ক্ষুদিরাম বসুঃ ফাঁসির মঞ্চে যিনি জীবনের জয়গান গেয়েছিলেন


"আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ

র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,

আঠারো বছর বয়সেই অহরহ

বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি"

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার 'আঠারো বছর বয়স' কবিতায় এভাবেই বর্ণনা করে গেছেন আঠারো বছরের তারুণ্যের উদ্যাম আর দুর্দান্ত সাহসকে। সেই আঠারোর এক মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণের গল্পই বলবো আজ।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন আর দেশজুড়ে স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতিরোধ ক্রমশ ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল ব্রিটিশ শাসকদের। এমন সঙ্কটময় ও উত্তাল সময়েই অভিবক্ত বাংলার বুকে জন্ম নিয়েছিলেন এক মহান বিপ্লবী, মাত্র আঠারো বছর বয়সেই যিনি হাসতে হাসতে দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলেন, ফাঁসির মঞ্চেও গেয়েছিলেন জীবনের জয়গান। ক্ষুদিরাম বসু ছিল তাঁর নাম। যাকে নিয়ে গোটা ভারতবর্ষ আজও গর্ব করে, তরুণরা উদ্ধুদ্ধ হয় তার দেশপ্রেমের চেতনায়।

১৯০২-০৩ সাল। ক্ষুদিরাম বসু তখন নিতান্তই এক কিশোর। সে সময়ের বিপ্লবী নেতা অরবিন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করেন এবং জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন। সেইসাথে বিপ্লবী দলগুলোর সাথে গোপন পরিকল্পনা করেন। সেই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়েই ক্ষুদিরাম বসু বিপ্লবে যোগ দিতে মনস্থির করেন।

ক্ষুদিরাম যে স্কুলে পড়তেন, তার অদূরেই ছিল ভবানী মন্দির। সেই মন্দির-প্রাঙ্গনে গিয়ে প্রায়ই সময় কাটাতেন। সেখানেই সাক্ষাৎ হয় বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে। ১৯০৩ সালে ক্ষুদিরাম তার কাছে গুপ্ত সমিতির (সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন) শিষ্য হিসাবে দীক্ষা গ্রহণ করেন। পড়াশোনা, খেলাধুলাসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হন। নিজের কর্মদক্ষতায় সহজেই বিপ্লবীদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন, সিক্ত হন তাদের আদর-স্নেহ-ভালবাসায়। রাজনীতি ও বিপ্লব নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। শপথগ্রহণ করেন দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য।

১৯০৪ সালে কিশোর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু তার বোন অপরূপার স্বামী অমৃতর সাথে তমলুক শহর থেকে মেদিনীপুরে চলে আসেন। সেখানে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এখানেই তার বিপ্লবী জীবনের আনুষ্ঠানিক অভিষেক ঘটে। তিনি বিপ্লবীদের একটি নবগঠিত আখড়ায় যোগ দেন। এটি মূলত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্রিটিশ বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষুদিরাম তার সাহস আর দক্ষতার জন্য সবার চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন। মেধাবী, দুরন্ত এবং বাউণ্ডুলে স্বভাবের কিশোর ক্ষুদিরাম ১৯০৩সালে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি ঘটিয়ে ফেলেন। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন দুঃসাহসিক সব কর্মকাণ্ডে। ব্রিটিশরাজের নানা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণ করেন তিনি।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ক্ষুদিরাম বসু। সত্যেন বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে যোগ দিয়ে শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষাও গ্রহণ করেন। সেখানেই পিস্তল চালানোর শিক্ষা নেন তিনি। এই গুপ্ত সংগঠনের কর্মসূচির অংশ হিসেবেই ক্ষুদিরাম অসীম সাহসিকতার সাথে ভারতবর্ষে আমদানি করা ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় জ্বালিয়ে দেন এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত লবণবোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেন। এসব কর্মকাণ্ডে তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে ধীরে ধীরে গুপ্ত সংগঠনের ভেতরে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তিনি হয়ে ওঠেন গুরুত্বপূর্ণ এক বিপ্লবী যোদ্ধা।

এভাবেই এগোতে থাকে তার বিপ্লবী জীবন। ছোট্ট জীবনে ঘটতে থাকে না ঘটনা-দুর্ঘটনাও। ১৯০৬সালে সত্যেন সেনের নির্দেশে ব্রিটিশবিরোধী বই ও লিফলেট বিতরণ করতে গিয়ে ধরা পড়েন। কিন্তু ব্রিটিশবাহিনী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে বইগুলো তিনি অন্য কারো নির্দেশে বিলি করছিলেন। সেই নির্দেশদাতার নাম জানতে চাইলে সেখানে সত্যেন সেন উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তার নাম বলেননি। ফলে সত্যেন সেন বেঁচে যান। কিশোর বয়স হওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয় তাকেও।

এরপর একের পর এক দুঃসাহসী কাজ করতে থাকেন। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশকে অপশক্তির হাত থেকে মুক্ত করতে অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে একের পর এক গোপন মিশনে কাজ করতে থাকেন। বিখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন ক্ষুদিরাম বসুদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখেন- “ভারতের ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার মধ্য দিয়ে। বৃটিশদের শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার অদম্য মানসিকতা সেদিনের ছাত্র সমাজকে আপসহীন বিপ্লবী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বহু যুবক বিপ্লবী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বহু যুবক বিপ্লবী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এমনকি আমরা দেখেছি শিক্ষকদের প্রেরণাতেও বহু মেধাবী ছাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষক-ছাত্রের এক অনুকরণীয় সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল সে সময়। ক্ষুদিরামেরা সেই অগ্নিগর্ভ সময়েরই সৃষ্টি। সে সময়ে তারুণ্যের প্রাবল্য আঘাত হানে অত্যাচারী শাসকের দুর্গে। ‘বোকা’ ক্ষুদিরামরাই নতুন পথ দেখান।”

১৯০৮ সালের এপ্রিল মাস। স্বাধীমতাকামী বিপ্লবী দলগুলোকে দমন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে ব্রিটিশরাজ। অসংখ্য বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে ফাঁসিসহ যাবজ্জীবন শাস্তি দেয়া শুরু করে। আন্দামান দ্বীপ ও আলিপুর কারাগারে পাঠাতে থাকে তাদেরকে, সেখানে চলে অকথ্য নির্যাতন। আর এসব বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ রায় দেন তৎকালীন ব্রিটিশ বিচারক কিংসফোর্ড। তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠুর ও কঠোর এক বিচারক। মাত্র ১৩ বছরের বালক সুশীল সেন পুলিশ সার্জেন্টকে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেয়ায় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিচারে ১৫টি বেত্রাঘাত মারার হুকুম দেন তিনি। বেত্রাঘাতে রক্তাক্ত হয়ে দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন সুশীল সেন। কিংসফোর্ডের এই নিষ্ঠুর বিচারের খবরটি দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তরুণ বিপ্লবীরা এই বর্বরোচিত ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে কিংসফোর্ডকে শাস্তি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। বিপ্লবী দলের সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত, বারীন ঘোষ ও অরবিন্দরা বসে সিদ্ধান্ত নেন কিংসফোর্টকে হত্যা করার। মিটিংয়ে প্রশ্ন ওঠে এ কাজের দায়িত্ব কাকে দেয়া হবে? বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকির সাথে দায়িত্ব দেয়া হলো তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকেও।

পরিকল্পনামত তাদেরকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বোমা ও রিভলবার নিয়ে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি চলে যান মুজাফফরপুর। সেখানেই কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য তার বাসভবনের কাছেই একটি ধর্মশালায় আশ্রয় নেন তারা। অবশ্য এই মিশনের আগেও একবার তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। একধরনের শক্তিশালী 'বইবোমা' তৈরি করে বইয়ের ভেতরে করে সেই বইটা কিংসফোর্ডকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি বইটা না খোলায় বেঁচে যান। ফলে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকিই ঝুঁকিটা নেন। নিষ্ঠুর বিচারক কিংসফোর্ডের বাড়ির আশপাশে বারবার অবস্থান নিলেও কঠোর নিরাপত্তার কারণে তাকে হত্যা করতে পারছিলেন না। একসময় অস্থির হয়ে ওঠেন তারা।

১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল আর ধৈর্যের বাঁধ মানে না দুই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকির। তারা সেদিনই হত্যা করার জন্য প্রস্তুতি নেন। বোমা ও রিভলবার নিয়ে কিংসফোর্ডের বাসার পাশেই গাছপালার পেছনে অবস্থান নেন। অপেক্ষা করতে থাকেন কিংসফোর্ডের গাড়িটি কখন বেরিয়ে আসবে। একসময় বেরিয়ে আসেও। বোমা ছুঁড়ে মারেন সেটিকে লক্ষ্য করে। লক্ষ্যচ্যুত হয় না সেগুলো। কিন্তু আসল লক্ষ্য যে ছিল, সেই কিংসফোর্ডই গাড়িতে ছিলেন না। ব্রিটিশ আইনজীবী কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে সেদিন গাড়িতে থাকায় তারাই নিহত হন। তাৎক্ষণিক সে সংবাদটা দুই বিপ্লবী জানতে পারেন না। তারা পালিয়ে যান দুজন দুইদিকে। পুরো শহরেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। দুই তরুণ বিপ্লবীকে ধরার জন্য পাগলপারা হয়ে খুঁজতে থাকে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা।

ক্ষুদিরাম বসু গ্রামের পর গ্রাম হাঁটতে থাকেন। প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার হাঁটার পর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় একটি ছোট রেল স্টেশনে ১লা মে, অর্থাৎ ঘটনার পরদিন ধরা পড়েন। তাকে নিয়ে আসা হয় জেলে। ওদিকে প্রফুল্ল চাকি পালিয়ে যাওয়ার সময় একটি ট্রেনে সাদাপোশাকের এক পুলিশের নজরে পড়ে যান। ট্রেন থেকে নামার পর সেই পুলিশই তাকে স্টেশনে অন্যান্য পুলিশদের দিয়ে ঘেরাও করেন। রিভলবার বের করে সেই পুলিশ সদস্যকে গুলি করলেও সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পরে পালানোর আর কোনো সুযোগ না থাকায় ধরা না দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে নিজেকে শেষ করে দেন এই বিপ্লবী।

হাতকড়া বাধা অবস্থায় অন্য বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে মুজাফফরপুরে আনা হলে তাকে দেখার জন্য পুরো শহরের মানুষ ভীড় জমিয়ে ফেলে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার উডম্যানের এজলাসে নেয়া হয় এবং তাকে রাজসাক্ষী হয়ে তার সঙ্গী বিপ্লবীদের নাম জানাতে বলা হয়। কিন্তু তিনি তা দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন।

১৯০৮সালের ২১শে মে তারিখে বিচারপতি মি. কর্নডফ, বিচারপতি নাথুনিপ্রসাদ ও বিচারপতি জানাকপ্রসাদের আদালতে ক্ষুদিরামের সেই ঐতিহাসিক বিচারকাজ শুরু হয়। সে সময়ের খ্যাতিমান আইনজীবী কালিদাস বসু, উপেন্দ্রনাথ সেন, ক্ষেত্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কূলকমল সেন, নরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ও সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী ক্ষুদিরামের পক্ষে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই মামলা লড়তে থাকেন। বয়সের বিবেচনায় তাকে লঘু শাস্তি দেয়া হবে মনে করা হলেও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব হুমকির মুখে, তখন ব্রিটিশরা কোন বিপ্লবীকে ধরার পর ছেড়ে দেবে সেটা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। ফলে তার পক্ষের আইনজীবীদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৩ই জুন ক্ষুদিরামের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়।

রায় শুনে তিনি মুচকি হাসতে থাকেন। বিচারকরা অবাক ও বিভ্রান্ত হন তার সেই হাসিতে। তারা জিজ্ঞেস করেন, রায়টা তিনি বুঝতে পেরেছেন কী না। তিনি হ্যাঁ বলেন এবং দৃঢ়তার সাথেই নিজের বিপ্লবী সত্তার ফিরে আসার ঘোষণা দেন। এরপর তার কোন শেষ ইচ্ছা আছে কী না জানতে চাওয়া হয়। ক্ষুদিরাম অবিচল স্বরে বলেন, 'আমি খুব ভালো বোমা বানাতে পারি। আরেকটু সময় দিলে সেটা ভারতবাসীকে শিখিয়ে যেতে চাই'। এই কথা শুনে বিচারকরা তাকে পুলিশি প্রহরায় জেল-হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য রায় ঘোষণার সময় তিনি প্রফুল্ল চাকির ধরা পড়া ও নিহত হওয়ার কথা জানতেন না। ফলে পুরো ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নেন, কোনো বিপ্লবীর নাম বা সংগঠনের নামও বলে দেননি।

১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট ভোরে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসির দড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়ও তিনি ছিলেন, শান্ত ও অবিচল। হাসছিলেন তখনও। তার মানসিক দৃঢ়তা দেখে কারারক্ষীরা পর্যন্ত অবাক হয়ে যান। ক্ষুদিরামের আইনজীবি শ্রী উপেন্দ্রনাথ সেনের ভাষ্যমতে- “ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরাম নির্ভীকভাবে উঠে যান। তার মধ্যে কোনো ভয় বা অনুশোচনা কাজ করছিল না। এদেশের নবীন যৌবনের প্রতীক হয়ে হাসিমুখে তিনি উঠে যান ফাঁসির মঞ্চে।”

১২ আগস্ট কলকাতার বিখ্যাত পত্রিকা ‘দৈনিক অমৃতবাজার’-এ লেখা হয়- ‘মোজাফফরপুর, ১১ই আগস্ট, অদ্য ভোর ছয় ঘটিকার সময় ক্ষুদিরামের ফাঁসি হইয়া গিয়াছে। ক্ষুদিরাম দৃঢ় পদক্ষেপে প্রফুল্লচিত্তে ফাঁসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়। এমনকি যখন তাহার মাথার উপর টুপিটা টানিয়া দেওয়া হইল, তখনো সে হাসিতেছিল।’

মাত্র আঠারো বছর সাত মাস এগারো দিনে জীবনাবসান হওয়া ইতিহাসের এই মহান বিপ্লবীর জন্ম ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলা শহরের কাছাকাছি হবিবপুর গ্রামে। তার পিতা ত্রৈলক্ষ্যনাথ বসু ছিলেন নাদাজল প্রদেশের শহরে আয় এজেন্ট। তার মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। তিন কন্যার পর তিনি তার মায়ের চতুর্থ সন্তান। তার দুই ভাই আগেই মৃত্যুবরণ করেন। এই পুত্রেরও মৃত্যুর আশঙ্কায় তার মা তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী নিজ পুত্রকে তারই সদ্য-বিবাহিত বড় বোনের কাছে তিনমুঠ খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। যেহেতু 'খুদের বিনিময়ে প্রাণরক্ষা' হয়েছিল, তাই তার নামকরণ করা হয় ক্ষুদিরাম বসু। দুঃখের বিষয় হলো, ক্ষুদিরামের আর নিজের মা-বাবার কাছে ফেরা হয়নি। ফলে শৈশব-কৈশোরে কখনোই আর তাদের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা কিছুই পাওয়া হয়নি। ক্ষুদিরামের সাত বছর বয়সে, মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে তার বাবা-মা দুজনই মারা যান। সেই বড়বোনের সংসারেই বেড়ে উঠেন তিনি।

ক্ষুদিরামকে ধরা হয় ভারতবর্ষের সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী ও শহিদ। তার মৃত্যুতে সে সময় দলে দলে তরুণরা বিপ্লবী হয়ে ওঠেন, ফলে তরান্বিত হয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সালে যা পায় চূড়ান্ত পরিণতি। যদিও সেই স্বাধীনতার ফলে দেশভাগও হয়ে যায়, ব্রিটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা দুটো দেশ তৈরি করে দিয়ে যায়। সেই দুটো দেশই এখন তিনটি দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাও ভাগ হয়ে গেছে।

ক্ষুদিরামের মৃত্যুর পর বাঁকুড়ার কবি পিতাম্বর দাশ গান বাধেন- "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি/হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী"। সেই গানটি তুমুল জনপ্রিয় হয়। গানটির কথা ও সুর আজও প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে নাড়া দেয়, মনে করিয়ে দেয় ক্ষুদিরাম বসুর সেই আত্মত্যাগের কথা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও ক্ষুদিরামকে নিয়ে কবিতা লিখে গেছেন।

বাংলা ভাগ হয়ে গেলেও বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে ভাগ করা যায়নি, কারণ তিনি দেশভাগের আগেই জীবন দিয়ে গেছেন দেশের জন্য। বাঙালি তাই দেশের বিরুদ্ধে যে কোনো ষড়যন্ত্রে, আন্দোলন-সংগ্রামে ক্ষুদিরামের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়। আঠারো বছর বয়সের সেই দুঃসাহসী তারুণ্য আজও আমাদের পথ দেখায় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে লড়ার, এমনকি জীবন বিলিয়ে দেবারও। স্যালুট ক্ষুদিরাম বসু!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ