"আমার সফলতার ভিত্তিতে আমাকে বিচার করো না, আমাকে বিচার করো আমার ব্যর্থতা এবং
ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়ানোর ভিত্তিতে।"
“শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, যার মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলে ফেলা যায়”।
আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার অসাধারণ অনুপ্রেরণাদায়ী এমন
অনেক উক্তি প্রায়ই দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে শেয়ার করেন। কিন্তু তাদের অনেকেই জানেন
না উনি কে ছিলেন, কী কাজ করে গেছেন এই পৃথিবীর জন্য।
৪৬৬৬৪ বা ফোর ট্রিপল সিক্স ফোর কুখ্যাত এই নামেই তিনি সারাবিশ্বে পরিচিত। বর্ণবাদের
বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন আমৃত্যু। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের হয়ে শুরু করেন রাজনীতি।
শেতাঙ্গ সরকার রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর গড়ে তোলেন সশস্ত্র সংগঠন 'এম কে'।
সশস্ত্র আন্দোলন করতে গিয়েই ধরা পড়েন, আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
ঠাঁই হয় রোবেন দ্বীপের কুখ্যাত কারাগারে। যেখানে তিনি ছিলেন ৪৬৬ নাম্বার কয়েদী, আর
সালটা ছিল ১৯৬৪। সেখান থেকেই উৎপত্তি 46664 নাম্বারের।
১৯১৮ সালের ১৮ই জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম। তার বাবা ছিলেন ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের
থেম্বো রাজকীয় পরিবারের কাউন্সিলর। বাবা নাম রেখেছিলেন রোলিহলাহলা ডালিভুঙ্গা ম্যান্ডেলা।
স্কুলে পড়ার সময় এক শিক্ষক তার ইংরেজি নাম দেন নেলসন। সেই থেকেই তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা
নামে পরিচিতি পান।
তরুণ বয়সে নেলসন ম্যান্ডেলা চলে আসেন জোহানেসবার্গ শহরে, সেখানে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল
কংগ্রেসের যুব শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে। সেইসঙ্গে তিনি কাজ শুরু করেন একজন আইনজীবী হিসেবেও। আফ্রিকান
ন্যাশনাল কংগ্রেসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা অলিভার টাম্বোর সঙ্গে মিলে তিনি তার অফিস
খোলেন জোহানেসবার্গে।
১৯৬০ সালে শার্পভিলে কৃষ্ণাঙ্গ বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলিতে ৬৯জন নিহত হলে বর্ণবাদবিরোধী
আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আদৌ আর লাভ হবে কিনা সে প্রশ্ন উঠতে
শুরু করে। সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন তিনিও। তখন এক বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন,
"সরকার যখন নিরস্ত্র এবং প্রতিরোধবিহীন মানুষের ওপর পাশবিক আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন
সরকারের সঙ্গে শান্তি এবং আলোচনার কথা বলা নিস্ফল।"
১৯৬২ সালের ৫ই আগস্ট নাশকতা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টার দায়ে
অভিযুক্ত ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ছিল সেটা। শুরু হয় তার
বিচারপর্ব, যেটি ইতিহাসে প্রসিদ্ধ ‘রিভোনিয়া ট্রায়াল’ নামে। ১৯৬৪সালের ১২ই জুন রায়
ঘোষণা হলো, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া তাকে। স্থায়ী কয়েদি জীবন শুরু হলো সেই থেকেই।
আফ্রিকান ভাষায় রোলিহলাহলা মানে হলো 'ঝামেলাবাজ'। এই ঝামেলাবাজ লোকটিই একসময় হয়ে ওঠেন
শান্তির প্রতীক। সাদা আর কালোর বৈষম্য গোছাতে আন্দোলন করে দীর্ঘ ২৭বছর জেল খাটেন, যার
বেশিরভাগই রোবেন দ্বীপে। জেলজীবনের ৪৬৬৬৪ নাম্বারটিই একসময় হয়ে ওঠে তার আন্দোলনের প্রতীক।
তিনি হয়ে ওঠেন আফ্রিকানদের প্রিয় 'মাদিবা', যার অর্থ জাতির জনক।
দীর্ঘ ১৮বছর রোবেন কারাগারের নিঃসঙ্গ কক্ষে জেলবন্দী থাকার পর ১৯৮২ সালে তাকে সাউথ
আফ্রিকার মূল ভূখণ্ড পলসমুর জেলখানায় নিয়ে আসা হয়। ম্যান্ডেলাসহ এএনসির বেশিরভাগ নেতাই
তখন জেলবন্দী অথবা দেশান্তরী ছিলেন। তবু সে দেশের কৃষ্ণাঙ্গরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
রক্তের ফোয়ারা বইছিল বিভিন্ন কৃষ্ণাঙ্গ জনপদে, কিন্তু থেমে ছিল না আন্দোলন। সেই আন্দোলন
একসময় একদফায় রূপ নেয়। সেটা হলো ম্যান্ডেলার মুক্তি। সারাবিশ্ব থেকে চাপ আসে আফ্রিকা
সরকারের ওপর। ১৯৮৮ সালে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়া ৭২ হাজার মানুষ ‘ম্যান্ডেলাকে
মুক্ত করো’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠেন, বিশ্বময় কোটি কোটি মানুষ টেলিভিশনের স্ক্রিনের
সামনে বসে তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একই দাবি জানালেন।
১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। অবসান ঘটে তার দীর্ঘ ২৭বছরের কয়েদি জীবনের।
১৯৯৩ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হোন। ১৯৯৪ সালে বিপুল ভোটে নির্বাচিত
হোন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। সে নির্বাচনেই সাউথ আফ্রিকায় প্রথমবারের মত সব ধর্ম, বর্ণ,
জাতের মানুষ একইভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। আজকের যে আফ্রিকা সাদা-কালোর মিশেলে গড়ে
উঠেছে, তার ভিত্তি মূলত ম্যান্ডেলাই তৈরি করে দেন। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক 'লং ওয়াক
টু ফ্রিডম' বইয়ে দীর্ঘ এই সংগ্রামের কথা সবিস্তারে বিবৃত করেছেন।
১৯৯৭ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা এসেছিলেন বাংলাদেশেও। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত
অনুষ্ঠানে তাকেসহ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত
আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেলকেও। সেটাই ছিল বাংলাদেশে তার প্রথম এবং শেষ
সফর। তিনদিনের এই সফরে আরও নানান কর্মসূচির সাথে ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
শিখা চিরন্তন ও স্বাধীনতার স্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন তিনি।
সে বক্তৃতায় তিনি বলেন, ''স্বাধীনতা আর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের
সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের অনেক মিল রয়েছে। আজ আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি,
বাংলাদেশের মানুষকেও একসময় এরকম সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। একটি দূরের দেশ হওয়া
সত্ত্বেও সাউথ আফ্রিকার মানুষের মুক্তি-সংগ্রামে আপনারা যে সমর্থন দিয়েছেন, সেজন্য
আপনাদের প্রতি আমি তাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।''
গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর তাকে নিয়ে গান বেধেছিলেন, যেটি হোটেল শেরাটনে শিল্পীর কণ্ঠেই
শুনেছিলেন তিনি।
১৯৯৯সালে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও আর নির্বাচন না করে অবসর নেন তিনি। অবসরের
পরও শান্তির জন্য সারা পৃথিবীতে কাজ করেন, হয়ে ওঠেন শান্তির আইকন, বিশ্বের অবিসংবাদিত
এক মহান মানুষ। শান্তির পক্ষে ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশ ও পৃথিবীর নানাপ্রান্তে কথা
বলে বেড়াতেন। একজন জনপ্রিয় বক্তা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে রিভোনিয়া ষড়যন্ত্র
মামলার শুনানি চলাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি।
আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি আদর্শিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের
প্রশংসা করি, যেখানে সব মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবেন এবং সমান সুযোগ লাভ
করবেন। এটি হচ্ছে একটি আদর্শিক অবস্থান, যার মধ্যে দিয়ে বাঁচা দরকার এবং আমি তা অর্জনের
আশা করি। কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ, যদি প্রয়োজন পড়ে, তার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু নেলসন ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর ৯৫বছর বয়সে মারা
যান। তার মৃত্যুতে পৃথিবীর নানা জায়গায় শোক পালন করা হয়। বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয়ভাবে
তিনদিনের শোক পালিত হয়।
সারাজীবন মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করা নেলসন ম্যান্ডেলা শুধু আফ্রিকা নয়, পুরো
পৃথিবীর জন্যই ছিলেন শান্তির এক মহান দূত। মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বর্ণবাদবিরোধী
আন্দোলন ও কিছু শ্বেতাঙ্গের বর্ণবাদী আচরণ প্রমাণ করে দেয় বর্ণবাদবিরোধী লড়াইটা এখনও
শেষ হয়নি। যেখানেই বর্ণবাদী আচরণের দেখা মিলবে, সেখানেই ম্যান্ডেলার রেখে যাওয়া লড়াইটা
চালিয়ে নিতে হবে প্রবলভাবে। তবেই মিলবে মুক্তি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0
মন্তব্যসমূহ
আমার আমি
জীবনে যা হতে চেয়েছিলাম তা হতে পারিনি। নিজের মতের বিরুদ্ধে কখনও যাইনি, মন যা চেয়েছে তাই করেছি সবসময়। এজন্য জীবনে মাশুলও গুনেছি প্রচুর। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম নিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বলি, আপস করি না নিজের আদর্শের সাথে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মত করে বলি ‘আপস করিনি কখনোই আমি, এই হলো ইতিহাস’। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর মত করে বলি ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। একবার মরে, দুইবার মরে না’।
নিজের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কখনও করিনি। শুধু ফেলে আসা অতীতের কথাগুলো যখন মনে হয় তখন বলি, সময় বদলে যায়, সবাই আলোকিত হয়। আমিই শুধু পড়ে থাকি জীবনের গহীন উপত্যকায়, জীবন্মৃতের মত।
0 মন্তব্যসমূহ