গত সাড়ে ৪ বছরের একটি মাসও নেই যে মাসে অন্তত একবার অর্পা পার্কের রাস্তার পাশে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে এসে বসেনি। যে কৃষ্ণচূড়া গাছটি ছিল তার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর সাক্ষী, সে গাছটির কাছে না এসে অর্পা কখনই থাকতে পারেনি, পারবেও না। জীবন থেমে থাকে না, বয়ে চলে তার আপন গতিতে। কিন্তু অর্পার একেকটি মুহূর্ত যেন একেকটি বছরের সমান। অপেক্ষার প্রহর যে এত কষ্টের সেটা জানলে কখনই সে আয়ানকে বিদেশের মাটিতে জীবনযুদ্ধে যেতে দিত না। ছোট্র একটি সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল অর্পা, যে সংসারে দুঃখ বলতে কোনো শব্দ থাকবে না। কিন্তু সুখ ব্যাপারটাই এমন চাইলেও যেটা পাওয়া যায় না। এজন্য ভাগ্যেরও ছোঁয়া লাগে। ভাগ্যটা এত বেশি বিট্রে করবে অর্পার সাথে সে আসলে ভাবতে পারেনি। প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে বসে অর্পা ভাবনার অতলে হারিয়ে যায়। জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে যায় তার।
২.
বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্পা যখন প্রথম বর্ষে পড়ত, আয়ান তখন তৃতীয় বর্ষে। দুজনেই একই ডিপার্টমেন্টে পড়লেও প্রথমে কেউ কাউকে চিনত না। সেবার শীতে তাদের ডিপার্টমেন্টের সকল বর্ষের ছাত্র ও শিক্ষক মিলে শিক্ষা সফরের আয়োজন করেছিল। একদিনের সে শিক্ষা সফরে গিয়ে বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীরা আনন্দ করছিল, যার মধ্যে গান, আবৃত্তি ও কুইজও ছিল। আবৃত্তির সময় অর্পা দেখল হালকা গড়নের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা একটা ছেলে আবৃত্তি করতে এগিয়ে এল, সঞ্চালক আগেই ঘোষণা দিয়েছিল ছেলেটার নাম ধরে। আয়ান তার নাম। সে আবৃত্তি করে শুনালো কবি নির্মলেন্দু গুণের “দুঃখ করো না, বাঁচো” কবিতাটি। কবিতা ব্যাপারটা যদিও অর্পার ভালো লাগে না, তবু সেদিন আয়ানের গলায় কবিতাটি শুনে এত ভালো লেগেছিল তার যে, সে জাস্ট মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কবিতা যে এত অসাধারণভাবে আবৃত্তি করা যায় সেটা আসলে জানতোই না অর্পা!
শিক্ষা সফর থেকে ফিরে পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়েই আয়ানের সাথে পরিচয় হতে গেলো। গিয়ে দেখল সে আজ ক্যাম্পাসে আসেনি। পরদিন আবার গেলো, কিন্তু সেদিনও তাকে পেলো না। ৪/৫ দিন যখন টানা খোঁজ করে জানল সে ক্যাম্পাসে আসছে না এবং এও জানল আয়ান ক্লাস মিস করে না। তাতে মনটা খারাপ হলো অর্পার, উদ্বিগ্নও হলো কিছুটা। আয়ানের এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে তার ঠিকানা নিলো। এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে চলে গেল ঠিকানামত। গিয়ে দেখল আয়ান আসলে একটা মেসে থাকে এবং মেসটা খুবই বাজেরকমের খারাপ। তার ডিপার্টমেন্টের ব্রিলিয়ান্ট সিনিয়র ছাত্রটি এমন জায়গায় থাকে সে আসলে কল্পনাই করেনি। বড় ব্যবসায়ীর মেয়ে অর্পা, উচ্চবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। এমন নোংরা মেসের পরিবেশ সে দেখেনি। যাই হোক, আয়ানের মেসে গিয়ে জানল সে তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছে, হঠাৎ করে গ্রাম থেকে খবর আসায় আজ পাঁচদিন ধরে সেই যে গ্রামে গেছে, এখনও ফেরেনি। তার রুমমেট সালাম নামক ছেলেটিকে অর্পা একটা কাগজ আর কলম দিতে বলল। সে একটা চিরকুট লিখে সালামের হাতে দিয়ে বলল আয়ান এলে যেন দিয়ে দেয়।
৩.
প্রায় ১৫ দিন পরে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে কফি খাচ্ছিল অর্পা। হঠাৎ একটি ছেলে এসে দাঁড়াল
তার সামনে। এসে বলল ‘আমি যদি ভুল করে না থাকি তাহলে আপনি নিশ্চয়ই মিস অর্পা?’
-হ্যাঁ।
-আমি আয়ান।
-দেখেই চিনতে পেরেছি। কিন্তু
আপনার এ কী হাল! আপনাকে অনেক বিধ্বস্ত
লাগছে।
-বেঁচে যে আছি সেটাই বড়
ব্যাপার। সে যাকগে, আমার খোঁজ করছিলেন কেন বলেন। প্রথমে ক্যাম্পাস, পরে আমার মেসেও
গিয়েছিলেন, চিরকুটও দিয়ে এসেছিলেন আমার রুমমেটের কাছে। ব্যাপারটা কী বলুন তো?
-যদি কিছু মনে না করেন, প্লিজ
আপনি বসলে খুশি হতাম। এক কাপ কফি খেলে আরও খুশি হতাম।
-ধন্যবাদ। কফি খাব না, তবে
বসছি। তাড়াতাড়ি বলুন, আমার তাড়া আছে বলে বসল আয়ান।
-আসলে কোনো বিশেষ কারণে আপনাকে
খুঁজিনি। সেদিন ট্যুরে আপনার কবিতা শুনে খুব ভালো লেগেছিল তাই পরিচয় হতে গিয়েছিলাম। যখন
শুনলাম আপনি কয়েকদিন ক্যাম্পাসে আসেন না তখনই মেসে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কোনো
অসুখ-বিসুখ করেনি তো। গিয়ে শুনলাম আপনি গ্রামে, তারপর একটা চিরকুট রেখে চলে এলাম।
এই হলো ব্যাপার।
-ও আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। আমাকে
এখন উঠতে হবে, খুব জরুরি একটা জায়গায় যেতে হবে।
-সমস্যা নেই। কিন্তু আজ তো কফি
খেলেন না, কাল কিন্তু অবশ্যই খেতে হবে। এখানে আসবেন।
-চেষ্টা করবো- বলে ওঠে যায় আয়ান।
৪.
এরপর আয়ান আর অর্পা ক্যাফেটেরিয়া থেকে আস্তে আস্তে পার্কে চলে যায়, বন্ধুত্বটা তাদের গভীর হতে হতে প্রেমের দিকে গড়াতে থাকে। অর্পা জানতে পারে আয়ান সেবার বাবার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে দ্রুত বাড়িতে চলে গিয়েছিল, সে যাওয়ার পর তার বাবা মারা যান। বাবাকে হারিয়ে শোকে বিধ্বস্থ হয়ে সে ঢাকায় ফিরেছিল, ফলে তার চেহারা সেদিন ওমন মলিন দেখাচ্ছিল। এসব শুনে অর্পা তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেয়, আজীবন তার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। আয়ান মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, গ্রামে তার মা ও এক ছোট বোন আছে। কিন্তু পারিবারিকভাবে কোনো আয় নেই তাদের। কারণ তার বাবা ছিলেন কৃষক। আয়ান কয়েকটা টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালায় আর মা আর বোনকেও টাকা পাঠায়। তবে আয়ানের যে জিনিষটা অর্পার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল সেটা হলো তার কবিতাপ্রেম। একজন ফিজিক্সের তুখোড় ছাত্র হয়েও কীভাবে সাহিত্য আর কবিতা আয়ানের প্রিয় হয়ে গেল সেটা ভেবে পায় না অর্পা। কিন্তু আয়ানের আবৃত্তি শোনার জন্য প্রায়ই পার্কের কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে আসে। কৃষ্ণচূড়া গাছ আর ফুল দুটোই আয়ানের প্রিয় আর সেখানে বসেই তারা এক রঙিন কৃষ্ণচূড়া প্রেমে মত্ত হয়, দিনের পর দিন।
৫.
একদিন আয়ানের মাস্টার্স সম্পন্ন হয়, অর্পা তখনও অনার্স চতুর্থ বর্ষে। মাস্টার্সের রেজাল্টের পরই আয়ানের একটা সুযোগ আসে বিদেশে স্কলারশিপ পেয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার। কিন্তু সে অর্পাকে রেখে যেতে চায় না। অর্পাই তাকে বোঝায় যে এই অবস্থায় অর্পার বড় ব্যবসায়ী বাবার সামনে গেলে তিনি আয়ানের সাথে সহজে অর্পার বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। তারচেয়ে বিদেশে গিয়ে আরও যোগ্য হয়ে এলে তার বাবা মানা করতে পারবেন না। আয়ান চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায়।
উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সে একটা চাকরি পায়, সেখানেই কর্মজীবন শুরু করে। ফোনে ও চিঠিতে অর্পাকে আপডেট জানায়। অর্পা খুশি হয়। একদিন সেও মাস্টার্স শেষ করে। স্বাভাবিকভাবেই বাবা তার বিয়েও দিতে চান। কিন্তু অর্পা রাজি হয় না। হঠাৎ করে আয়ানও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। প্রায় দুই বছর ধরে সে কোনো যোগাযোগ করে না। অর্পা অসহায় হয়ে যায়। সে আয়ানের প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে বসে থাকে শুধু, আর ভেতরটা তার গুমরে কেঁদে মরে!
৬.
আরও ১ বছর এভাবেই কাটে, আয়ান তবু যোগাযোগ করে না। আয়ানের বিদেশের নাম্বারটি অফ দেখায় বারবার, আয়ান চিঠিতে যে ঠিকানা ব্যবহার করেছিল সেটিতে চিঠি দিলেও কোনো জবাব আসে না। আয়ানের গ্রামের ঠিকানাও জানে না বলে সেখানেও যোগাযোগ করতে পারে না। এদিকে বাবাকে ফিরিয়ে দিতে দিতেও যখন আর পারছিল না তখন এ জীবনটা তার কাছে দুর্বিসহ, বিষের মত মনে হয়। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় সে আত্মহত্যা করবে। একদিন রাতে একা বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। মেইন রাস্তায় গিয়ে একটা পাজেরো টাইপের জিপের সামনে নিজেকে সঁপে দেয়। এরপর আর কিছুই বলতে পারে না। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু আয়ানের মুখচ্ছবিটা চোখে ভাসে তার। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাসপাতাকে আবিষ্কার করে সে। দেখে আয়ান তার পাশে বসা। কিছুই বুঝতে পারে না সে। ভাবে নিশ্চয়ই মারা গেছে। মারা যাওয়ার পর মৃত্যুর পরের জগতে হয়তো আয়ান তার কাছে এসেছে। ওঠে বসতে গিয়ে যখন সারা শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে গেল তখন বুঝলো সে বেঁচে আছে এখনও আর আয়ানও বাস্তবে এসেছে। আয়ান তাকে ধরে শুইয়ে দেয় আর বলে ‘প্লিজ, ওঠো না, তুমি এখনও অনেক অসুস্থ। দু দিন পরে জ্ঞান ফিরেছে তোমার। আচ্ছা, এভাবে চলন্ত গাড়ির সামনে ঝাঁপ দেয়ার মানে কী? ভাগ্যিস, গাড়িটা আমার ছিল আর সময়মত ব্রেকও কষতে পেরেছিলাম’। আয়ানের কথাগুলো শুনে যায় অর্পা, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারে না। অনেকক্ষণ পরে শুধু গোঙানির মত শব্দ করে বলে,আয়ান, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না, এক মুহূর্তও না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার প্রিয় কৃষ্ণচূড়ার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। এই হৃদয়ে কান পেতে দেখো, প্রথম দেখার স্পন্দনের মত স্পন্দন শুনতে পাবে।
0 মন্তব্যসমূহ