।

স্বাধীনতার পর আরও দোর্দণ্ড প্রতাপে গাইতে থাকেন। স্বমহিমায় ভাসতে থাকেন মহাকালের সাফল্যের নৌকায়। কণ্ঠের জাদুতে, বিপ্লবী সুরের মোহ-মায়ায় আবেগের খেয়ায় ভাসাতে থাকেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালি জাতিকে। যার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৬ সালে 'দি রেইন' ছবিতে ‘আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই’ গানটির জন্য
 পেয়ে যান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এরপর "আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কেন সৈকতে পড়ে আছি” এই গানটির জন্য মনোনীত হন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকের জন্য। কোনো এক রহস্যময় কারণে তাকে পুরস্কারটি দেয়া হয়নি তখন। এরপর আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন সংগীতের জগৎ থেকে। যখন তার শ্রেষ্ঠ সময়, জাতিকে দেয়ার কথা আরও অনেক কিছু তখনই আড়ালে চলে যান তিনি। গানের জন্য সংসার, চাকরি সব ছেড়ে আসা লোকটি আবারও ডুবে যান সংসারে, গান হয়ে যায় অপাঙক্তেয়, অনাদৃত।

সংসারজীবনে বিয়ে করেন খালাতো বোন রাশিদা চৌধুরীকে। তাদের ঘরে জন্ম নেয় চার সন্তান। তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তারা হলেন কন্ঠশিল্পী
 সামিনা চৌধুরী, 
ফাহমিদা নবী, রিদওয়ান নবী পঞ্চম ও তানজিদা নবী। এরমধ্যে দুই কন্যা সামিনা ও ফাহমিদা তো বাংলা গানের একেকজন জীবন্ত কিংবদন্তি। যাদের গানে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পুত্র পঞ্চমও দারুণ গান করেন, যদিও তিনি নিয়মিত নন। ১৯৯০ সালের ২০শে ডিসেম্বর মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এই সুরের জাদুকর।

আজন্ম লালিত ছিলেন গানের জন্য, গানকেই বানিয়েছিলেন নিজের সাধনার ধন। শুধু গাওয়া নয়, গান শেখানোর জন্য একসময় গড়েছিলেন আধুনিক সংগীত নিকেতনও। অথচ হঠাৎই গান ছেড়ে দিলেন তিনি! কেন নিজের শিল্পীসত্তাকে ভুলে গিয়ে অকস্মাৎ আড়ালে চলে গেলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে অভিমানের প্রসঙ্গটাই আগে আসে। একুশে পদক ঘোষণা করেও তাকে না দেয়াটাকে মেনে নিতে পারেননি হয়তো মন থেকে। শিল্পীরা কখনো পদকের লোভে গান করেন না। কিন্তু পদক ঘোষণা করে না দেয়াটা শুধু শিল্পী নয়, যে কোনো মানুষের জন্যই চূড়ান্ত অসম্মানজনক। এই অপমান সহ্য করতে পারেননি বলেই বোধহয় মানে মানে সরে যাওয়াটাকেই নিয়তি করে নিয়েছিলেন। সৃষ্টিশীল মানুষেরা বরাবরই প্রচণ্ড অভিমানী হন, মাহমুদুন্নবীও তাই ছিলেন। অভিমানী মন নিয়ে তাই একদা গেয়েছিলেন-

"সুরের ভুবনে আমি আজও পথচারী
ক্ষমা করে দিও যদি না তোমার
মনের মত গান শোনাতে পারি

গানের ভাষা আর প্রাণের ভাষা
একই বৃন্তে আজও বাঁধেনি বাসা
তাই তোমাদের আসর ছেড়ে
মনটা হতে চায় ফেরারী

কী বা আছে বলো দেবার মত
সংকোচে তাই আমি অবনত
আছে শুধু মোর ভালবাসা
তাই দিয়ে যেতে চাই উজাড় করি"


হারজিৎ ছবিতে কিংবিদন্তি সংগীত পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও সত্য সাহার সুরে গানটি গেয়েছিলেন তিনি। যে গানে অভিমান ছিলো; ছিলো ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু দিতে না পারার অক্ষমতাও। কিন্তু আমরা তো তাকে দিতে পারি অনেক কিছুই। আজ অনেকেই মরণোত্তর পুরস্কার পান, গানের বেসিক না জানা অনেক সফটওয়্যার শিল্পীকেও দেখি বড় পদক বাগিয়ে নিতে। আমরা কি পারি না আমাদের দেশকে যিনি এতকিছু দিলেন, সেই লিজেন্ড মাহমুদুন্নবীকে মরণোত্তর সম্মাননা দিতে? যাদের দেখানো পথে হেঁটে আজ বাংলা সংগীত এত সমৃদ্ধ, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক তাদের জন্য নিশ্চয়ই খুব বেশি কিছু নয়! রাষ্ট্র নিশ্চয়ই একদিন পৃথিবীর ওপারে থাকা সুরের ভুবনের এই অভিমানী পথচারীর মান ভাঙাতে উদ্যোগ নেবে। আমরা তাই আশায় বুক বেঁধেই রাখতে চাই।

এই প্রজন্মের অনেকেই জানে না মাহমুদুন্নবী সম্পর্কে। যদিও সামিনা চৌধুরী ও ফাহমিদা নবী দুজনে পিতার গান নিয়ে দুটি অ্যালবাম করেছেন একসময়, কিন্তু সেগুলোও অনেক বছর আগে। এ প্রজন্মের অনেকে তাই শুনেনি তার গান। তার অসংখ্য গান শুনে অনেকে মুখস্ত করে, গায়ও। কিন্তু জানে না গানটির মূল শিল্পী কে। আমাদের নতুন শিল্পীরা যদি ওনার গানগুলো গাওয়ার সময় গীতিকার, সুরকারের সাথে মূল শিল্পীর নামটি বারবার উচ্চারণ করেন তাহলে এই প্রজন্মের শ্রোতারাও জানতে পারবেন তার কীর্তি সম্পর্কে। সেইসাথে মিডিয়াও তার ব্যাপারে মৌনতা ভেঙে তাকে নিয়ে কাজ করবে এটাও একান্তভাবে কাম্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ