দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাড়া তিনটি প্রদেশ পাকিস্তানি শাসকেরা করায়ত্ব করলেও কালাত, খারন, মারখান ও লাসবেলা এই চার অঞ্চল নিয়ে গঠিত সবচেয়ে বড় রাজ্য বালুচিস্তান নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তারা পাকিস্তানের সাথে না গিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা বালুচিস্তান নিজেদের দখলে নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করে। সেটা জানতে পেরে বালুচ শাসক মির আহমদ ইয়ার খান ওরফে খান সাহেব নেহরু ও আজাদ সাহেবের কাছে বালুচিস্তানকে ভারতের অংশ করার জন্য অনুরোধ জানান। নেহেরু ও আজাদ সাহেব তাতে সাড়া না দিয়ে অমার্জনীয় ঐতিহাসিক ভুলটা করেন।
নেহরু ও আজাদ বালুচিস্তানের ভারতভুক্তির বিরোধিতা করেন এই বলে যে, বালুচিস্তান ভারতের লাগোয়া কোনো অঞ্চল নয়। রাজস্তান-পাক সীমান্ত থেকে বালুচিস্তানের দূরত্ব প্রায় ২০০ মাইল। মাঝখানে পাকিস্তান। শুধু এই ভুলটি করেই নেহরু ও আজাদ সাহেব ক্ষান্ত থাকেননি, তারা আরও একটি বড় ভুল করেন। বালুচিস্তানের প্রধান গভীর সমুদ্রবন্দর গোয়াদর, যা এখন চীনের নৌসেনা ঘাঁটিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে, সেটি তখনকার ওমানের সুলতান মাত্র পাঁচশ টাকার বিনিময়ে ভারতকে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রস্তাবও নেহরু ও আজাদ সাহেব প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, বানারাতও ভারতের লাগোয়া নয়। তদানীন্তন ভারতীয় নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে বালুচদের ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে, যার জন্য তাদের ইতিহাস-সচেতন একটি অংশ আজও তাদের বিড়ম্বনার জন্য ভারতকে দায়ী করে।
বরাবরই আত্মপ্রত্যয়ী ও দ্রোহের জয়গান গাওয়া বালুচরা নিজেদের কখনোই পাকিস্তানি বলে
মনে করেনি এবং এখনও করে না। ভারত ভাগ হওয়ার পর বালুচিস্তান ২২৭দিনে স্বাধীন
সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। বালুচিস্তানের পতাকাও তখন করাচির বালুচ
দূতাবাসে উড়ত। যাই হোক, বালুচরা ভারতের হস্তক্ষেপ চাওয়ার এই সংবাদটি অল ইন্ডিয়া
রেডিওর মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর ১৯৪৮সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বালুচিস্তানে
সামরিক ও নৌবাহিনীর অভিযান চালান। অস্ত্রের মুখে মির আহমদ ইয়ার খানের কাছ থেকে
বালুচিস্তানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুতির দলিলে সই করান। ফলে বালুচিস্তান প্রদেশটি
পাকিস্তান বাহ্যত দখল করে নেয়। অনেকটা জোরপূর্বক কালাত চুক্তির মাধ্যমে
বালুচিস্তানকে নিজেদের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে সংযুক্ত করে। চুক্তি
অনুযায়ী কেবল প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি ইসলামাবাদের হাতে থাকার কথা
ছিল। বাকি বিষয়গুলো বালুচিস্তানের শাসকদের উপর ন্যস্ত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল তখন।
কিন্তু জিন্নাহর সঙ্গে বালুচিস্তানের সেই চুক্তির শর্তগুলো লঙ্ঘন করে পাকিস্তানের
শাসকগোষ্ঠী। এরপর থেকেই মূলত শুরু হয় বালুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, জালেমের হাত
থেকে মাতৃভূমি উদ্ধারের লড়াই।
৩,৪৭,১৯০ বর্গ কিলোমিটারের প্রদেশটি
পাকিস্তানের মোট আয়তনের ৪৮ভাগ৷ সবচেয়ে বৃহত্তর প্রদেশ হলেও বালুচিস্তানে জনসংখ্যা
খুবই কম, ৮০লক্ষের মত। তবে এখন সেখানে বালুচদের সংখ্যা তারচেয়ে অনেক কম। শুধু আয়তন
নয়, নানাদিক দিয়ে বালুচিস্তান পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বালুচিস্তান
প্রাকৃতিক সম্পদে যেমন ভরপুর, তেমনি ভৌগলিক অবস্থানেও 'ভাইটাল রোল প্লে' করে।
পাকিস্তানের জ্বালানি সম্পদের মজুদ, পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ ও পরীক্ষাক্ষেত্র এবং
চীনের নির্মিত গোয়াদর বন্দর বালুচিস্তানের গুরুত্ব বাড়িয়েছে অনেক। বালুচিস্তানের
সুই গ্যাসক্ষেত্র পাকিস্তানের ১৭শতাংশ গ্যাসের চাহিদা মেটায়। কিন্তু এত গুরুত্ব
থাকা সত্ত্বেও বালুচিস্তানে উন্নয়ন হয়নি একটুও! বালুচদের সম্পদ অন্যান্য প্রদেশে
ব্যয় হলেও তারা বরাবরই অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত। তার ওপর চীন বালুচস্তানে একটা
অর্থনৈতিক করিডোর করছে, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৬০০কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বলে
জানিয়েছে। কিন্তু বালুচদের ভাগ্যে সেসব উন্নয়নের সুবিধা নেই, হবেও না নিশ্চিত।
বালুচ দখলের পর থেকে পাকিস্তানিরা যে নির্যাতন করে আসছে তাদের ওপর, তাতে বালুচদের
লক্ষ্য একটাই - স্বাধীনতা। ১৯৪৮ সালে আহমদ ইয়ার খান গ্রেফতারের পর তার ভাই প্রিন্স
আবদুল করিম দায়িত্ব গ্রহণ করেন, গঠন করেন বালুচ ন্যাশনাল লিবারেশন কমিটি। ১৯৫০
সালে তিনিও গ্রেফতার হন, বেঁচে থাকেন আরও ২২বছর। কিন্তু তাকে কারাগারেই কাটাতে হয়
প্রায় ১৬বছর। পাকিস্তান তাদের সেনাবাহিনী দ্বারা বালুচদের গুম, খুন, ধর্ষণ,
নির্যাতন করে বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার আন্দোলন দমন করে আসছে। শুধু তাই নয়, বালুচ
ভাষার ওপর চালিয়ে দিয়েছে উর্দু ভাষাও। বালুচরা আজ আর তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ
করতে পারে না। বালুচ ভাষাকে প্রাদেশিক ভাষা করার জন্য দাবি জানিয়ে আসলেও সেগুলো
কখনোই আমলে নেয়নি পাক শাসকরা।
তবে বালুচরাও দমে যাবার পাত্র নয়। মাতৃভূমি ও ভাষার প্রশ্নে ছাড় দেয় না কখনোই
তারা। ৬০ ও ৭০ দশকে আন্দোলনের বেগ তীব্র হয়। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন
হওয়ার পর তারাও অনুপ্রাণিত হয়, ভাবে একসময় বাঙালিদের মত তারাও স্বাধীন জাতি হিসেবে
মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। হত্যা, নির্যাতন করে তাদের স্বাধীনতা দমিয়ে রাখা যাবে না।
একুশ শতকের শুরুতে পাকিস্তানি সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বালুচদের
ওপর নৃশংসতা বাড়িয়ে দেন। ২০০৬ সালে তাদের নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি নির্মমভাবে
পাকসেনাদের হাতে নিহত হন। এরপরও দমে যায়নি বালুচ জাতি। এ পর্যন্ত তাদের প্রতি
পরিবার থেকে অন্তত একজন গুম বা খুন হওয়ার পরও তারা স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে
যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গণহত্যার মূল দায়িত্বে ছিলো
জেনারেল টিক্কা খান, যাকে বলা হতো 'বুচার অফ বেঙ্গল'। সেই একই টিক্কা খানকে একসময়
দায়িত্ব দেয়া হয় বালুচদের শায়েস্তা করার জন্যও। সে সেখানে চালায় নজিরবিহীন গণহত্যা
ও গণধর্ষণ। তাকে বালুচ জনগণ 'বুচার অফ বালুচিস্তান' নামে ডাকে। শুধু
হত্যা-নির্যাতন নয়, বালুচরা যেহেতু সংখ্যায় কম, সেহেতু সেখানে প্রচুর পরিমাণ
বিভিন্ন প্রদেশ থেকে লোক বসবাসের জন্য যাচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে বালুচরা নিজভূমেই
পরবাসী হয়ে যাচ্ছে। বালুচরা স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের সাহায্য কামনা করছে এখন।
ভারত সাহায্য করতে আগ্রহী। কিন্তু চীন নিজেদের স্বার্থে এই ইস্যুতেও পাকিস্তানের সাথে আছে। বালুচিস্তানকে কব্জা করে রাখতে হলে তাদের এই ব্যাপারে
পাকিস্তানকে সহায়তা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সংক্ষেপে এই হলো বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা
আছে, প্রাণ ও রক্ত দেয়ার মত বিপ্লবী যোদ্ধাও আছে, তবু কীসের অভাবে বালুচিস্তান
এখনও পরাধীনতার শৃঙখলে বন্দী?
প্রশ্নের উত্তরে পরে আসছি। তার আগে দেখে নিই আরও দুটো স্বাধীনতাকামী জাতির
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।
এইতো সেদিনও ভারতের দখলে থাকা কাশ্মির ছিলো স্বায়ত্বশাসিত। ছিলো তাদের নিজস্ব
পতাকাও। কিন্তু গত বছর মোদি সরকার হঠাৎ করেই সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে
কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নিয়ে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করেছে। সেই সাথে জম্মু ও
কাশ্মিরকে করে রেখেছে অবরুদ্ধ। স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরিদের দমন করতেই মূলত ভারত
তাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়া তথা উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত
ভূ-স্বর্গ কাশ্মির মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত। বর্তমানে এর ৪৩ভাগ ভারতের দখলে। যার
মধ্যে আছে জম্মু, কাশ্মির উপত্যকা, লাদাখ এবং সিয়ানচেন হিমবাহ। পাকিস্তানের দখলে
আছে কাশ্মিরের ৩৭ ভাগ ভূখণ্ড। যার মধ্যে আছে আজাদ কাশ্মির (রাজধানী মুজাফফরাবাদ)
এবং উত্তরাঞ্চলীয় গিলগিট এবং বেল্টিস্তান (Baltistan)। অন্যদিকে চীনের দখলে আছে
কাশ্মিরের ২০ ভাগ এলাকা, যার নাম আকসাই চীন (Aksai Chin)। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত
যুদ্ধের সময়ই মূলত চীন এটা দখল করে নেয়। চীন এটা ছাড়াও ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের কাছ
থেকে পায় পার্বত্য ট্রান্স-কারাকোরামের সাকসাম উপত্যকা। অবশ্য ভারত ও পাকিস্তান
কাশ্মিরের ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে ১৯৪৭ সাল থেকে। আর ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ইংরেজরা
উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে যাবার সময় কাশ্মিরকে সে দেশের জনগণের ইচ্ছা ও
স্বাধীনতার অধীনে থাকার ব্যবস্থা না করে সঙ্কটের ঘূর্ণাবর্তে ফেলে রেখে চলে যায়।
উপমহাদেশের অনেক সমস্যার মতোই কাশ্মির সমস্যাও ইংরেজ-সৃষ্ট। শুধু তাই নয়, কাশ্মির
প্রসঙ্গে ভারত ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সিয়ানচেন
হিমবাহ নিয়ে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে পারমাণবিক উত্তেজনাপূর্ণ যুদ্ধের বিভীষিকা
ছড়িয়ে দেয়। আর কাশ্মিরের (দখলকৃত) অভ্যন্তরে প্রচণ্ড সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করে।
ফলে কাশ্মিরের সমগ্র ভূখণ্ডটি বিভক্ত এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং দখলদার
ভারত-পাকিস্তানের আগ্রাসনে কাশ্মিরের ব্যাপক অংশ দৃশ্যত পরাধীনতার শৃঙখলে বন্দী।
ভারত কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দেয়ার চুক্তি করে কাশ্মির দখল করলেও শুরু
থেকেই সেখানে দমন-পীড়ন চালিয়ে আসছিল। ফলে কাশ্মিরে বারবার স্বাধীনতার দাবিতে
আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেনাবাহিনী দ্বারা দমন করে রাখা হয় হয় সেসব আন্দোলন-সংগ্রাম।
স্বাধীনতাকামীদের আখ্যা দেয়া হয় 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' ও 'সন্ত্রাসী' নামে। এরই মধ্যে
বিজেপি সরকার করে চূড়ান্ত বেইমানি, বাতিল করে স্বায়ত্বশাসন। মহারাজা হরি সিং
কাশ্মিরি জনগনের দাবিগুলো না শুনেই নিজের একক সিদ্ধান্তে কাশ্মিরকে ভারতের হাতে
তুলে দিয়ে যে ভুল করেছিলেন তার মাশুল গুনছে কাশ্মিরের জনগন। অপরদিকে
পাকিস্তান-শাসিত আজাদ কাশ্মিরও ভালো নেই। তাদের বড় একটা অংশও পাকিস্তান থেকে
মুক্তি চায়। তারা স্বাধীনতার দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করলেও তাদেরকেও
সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দমন করে রাখা হয়েছে। আর চীন তো তাদের দখলকৃত অংশে কোনো বিদেশি
কিংবা মিডিয়াকে ঢুকতেই দেয় না। ফলে সেখানকার খবর পাওয়া অনেকটাই দুস্কর।
তিনটা দেশের দখলকৃত অংশ বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতার আন্দোলন চালিয়ে আসছে দশকের পর
দশক ধরে। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ছিলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। প্রশ্ন হলো
তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার ডাক দেবে কে? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে দেখে
আসি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।
১৯৪৮ সালের কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শেষে হিটলারের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া
অবশিষ্ট ইউরোপীয় ইহুদিদের কোনো দেশই আর নিজেদের দেশে রাখতে চাইল না। তাদের জন্য
একটি স্বতন্ত্র দেশের প্রয়োজন দেখা দিলো। ইঙ্গ-মার্কিন জোট ষড়যন্ত্র করে আরবদের
ওপর তখনই চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল ইহুদিদের। আরবদের আপত্তি তারা মোটেও গ্রাহ্য
করল না। ফিলিস্তিনের ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠা করল ইসরায়েল নামক পৃথিবীর প্রথম ও
একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র। তাদের যুক্তি ছিল সত্তুর খ্রিষ্টাব্দে যেহেতু রোমানরা
ইহুদিদের জেরুজালেম থেকে গণহারে বিতাড়িত করেছিল, সেহেতু সেখানেই তাদের পুনর্বাসিত
করা ন্যায়বিচার। যদিও এটা ছিল ইতিহাসের বড় একটি ধাপ্পা। আদি ইসরায়েলি হিব্রু জাতির
বর্তমান বংশধর যদি কেউ হয়ে থাকে, খোদ ফিলিস্তিনি মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় তার
দাবিদার। গবেষণা করে বই লিখে এই দাবি প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বয়ং ইসরায়েলের তেলআবিব
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শোলমো স্যান্ড। তার সাড়া জাগানো 'দি ইনভেনশন অব
দ্য জুইয়িশ পিপল' বা ইহুদি জাতির আবিষ্কার নামক বইটি বেশ কয়েক মাস ইসরায়েলে বেস্ট সেলার
ছিল। শোলমো স্যান্ড তার দাবির পক্ষে ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ফরেনসিক
প্রমাণাদি হাজির করেছেন। স্যান্ডের দাবির সারসংক্ষেপ এই - ইহুদিরা কোনো জাতি
নয়; জাতি হতে গেলে যে সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ইতিহাস ও বর্ণগত মিল প্রয়োজন, তা
তাদের কোনোকালেই ছিল না। ইসরায়েলি ইহুদিদের বড় অংশ কখনোই আদি হিব্রু জাতির সদস্যও
ছিল না। এমনকি নবি মুসার অনুসারীদেরও ‘জিউ’ বলা হতো না। সেটা ছিল জুডায়ি ধর্ম।
তালেবানি ইসলাম যেমন আদি ইসলামের বিকৃতি, জায়নিজমও তেমন জুডায়ি বিশ্বাসের বিকৃতি।
বহু নিষ্ঠাবান ইহুদি এ কারণেই জায়নবাদের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে।
সত্তুর খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম থেকে
ইহুদিদের বিতাড়নের ঘটনাও কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। তারা বংশপরম্পরাগত ইহুদিও নয়। তারা
মূলত পূর্ব ইউরোপীয় খাজারীয় সাম্রাজ্যের লোকজন, প্রথম সহস্রাব্দের পরে যারা ইহুদি
হয়। খাজারিয়ারা ছিল বহিষ্কৃত কোনো এশীয় গোত্র। মধ্যযুগে রুশ সাম্রাজ্যের উত্থানে
খাজারিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে তারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং ইহুদিদের
ফিলিস্তিনের ওপর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। যাদের উৎপত্তি, জন্ম
ইতিহাস ও রাষ্ট্রীয় সংবিধান সম্পূর্ণ জোচ্চুরির বুনিয়াদে দাঁড় করানো, জবরদস্তি
ছাড়া তাদের টিকে থাকার আর উপায় থাকে না।
শোলমো স্যান্ডোর গবেষণা প্রমাণ করে, ইসরায়েলই হলো অভিবাসী পপুলেশন আর
ফিলিস্তিনিরাই সেখানকার আদি নেশন। কিন্তু এ দাবি ইসরায়েল মানেনি, তাই জবরদস্তি
করেই টিকে থাকাকে তারা লক্ষ্য মনে করে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর আরবদের সঙ্গে যুদ্ধ
বাধে তাদের। যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। এরপর মিত্রদের সহযোগিতায় দিন দিন তাদের শক্তি
বাড়তেই থাকে। ষাটের দশকে পারমানবিক অস্ত্রের মালিক হয়ে যায় তারা। আরব-ইসরায়েলের
মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরও তিনটি যুদ্ধ হয়। এতেও ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য পাল্টায়
না। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হন। ইসরায়েল হয়ে ওঠে আরও বেপরোয়া। অবৈধভাবে
নিজেদের সীমানা ছেড়ে ফিলিস্তিনে ঢুকে বাড়িঘর নির্মাণ করে, প্রয়োজনে হত্যার খেলায়
মেতে ওঠে। বিশ্বনেতারা চুপ করে দেখেন। অনেকে সমর্থনও দেয়, অনেকে মিনমিন করে
প্রতিবাদ জানায়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন
অরগানাইজেশন বা পিএলও। ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাত ছিলেন
সংগঠনটির চেয়ারম্যান। তিনি ফিলিস্তিনের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল ফাতাহরও নেতা
ছিলেন।
ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন করতে ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় নতুন
সংগঠন হামাস। যাদের রাজনৈতিক, সামাজিক শাখার সাথে সামরিক শাখাও রয়েছে। ইয়াসির
আরাফাতের ফাতাহ ধর্মনিরপেক্ষ দল হলেও হামাস কট্টরপন্থী সংগঠন হিসেবে পরিচিত।
ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে না কখনোই তারা।
২০০৪ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনের মহান নেতা ইয়াসির আরাফাতের 'রহস্যজনক' মৃত্যুতে
দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়৷ সেই থেকে ফিলিস্তিন
বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও সফলতার মুখ
দেখেনি, উল্টো নেতৃত্বশূন্যতা প্রবল আকার ধারণ করে আছে। সেই সুযোগে ইসরায়েল
আগ্রাসন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইসরায়েলের জন্মের আগে থেকেই রক্ত ঝরছে ফিলিস্তিনে, এই
রক্তের শেষ কোথায় কেউ জানে না।
বেলুচিস্তান, কাশ্মির ও ফিলিস্তিন ছাড়াও আরও অনেক জনপদ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন
করে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ, ভারতের সেভেন সিস্টার্স, চীনের তিব্বত,
স্পেনের কাতালুনিয়া, গ্রেট ব্রিটেনের স্কটল্যান্ডের কথা আমরা জানি। স্বাধীনতার
আকাঙ্ক্ষা আছে, রক্ত দেয়ার মত জনবলও আছে। তবু এই জাতিগুলো কয়েক দশক ধরে পরাধীন হয়ে
আছে। কারণ তাদের একজন বঙ্গবন্ধু নেই। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার ডাক দেয়া ও
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সমস্ত দেশ সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে এমন কোনো মহান নেতার
আবির্ভাব হয়নি সেসব দেশে। ফলে স্বাধীনতার স্বাদটা তাদের কাছে আজও অধরাই রয়ে গেছে।
বাঙালি ভাগ্যবান। হাজার বছর ধরে পরাধীন থাকলেও ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের
টুঙ্গিপাড়ায় একজন মুক্তিদূতের জন্ম হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণ-অভ্যুত্থান ও
অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে যিনি দীর্ঘ লড়াই করে গেছেন স্বাধীনতার জন্য। জীবনের
বেশিরভাগ সময় জেল খেটেছেন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। নিজের জীবনটাকে বাঙালির মুক্তির
জন্য কোরবানি বা বিসর্জন দিয়েছেন অকাতরে। যাকে জনগন এতটাই ভালোবাসত যে তার ডাকে
নিরস্ত্র হয়েও সশস্ত্র শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। যিনি তর্জনী
উঁচিয়ে বলেছিলেন 'তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। এবার
সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তারপর
থেকে তো স্বাধীনতা শব্দটিই বাঙালির, আমাদের।
পশ্চিম জার্মানির একটি পত্রিকা
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর লিখেছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে
তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে লুইয়ের মতো তিনিও দাবি করতে পারেন
যে, আমিই রাষ্ট্র।’ হ্যাঁ, তিনিই রাষ্ট্র ছিলেন, তিনিই তার জনগনকে 'তুমি'
সম্বোধন করে কথা বলার অধিকার রাখতেন, তিনিই একটা বিশৃঙখল জাতিকে প্রথমবার ও সম্ভবত
শেষবারের মত ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। ফলে মাত্র নয়মাসে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ
প্রাণ দিতে দ্বিধা করে না। বাঙালির একজন মুজিব ছিল বলেই অন্যান্য জাতির মতো দশকের
পর দশক ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়নি। মাত্র নয়মাসেই স্বাধীন একটি
রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু করতে পেরেছিল। তাই এই মহান নেতাকে অনেকে বলেন ম্যাজিশিয়ান,
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা কিংবা পোয়েট অফ পলিটিকস।
স্বাধীনতা এত সহজ নয়৷ তার জন্য দীর্ঘ পথ পরিক্রমা পাড়ি দিতে হয়, অনেক আত্মত্যাগ
করতে হয়। তবু স্বাধীনতা কেউ পায় কেউ পায় না। বালুচিস্তান ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীন
জাতি, তারা কখনোই পরাধীন থাকতে চায় না। তাদের সবই আছে, কিন্তু একজন নেতার অভাবটা
বিমূর্ত হয়ে ওঠে বারবার। কারণ যুদ্ধ শুধু শক্তিতে হয় না, লাগে কৌশল, লাগে কূটনীতি।
বঙ্গবন্ধু যে কৌশলে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, দারুণ কূতনীতির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন
ও ভারতের মত বড় শক্তির সহযোগিতা নিয়ে আসেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরোধিতা
সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন, তাতে তিনি গ্রেফতারের আগেই
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, নেতা
জেলে আছেন নাকি মারা গেছেন সেটা না জানা সত্ত্বেও তার জনগন ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে।
নেতার দিয়ে যাওয়া নির্দেশ পালন করে অক্ষরে অক্ষরে। ফলে স্বাধীনতাটা অনিবার্য হয়ে
যায় বাঙালির জন্য। বালুচিস্তান, কাশ্মির, ফিলিস্তিন্সহ অপরাপর স্বাধীনতাকামী
জাতিগুলো এই জায়গাটিতেই মূলত পিছিয়ে আছে এখনও।
আজ অনেক বাঙালিই স্বাধীনতার মর্ম বোঝে না, জাতির জনকের নেতৃত্ব কীভাবে দেশটাকে
স্বাধীন করেছিল জানে না। অহেতুক বিতর্কের ঝড় তোলে মীমাংসিত ইতিহাস নিয়েও।
ইতিহাস-বিস্মৃত এই জাতি যদি দশকের পর দশক ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা
জাতিগোষ্ঠীগুলোর দিকে তাকাত, তাহলে দেখত কত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা স্বাধীনতার জন্য
রক্ত দিয়ে যাচ্ছে আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একজন বঙ্গবন্ধুর, একজন নেতার।
এখানেই বঙ্গবন্ধু অন্যন্য হয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন।
0 মন্তব্যসমূহ