অতীত ইতিহাসের গল্পে আমরা পড়েছিলাম আমাদের একসময় গোলাভরা ধান ছিল, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু ছিল। আমাদের কোনো অভাব-অনটন ছিল না। উলটো আমরা ছিলাম সমৃদ্ধ একটি জাতি। কিন্তু আমাদের বিবর্ণ বর্তমানকে অতীতের সাথে মেলালে অনেকের কাছেই ইতিহাসের সেই গল্পগুলোকে রূপকথা মনে হয়। আসলেই কি সেটা রূপকথা নাকি বাস্তব? যারা ইতিহাসের অনুসন্ধান করেন, খুঁজে বেড়ান হাজার বছরের পুরোনো গতিপথ, তারা বরাবরই আমাদের সমৃদ্ধ অতীতের বাস্তবতার কথাই বলেন। সেই ইতিহাসের অনুসন্ধানেই সম্প্রতি আমরা গিয়েছিলাম প্রাচীন বাংলার রাজধানীখ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়। আজকে লিখতে বসলাম সে ভ্রমণেরই কিছু উপাখ্যান।
সোনারগাঁ ভ্রমণের ইচ্ছেটা অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু সময় ও সুযোগ
সেই ইচ্ছেটাকে এতদিন বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। আমাদের সিলেটেরই জনপ্রিয় একটি ভ্রমণ
গ্রুপ যখন সোনারগাঁ ভ্রমণ আয়োজনের ঘোষণা দিলো, সাথে সাথেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম।
এবার আর মিস করা যাবে না ভেবে আরেকজন ভ্রমণসঙ্গীসহ নিবন্ধন করে ফেললাম দ্রুতই।
সোনারগাঁয়ের প্রাচীন
ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। সোনারগাঁ ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের
একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। মধ্যযুগীয় এই নগরটির যথাযথ অবস্থান নির্দেশ করা খুবই কঠিন।
বিক্ষিপ্ত নিদর্শনগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটি পূর্বে মেঘনা নদী, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা
নদী, দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা
বেষ্টিত একটি বিস্তৃত জনপদ ছিল।
ঐতিহাসিক সোনারগাঁ শুধু দেড়শ বছরের পুরোনো স্মৃতি বিজড়িত ধ্বংসাবশেষ
নগরীই নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে একটি স্বাধীন জাতির আত্মশ্লাঘা ও আত্মপরিচয়ের অনুভূতিও।
ইতিহাসের আবহমান ধারায় অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যে অনভূতি হয়েছে আরও সুদৃঢ়।
সোনারগাঁ আজ এমন একটি নামে পরিণত হয়েছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি
ও লোকজ সংস্কৃতি একযোগে প্রকাশ পাচ্ছে।
শুর, পাল, সেন ও দেব রাজাদের আমলে গোড়াপত্তন হলেও সোনারগাঁওয়ের
সমৃদ্ধ এবং গৌরবোজ্জ্বল যুগের শুরু হয় ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহর আমল
থেকে। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সোনারগাঁ স্বাধীন বাংলার রাজধানীতে
পরিণত হয়। পরে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ, শের
শাহ, ঈশা খাঁ পর্যায়ক্রমে সোনারগাঁয়ে
রাজত্ব করেন।
প্রাচীন বাংলার রাজধানী ও মসলিনের শহর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলাকে
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড কমিউনিকেটরস কাউন্সিল (ডব্লিউসিসি) বিশ্ব কারুশিল্প
শহরের মর্যাদা প্রদান করে। ফলে বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো স্থান বিশ্ব কারুশিল্প শহরের
মর্যাদা পায়। এতে ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁয়ের কারুশিল্পের সৌন্দর্য ও সুনাম বিশ্ব-দরবারে
প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্বীকৃতির ফলে বিশ্বের অন্যান্য কারুশিল্প শহরের সঙ্গে সহযোগিতা,
অংশীদারত্ব ও বিনিময়ের সুযোগ পাবে সোনারগাঁ।
৯ই অক্টোবর-২০২০, শুক্রবার সকাল সাতটায় সিলেট থেকে এসি ট্যুরিস্ট
বাসে করে আমরা জনাপঁচিশেক পর্যটক রওনা হলাম সোনারগাঁর পথে। পথিমধ্যে সেরে নিলাম সকালের
নাশতা। লালাবাজারের পাপড়ি রেস্টুরেন্টের ভুনা খিচুড়ি আর চিকেন ঝালফ্রাই দিয়ে জম্পেশ
একটা খাওয়ার পর গাড়ি চলতে শুরু করলো পুরোদমে। চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ঢাকা-সিলেট
মহাসড়ক ধরে নরসিংদীর গাউছিয়া হয়ে ২৩৩কিলোমিটার জার্নি শেষে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টায় আমরা
পৌঁছে গেলাম নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পেরাব গ্রামে। সেখানে প্রথমেই আমরা যাব
বাংলার পিরামিড ও রাজমনি ফিল্ম সিটি দেখতে।
বাংলার পিরামিড ও রাজমনি ফিল্ম সিটি
দুপুর বারোটা তখন। খাঁ খাঁ রোদ্দুর। সূর্যের ভয়ানক উত্তাপটা টের পেলাম বাস থেকে নামার পর। এসি বাসে বেশ আরামেই এসেছি। কিন্তু নামামাত্রই গরম এসে ঘিরে ধরল প্রবলভাবে। আমাদের গ্রুপ থেকে আগেই পিরামিডে ঢোকার টিকেট কেটে নেয়া হয়েছে। সারিবদ্ধভাবে সবাই ঢুকে গেলাম। উল্লেখ্য, ১৫০টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে বাংলার পিরামিড ও বাংলার তাজমহল দেখা যায়। দুটো জায়গা স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত ও একই মালিকানাধীন হওয়ায় একই টিকিটেই প্রবেশ করা যায়।
পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি মিশরের ঐতিহাসিক পিরামিডের কথা কে না জানেন। ফেরাউনের লাশের মমি ও পিরামিডের ঐতিহ্য দেখতে লাখ লাখ পর্যটক প্রতি বছর পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে সেখানে ছুটে যান। কিন্তু সবাই তো মিশরে যেতে পারেন না, সে সামর্থ্যও নেই। সে কথা চিন্তা করেই মিশরের পিরামিডের আদলে তৈরি ডামি পিরামিডটি নির্মাণ করা হয়। ২০১৬ সালে যেটি উদ্বোধন হয়।
বাংলার পিরামিড নির্মাণ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আহসান উল্লাহ মণি। আগেই বাংলার তাজমহল বানিয়ে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পান আর সেখান থেকেই তিনি বাংলার পিরামিড নির্মাণের উৎসাহ লাভ করেন। রাজমনি ফিল্ম সিটি নামে একটি বিশাল প্রকল্পের আওতায় এসব তৈরি করছেন বলে জানা যায়। এই প্রকল্পের আওতায় ভবিষ্যতে এই সিটিতে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমানে এই প্রকল্পে রয়েছে পিরামিডের রেপ্লিকা, ফিল্ম জাদুঘর ও ডিজিটাল সিনেমা হল। আর এর ভেতরে রয়েছে মোট আটটি মমির রেপ্লিকা। সাথে রাজা-বাদশাহর আমলের পোশাক ও রানিদের গয়না-অলঙ্কারের রেপ্লিকাও।
প্রথমেই আমরা চলচ্চিত্র শুটিংয়ের একটি সেটে প্রবেশ করলাম। এখানে আহসান উল্লাহ মণি নির্মিত বিভিন্ন সিনেমার নাম বড় করে লেখা আছে। এছাড়াও রয়েছে ডামি রাজার দরবার, বিচারালয় বা আদালত, জেলখানা ও আরও অনেক কিছু। তারপাশেই দেখলাম বেহুলার বাসরঘর। হ্যাঁ, সেই ঐতিহাসিক বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘরের আদলেই এটি নির্মিত। নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাসে আমরা যে বেহুলা-লখিন্দর ও সাঁপের গল্প শুনেছি এখানে ঠিক তারই দৃশ্যায়ন করা হয়েছে। যা আপনাকে দারুণ অনুভূতি দেবে।
সবশেষে প্রবেশ করলাম মমিঘরে। যেখানে মিশরের মমিগুলোর আদলে মোট আটটি মমি রয়েছে। সেইসাথে আছে রাজা-বাদশাহর পোশাক, রানি-মহারানিদের অলঙ্কার, শাহি তরবারিসহ আরও অনেক কিছু। অন্ধকার ঘরে যেগুলো দেখতে গিয়ে একটা গা ছমছমে ভাব চলে এলো আমাদের। দুর্বল ও অসুস্থ হলে এই জায়গায় না ঢোকাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
মমিঘর থেকে বেরিয়ে আবার চলে এলাম ফিল্ম সিটির উন্মুক্ত আঙিনায়। যেখানে ঘুরে ঘুরে দেখলাম বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য, ফুলের বাগান, শুটিং বাড়ি, পুরোনো আমলের নানা মডেলের জিপ গাড়ি, ক্ষুদিরামের ফাঁসির মঞ্চসহ নানা সৌন্দর্যের স্থাপনাগুলো। ঘোরার পাশাপাশি ছবি তোলা ও ভিডিও করা হলো প্রচুর। আমার ইউটিউব চ্যানেলে সবগুলো ভিডিও আপলোড করা আছে, চাইলে দেখে নিতে পারেন।
বাংলার তাজমহল
পিরামিড থেকে বেরিয়ে দুই মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত বাংলার তাজমহলে চলে গেলাম। পিরামিড দর্শন ও জুমার নামাজ শেষে দুপুর দুটো বেজে গেছে প্রায়। রোদ আরও চড়া হয়েছে। ঠাণ্ডা পানি আর ড্রিঙ্কস খেয়ে সবাই প্রবেশ করলাম তাজমহলে।
তাজমহল নামটা শুনলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজকে ভালোবেসে দিল্লির আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে যে স্থাপনাটি তৈরি করেছিলেন তার কথা। যেটা অনেক আগে থেকেই বিশ্বের সপ্তাশ্চার্য হয়ে আছে। তারই অনুকরণে প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ উপজেলার পেরাব গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আহসান উল্লাহ মণি তৈরি করেছেন বাংলার তাজমহল। যারা দিল্লিতে গিয়ে তাজমহল দেখতে পারেন না, তারা অবশ্যই বাংলার তাজমহলটি দেখতে যেতে পারেন। এতে দুধের স্বাদটা ঘোলে মেটাতে পারবেন অন্তত।
তাজমহলের মূল ভবন স্বচ্ছ ও দামি পাথরে মোড়ানো। এর অভ্যন্তরে আহসানউল্লা মণি ও তার স্ত্রী রাজিয়া দু’জনের কবরের স্থান সংরক্ষিত আছে। চার কোনে চারটি বড় মিনার, মাঝখানে মূল ভবন, সম্পূর্ণ টাইলস করা। সামনে পানির ফোয়ারা, চারদিকে ফুলের বাগান, দুই পাশে দর্শনার্থীদের বসার স্থান। এখানে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রাজমনি ফিল্ম সিটি রেস্তোরাঁ ও পার্টি সেন্টার, সাথে উন্নতমানের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা। তাজমহলকে ঘিরে এর মূল গেটের বাইরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন হস্তশিল্প সামগ্রী, জামদানি শাড়ি, মাটির গহনাসহ আরও অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর দোকানপাটও। আছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টও।
২০০৩ সালে এই তাজমহলটি নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এবং ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বেশ ঘটা করে এর উদ্বোধন করা হয়। সুলতানি আমলের প্রসিদ্ধ সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ আর বারো ভূঁইয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর ঈশা খাঁর রাজধানীখ্যাত সোনারগাঁয়ের এই আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বাংলার তাজমহল এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। তাজমহল সংশ্লিষ্ট জায়গার পরিমাণ প্রায় ১৮ বিঘা হলেও আশপাশে পর্যটনের জন্য প্রায় ৫২ বিঘা জায়গা সংরক্ষিত রয়েছে।
তাজমহলের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে সময় চলে গেলো বুঝতেই পারলাম না। বেরিয়ে যাওয়ার ডাক পড়ল। বের হয়েই চলে গেলাম পাশেই হোটেল মমতাজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে। নামটা অবাক করার মতই। তাজমহলের পাশেই মমতাজ!
সবাই মোটামুটি ক্ষুধার্ত তখন। আমাদের আগে থেকেই অর্ডার করে রাখা এই রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলাম। সাদাভাত, আলুভর্তা, ডিমভর্তা, মিক্সড সবজি, ডাল আর সালাদ দিয়ে ভরপেট খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আবার রওনা হলাম সোনারগাঁ শহরের পথে। যেহেতু আমাদের একদিনের সফর, সেহেতু দিনের মধ্যেই লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর ও পানাম নগর দেখে ফিরতে হবে।
লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর
আমাদের হাতে যে সময় ছিল তাতে ভালোভাবেই জাদুঘর ও পানাম নগর দেখা যেত। কিন্তু সোনারগাঁর মূল রাস্তায় গিয়েই পড়লাম জ্যামে। জ্যাম পেরিয়ে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের গেটে যেতে ঘন্টাখানেক লেগে গেল। ৫০টাকা জনপ্রতি টিকিট দিয়ে ফাউন্ডেশনের গেটে ঢুকতেই ঘোষণা এলো ২০মিনিটের মধ্যে শেষ করতে হবে এখানে। কারণ আমাদের পানাম সিটি দেখা এখনো বাকি। হাতে সময় কম থাকায় শিল্পাচার্য জয়নুল লোক কারুশিল্প জাদুঘরের তিনতলায় যতটুকু ঘোরা যায় ঘুরে দেখলাম। তাড়াহুড়ো করে হলেও সবগুলো গ্যালারিই দেখলাম। এরপর বাইরে বেরিয়ে পুরো লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এলাকাটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। অবশ্য এই সময়ে পুরো এলাকা দেখা সম্ভব ছিল না। তবু যতটুকু দেখা যায়!
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ১২ই মার্চ সরকার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাস্কর্য, শেখ রাসেল ও জয়নুল আবেদিন ভাস্কর্য, সংগ্রাম ভাস্কর্য, বনজ, ফলজ ও শোভাবর্ধনকারী বিভিন্ন প্রজাতির লোকজ রেস্তোরাঁ, কারুপল্লী, বিক্রয়কেন্দ্র, বিভিন্ন মেলা, বিনোদন স্পট, পাঠাগার এবং নৌকাভ্রমনের ব্যবস্থাসহ নানা আয়োজন রয়েছে পুরো ফাউন্ডেশনজুড়ে।
ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন নকশি কাঁথা, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের তুলা চাষপদ্ধতি, বয়নশিল্পের কর্মপরিবেশ, তুলা থেকে বস্ত্র তৈরির পরিবেশ, গ্রাম্যমেলা এবং হাট-বাজারে কাপড় বিক্রয়ের চিত্র ডিওরোমা মডেলের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
১৯৭৬ সালের ২৮শে মে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মৃত্যুর পর তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফাউন্ডেশনের নতুন জাদুঘরটির নাম রাখা হয় ‘শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর’।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্টজন। বঙ্গবন্ধু একদিন জয়নুল আবেদিনকে বললেন, কতজন আমার কাছে কতকিছু চায়, তুমি তো কিছু চাইলে না! তখন জয়নুল আবেদিন বলেছিলেন, যদি কিছু দিতে হয়, তবে আমায় একটা জাদুঘর করে দাও। একটা লোকজ জাদুঘর। যেখানে শুধু গ্রামবাংলার ঐতিহ্য স্থান পাবে। এভাবেই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা হয়।
পুরো জাদুঘর বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক নান্দনিক উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়ে বেরিয়ে এলাম। বিশ মিনিটের কথা বলা হলেও আধঘন্টা চলে গেলো নিমিষেই। তাড়া থাকায় বেরিয়ে এলাম। জাদুঘরের একটু সামনেই আছে পানাম নগর। সেখানেই এখন গন্তব্য।
পানাম সিটি
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। শেষ বিকেলের আলোয় এবার ঢুকলাম পানাম নগরে। একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর পানাম নগর। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর -প্রাচীন সোনারগাঁর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে কয়েকশতাব্দী পুরোনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বারো ভূইয়াদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। শহরটিতে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দোতলা এবং একতলা বাড়ি রয়েছে প্রচুর। যার বেশিরভাগ বাড়িই ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি। মূলত পানাম ছিলো বাংলার সে সময়কার ধনী ব্যবসায়ীদের বসতক্ষেত্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিলো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই নগর।
১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মোঘলদের সোনা
পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে রয়েছে ২১টি বাড়ি। এক থেকে তিনতলা উচ্চতার বাড়িগুলোর স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মোঘল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব এক সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়িই ব্যবহার উপযোগিতা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার এবং নির্মাণকৌশলের দিক দিয়ে উদ্ভাবনী নৈপুণ্যে ভরপুর।
পানাম নগরীর পরিকল্পনাও ছিল নিখুঁত। নগরীর পানি সরবাহের জন্য দুপাশে ২টি খাল ও ৫টি পুকুর করা হয়। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছিল একেকট কুয়া বা কূপ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে করা হয়েছিল খালের দিকে ঢালু। প্রতিটি বাড়িই রয়েছে একের সাথে অন্যটির যৌক্তিক দূরত্ব। নগরীর যাতায়াতের জন্য রয়েছে এর একমাত্র রাস্তা, যা এই নগরীর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে উভয়পাশে।
১৯৭১ সাল থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পানাম নগরের বাড়িগুলো ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু অযত্ন আর অবহেলায় বাড়িগুলো নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তাই ২০০৪ সাল থেকে ইজারা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। সংরক্ষণের অভাবে ২০০৫ সালে দুটি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বসে যায়। পরবর্তীতে এই পানাম নগর রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, যা আজও অব্যাহত আছে।
এখানে অনেক পেশাদার ও সৌখিন আলোকচিত্রী তাদের ছবির বিষয়বস্তুর জন্য পানামে আসেন। অসাধারণ কিছু ছবি তুলে সন্তুষ্টচিত্তে ফিরেও যান। এছাড়া এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্র পরিচালক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত ‘গেরিলা’ সিনেমাটির কিছু অংশেরও শুটিং হয়ছিল। সিনেমার কাহিনির প্রয়োজনেই মুক্তিযুদ্ধের আগের কিছু দৃশ্য ধারণ করার জন্য পানাম নগরকে বেছে নেয়া হয়। ২০১১ সালে ছবিটি মুক্তি পায় এবং দর্শক ও সমালোচকদের মন জয় করে নেয়। এছাড়া ২০১০ সালে ‘সুবর্ণগ্রাম’ নামের একটি ডকু-ড্রামা তৈরি হয় পানাম নগরীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, হারিয়ে যাওয়া পানাম নগর আমাদের সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে।
পানাম নগর থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এবার ফিরতে হবে। সোনারগাঁর রাস্তা অনেক ছোট হলেও যানবাহন প্রচুর। ফলে আবারও জ্যামে পড়লাম আমরা। বের হয়ে মূল রোডে ওঠার পর স্বস্থি ফিরে এলো সবার মধ্যে। দুর্বার গতিতে বাস ছুটতে শুরু করলো। পথিমধ্যে একটা রেস্টুরেন্টে হালকা নাশতা ও চা পান করে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে প্রফুল্ল মন নিয়ে রাত একটায় পৌঁছে গেলাম নিজের গন্তব্যে। সোনারগাঁয়ের সোনামাখা রোদ আর রঙে আনন্দস্নান করে পুরো একটি দিন কাটিয়ে আবার ফিরে এলাম ব্যস্ততা আর কোলাহলের কোলে।
যেভাবে যাবেনঃ আমরা সিলেট থেকে রিজার্ভ বাস নিয়ে গিয়েছিলাম। আপনারা যারা ঢাকা থেকে যেতে চান তারা খুব সহজেই যেতে পারেন। কারণ ঢাকা থেকে সোনারগাঁয়ের দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে করে ৪০-৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে খুব সহজেই চলে যাওয়া যায় সোনারগাঁ। পরে সেখান থেকে রিকশা ও সিএনজি করে বিভিন্ন লোকেশনে যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন?
ঢাকা থেকে সোনারগাঁ কাছাকাছি হওয়ায় থাকার প্রয়োজন পড়ে না। তবে দূর থেকে কেউ গেলে এবং থাকতে চাইলে সোনারগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে স্বল্প থেকে উচ্চ বাজেটে বিভিন্ন হোটেল-মোটেল পেয়ে যাবেন।
0 মন্তব্যসমূহ