মেধাবীরা রাজনীতিতে আসেন না বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। এই সময়ের জন্য কথাটা সত্যি হলেও একটা সময় এই উপমহাদেশের রাজনীতি ছিল মেধাবীদের অভয়ারণ্য। বিখ্যাত অনেক স্কলার ছাত্রও তখন দেশের জন্য, মানুষের জন্য আন্দোলনে নিজেদের বিলিয়ে দিতেন অকপটে। এমনই এক স্কলার ১৯৪৪সালের মেট্রিকুলেশন (এসএসসি) পরীক্ষায় অবিভক্ত বাংলার একমাত্র শিক্ষাবোর্ড কলকাতা বোর্ড থেকে ১২তম স্থান অধিকার করেছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে দু বছর বিরতি দিয়ে ১৯৪৮ সালে পূর্ব-পাকিস্তান শিক্ষাবোর্ডে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অর্জন করেন ৪র্থ স্থান। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) পাশ করেন। মূল বিষয় অর্থনীতির পাশাপাশি সাবসিডিয়ারি কোর্স হিসেবে অধ্যায়ন করেন ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেন আইনশাস্ত্রের পাঠও।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি নিয়মিত কোর্টে যাতায়াত করতেন উকিল ও জজ সাহেবদের আলোচনা, তর্ক ও বির্তক শোনার জন্য। আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূগোল, যুদ্ধ ও মনীষীদের বিভিন্ন জীবনী সম্পর্কে প্রায় ৫০-৬০টি বই পড়ে ফেলেন তিনি। এমন মেধাবীই যখন রাজনীতিতে নেমে দেশের জন্য কাজ করতে শুরু করেন, তখন সে দেশের মুক্তি আর কেউ আটকাতে পারে না। বাংলাদেশের ইতিহাস যাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ সেই তাজউদ্দীন আহমদের কথাই বলছি আজ।
গাজীপুরের কাপাসিয়ার এক ছোট্র গ্রাম দরদরিয়ায় ১৯২৫সালের ২৩শে জুলাই জন্ম নেয়া তাজউদ্দীন আহমদ ছোটবেলাতেই ছিলেন অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী। স্কুলে তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখে কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ প্রাইমারি স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মফিজউদ্দীন সাহেব তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে সব শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সে হলো গ্রেট স্কলার। সে হলো রত্ন। তার মাঝে আমি বিরাট ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।’
হ্যাঁ, ভবিষ্যতই ছিলেন তিনি। বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের অন্যতম ভবিষ্যৎ। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙখল থেকে জাতিকে মুক্ত করার অন্যতম প্রধান কারিগর হয়েছিলেন নিজের মেধা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, নেতৃত্বগুণ, দূরদর্শিতা আর সৃজনশীলতার সমন্বয়ে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পুরো মুক্তিযুদ্ধজুড়ে যিনি জাতিকে দেখিয়ে গেছেন পথের দিশা, দিয়েছেন মুক্তির নতুন ঠিকানা। তিনিই ছিলেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছিল পাকিস্তানিদের সাথে। সত্তুরের নির্বাচনে জেতার পর ক্ষমতা না দিয়ে টালবাহানা করছিল পাকিস্তানিরা। সব বৈঠক আর আলোচনাই ব্যর্থ হচ্ছিল। এরকমই একটা বৈঠকের আগে ভুট্রো বলেছিল- "আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না। ইমোশনাল অ্যাপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায়, কিন্তু তার পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, হি উইল বি আওয়ার মেইন প্রবলেম।"
তাজউদ্দীনকে কাবু করা যায়নি। একাত্তরে পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরুর পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ফেলে পাকিস্তানিরা। তাজউদ্দীন আহমদ দায়িত্ব নেন। চলে যান ভারতে। একাত্তরের ২৭শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চোখ এড়িয়ে, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করার সময় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক চিরকুটে তিনি স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন লিলিকে লিখেছিলেন–“লিলি, আমি চলে গেলাম। যাবার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না। হয়তো মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও। — দোলনচাঁপা।”
উল্লেখ্য, দোলনচাঁপা ছিল সে সময়ে তার ছদ্মনাম।
ভারতের পথে যেতে যেতে মানুষের চোখেমুখে তিনি আকাঙ্ক্ষা দেখেছিলেন, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষায় তাকে বলে দেয় স্বাধীনতার গন্তব্য ছাড়া আর কোনো গন্তব্য নেই। তিনি বলেন- “পালিয়ে যাবার পথে এদেশের মানুষের স্বাধীনতা চেতনার যে উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম, সেটাই আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অনিবার্য সুযোগ দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টুঙ্গি (কুষ্টিয়া জেলায়) নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা হলো একটি স্বাধীন বাংলা সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে কাজ শুরু করা।”
কাজ শুরুও করেছিলেন খুব দ্রুত। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে ১৯৭১সালের ১০ই এপ্রিল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং সেদিনই স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্ববাসীকে সদ্যজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানান। ১১ই এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে তিনি বিভিন্ন সেক্টরের নাম ঘোষণা করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ এবং প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের খুঁজে বের করেন। দেশের মাটিতেই শপথগ্রহণ হবে, এটাই ছিল তার ইচ্ছা। সে অনুযায়ী, ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার (এখন জেলা) বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ তার প্রিয় নেতার নামে এই ঐতিহাসিক স্থানটির নতুন নামকরণ করেন 'মুজিবনগর', যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী।
প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পাশে ছোট্র একটি কামরায় তিনি থাকতে শুরু করেন। একটাই মাত্র জামা ছিল তার। সেটি ধুয়ে দিয়ে গেঞ্জি পরে থাকতেন। জামা শুকানোর পর সেটি পরে অফিসে যেতেন। সেই সময় পরিবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলেন। মেস থেকে আসা খাবার খেতেন তিনি। কারণ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভা তখন শপথ করেছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পরিবারের কারও সাথেই মিলবেন না। ওনার ভাবনায় ছিল মুক্তিযোদ্ধারা যদি পরিবার ছেড়ে যুদ্ধ করতে পারে, তাহলে তিনি কেন পরিবার ছেড়ে থাকতে পারবেন না!
যুদ্ধকালীন তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শিতায় মুক্তিবাহিনী দারুণভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যুদ্ধ করছিলেন যোদ্ধারা, তিনি ছিলেন দিক-নির্দেশনায়। সেই সাথে বিদেশের সমর্থন আদায়ে নিরলস কাজ করে গেছেন। যার ফলস্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নের মত পরাশক্তি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও সেখানকার সাধারণ জনগণ ছিল মুক্তিকামী মানুষের পাশে। ভারত অবতীর্ণ হয় মিত্রের ভূমিকায়।
ভারতকে মিত্র হিসেবে মেনে নিলেও তাজউদ্দীন আহমদ লড়াইটা নিজেরাই করার জন্য উদ্যোগী হন। তিনি চাইলে তখন ভারত শক্তি প্রয়োগ করে সহজেই পাকিস্তানিদের হটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন নিজেদের লড়াইটা নিজেরাই করতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে তিনি বলেছিলেন–“এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদের স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই।” এমনকি ৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী এদেশে ঢোকার আগেও তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে যেন ঢুকে। তাই করেছিল তারা। স্বাধীন বাংলাদেশে মিত্রবাহিনী হিসেবেই প্রবেশ করেছিল ভারতীয়রা।
তাজউদ্দীন আহমদের প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতার সাথে পেরে উঠছিল না পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসররা। ব্যর্থ হয়ে তারা খেলতে শুরু করে ষড়যন্ত্র ও ধর্মের কার্ড৷ যদিও তাদের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি। তার ভাষায়- “পাকিস্তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি… সংগ্রামের এক পর্যায়ে আমেরিকা প্রশ্ন তোলে, স্বাধীনতা চাও নাকি মুজিবকে চাও। এর উত্তরে আমি বলেছিলাম স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই।”
ধর্মের নামেও তারা বিরোধিতা শুরু করে, প্রচার করতে থাকে তিনি হিন্দু হয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আর জামায়াতের পক্ষ থেকে লিফলেট ছড়ানো হত- "তাজউদ্দীন ভারতে গিয়া হিন্দু হইয়াছেন..."
একাত্তরে একজন পাকিস্তানি অফিসার তাজউদ্দীন আহমদের শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিল- “সৈয়দ সাহেব, আপনি ছিলেন আরবি প্রফেসর এবং ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধেও আপনার অগাধ জ্ঞান রয়েছে। অথচ আপনার মেয়ের কী না বিয়ে দিলেন এক হিন্দুর সঙ্গে”। অথচ তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন কোরআনে হাফেজ ও প্র্যাকটিসিং মুসলমান। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দৈনিক সংগ্রামের লেখাগুলো পড়েছেন তারা ভালো করেই জানেন পুরো একাত্তরজুড়েই তাজউদ্দীন আহমদকে তারা 'শ্রী তাজউদ্দীন' লিখত। বাঙালি গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড ও প্রাচ্যের হিটলারখ্যাত গোলাম আজম সংগ্রামে সম্পাদকীয় লিখেছিল- "বাংলাদেশ বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হবে, এ মতবাদ শ্রী তাজউদ্দীনের..."
মুক্তিযোদ্ধাদের 'ভারতের দালাল', 'দুস্কৃতিকারী' থেকে শুরু করে কাফির, নাস্তিকও ফতোয়া দেয়া হত। তাজউদ্দীন আহমদও ছিলেন না সেই ফতোয়ার বাইরে। অথচ তিনি এতটাই দেশপ্রেমিক ছিলেন যে ভারতে থাকাবস্থায়ও নিজের ঘড়ির সময় পরিবর্তন করেননি, ভারতের সময়ের সাথে না মিলিয়ে দেশের সময়েই তিনি ঘড়ি দেখতেন।
রাজনীতির এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন; ছিলেন যুবলীগের নেতৃস্থানীয় সদস্যও। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই তিনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান তাকে সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয়দফা প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তার। বঙ্গবন্ধু যেদিন পূর্ব পকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন; সেদিনই তাজউদ্দীন আহমদ হন সাধারণ সম্পাদক। শুরু হয় বাংলার রাজনৈতিক রাজপথে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন জুটির ঘনিষ্ঠভাবে পথ চলা। যে পথচলায় স্বাধীন হয়ে যায় একটি জাতি। প্রতিটি আন্দোলনেই যে জুটিটি ছিল অবিচল ও দুর্দমনীয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর কুচক্রীরা শুরু করে ষড়যন্ত্র। বাঙালিকে অন্ধের মত বিশ্বাস করা জাতির জনককে ভুল বুঝিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তার প্রতি নিদারুণ আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ তিনি ১৯৭৪ সালের ২৬শে অক্টোবর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ উল্লাহ তার পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করেন। পদত্যাগের আগে তিনি অর্থ, বন, মৎস্য উন্নয়ন ও পশু পালনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। এমআর আখতার মুকুল তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ সম্পর্কে লিখেন- “মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। মনে হলো বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে শাণিত তরবারি অদৃশ্য হয়ে গেল। …ছায়ার মতো যে নির্লোভ ব্যক্তি অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেছেন এবং নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ দিয়ে বহু বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন, এক গোপন চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে শেখ সাহেব সেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন।"
অভিমানী তাজউদ্দীন পদত্যাগ করলেও বঙ্গবন্ধুর সাথে বেইমানি করেননি, বরং তার প্রিয় মুজিব ভাইয়ের বিপদের চিন্তায় দিন কাটাতেন। তার অভিমানের অন্যতম একটি কারণ ছিল এটাই যে, প্রিয় মুজিব ভাই তার কাছ থেকে কখনো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনাবলী জানতে চাননি, তিনিও বলার সুযোগ পাননি। সে ঘটনাবলী শুনলে হয়তো বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গতাজের দূরত্ব তৈরি হত না। বাংলাদেশকে দেখতে হত না ১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বরের মত নির্মম ঘটনা।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি আফসোস করে বলেছিলেন- ‘আজ আমি যদি মন্ত্রিসভায় থাকতাম, তাহলে কেউ বঙ্গবন্ধুর গায়ের লোম পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারত না।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই জেনে যেতে পারলেন না, কারা তার বন্ধু ছিলো আর কারা ছিল শত্রু।’ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুইমাস ১৮ দিনের মাথায় সংঘটিত হয় বাঙালির ইতিহাসের আরেক নির্মমতার করুণ কাহিনি- জেল হত্যাকাণ্ড। সেদিন জাতীয় তিন নেতার সাথে জেলের মধ্যেই নির্মমভাবে শহীদ হন কীর্তিমান এই মহান পুরুষ বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের সমার্থক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বাহাত্তরের সংবিধানে রেখেছিলেন ভূমিকা। স্বপ্ন দেখতেন একদিন এদেশেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। তবে এদেশের সমাজতন্ত্রের রূপরেখা নিজেই দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন- "আমরা বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব, যা সোভিয়েত রাশিয়া কিংবা চীনের ধরণের হবে না, বরঞ্চ তা হবে আমাদের নিজেদের মতো। আমরা গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে একটি সুষম সমন্বয় ঘটাব, যা বিশ্বে একটি অসাধারণ ব্যাপার হবে।"
আপাদমস্তক নির্লোভ, নিরহঙ্কারী ও বিনয়ী তাজউদ্দীন আহমদ চলে গেলেও ইতিহাসের আনসাং হিরো হয়ে বেঁচে আছেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। দেশের জন্য, মানুষের জন্য যিনি এতটাই ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন যে, তাকে ছাড়া এদেশের ইতিহাস লেখার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না কেউই। দেশের প্রতি কমিটমেন্টের অসাধারণ বার্তাবাহী তার একটি উক্তি দিয়েই শেষ করছি।
"আমি দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করবো যেন দেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এদেশটাকেই খুঁজে পায়; কিন্তু আমাকে হারিয়ে ফেলে"।
0 মন্তব্যসমূহ