আহমদ ছফাঃ সাহস আর সৃজনশীলতার প্রতীক







"একটি কাক আরেকটি কাকের মুখের খাবার কেড়ে নেয়ার জন্য যতরকম ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে থাকে, একজন কবি আরেকজন কবির প্রাপ্য সম্মানটুকু কেড়ে নেয়ার জন্য তার চাইতে কিছু কম করে না।"

সাহিত্য, কবিতার মানুষ হয়েও কবিদের সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে গাটস লাগে। সেই গাটস সাহিত্যজগতের অনেক কিংবদন্তিরও থাকে না। কিন্তু ছিল আহমদ ছফার। আর ছিল বলেই মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি আজও বাংলা সাহিত্যের এক মহান সারথী হয়ে বেঁচে আছেন।

বাংলা সাহিত্যে যুগে যুগে লেখক এসেছেন অনেক। কিন্তু প্রথাবিরোধী, প্রতিষ্ঠানবিরোধী, মুখের ওপর সত্য বলে দেয়ার মত লেখকের সংখ্যা খুবই নগন্য। যে ক'জন আছেন, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হিসেবে যাদের ধরা হয়, আহমদ ছফা থাকবেন একেবারে শুরুর দিকে। তার কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ আর বহুমাত্রিক চিন্তাধারার লেখাগুলো শুধু বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধই করেনি, মানুষ হিসেবে বাঙালির বোধ আর মননকেও করেছে সমৃদ্ধ।

স্পষ্টবাদী, প্রতিবাদী ও মানবিক বোধে উদ্ধুদ্ধ ছফা ছিলেন বহু অগ্রজ ও অনুজ লেখকের অনুপ্রেরণার অপার উৎস। তার লেখা থেকে, তার জীবনবোধ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আসছেন অসংখ্য খ্যাতিমান লেখক ও ব্যক্তিত্ব। তার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান, সরদার ফজলুল করিম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রশীদ করীম, তারেক মাসুদসহ আরও অনেকে আছেন। তার লেখা পাঠে মুগ্ধ ছিলেন আরেক প্রথাবিরোধী লেখক আহমদ শরীফও। তিনি ছফা সম্পর্কে লিখেন- ‘সুবিধাবাদীর 'Life is a compromise' তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরো কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।’ আরেক তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার বলেন- 'সে (ছফা) গাছবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারণ একটি গ্রামের ছেলে। কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে সে যে উথালপাথাল ধাক্কা দিয়ে গেল তার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলি, সংস্কৃতি বলি, রাজনীতি বলি, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বলি তার সঙ্গে খোদ একটা বোঝাপড়া না করে কোনো ক্ষেত্রেই অগ্রসর হওয়া যাবে না।' জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তো তাকে 'মেন্টর' বলে মনে করতেন, শিক্ষাবিদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে ''চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক। আমাদের বড় সৌভাগ্য তার মতো একজন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল।''

আহমদ ছফা চিন্তায়, মননে, বুদ্ধিবৃত্তিতে ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য ও বুদ্ধিজীবীদের বিকৃত ও বিক্রিত রূপ দেখে তিনি স্বাধীনতার পর ১৯৭২সালে লিখেছিলেন 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' নামের প্রবন্ধের বই। সেখানে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সুবিধাবাদী চরিত্রের তুমুল সমালোচনা করেছিলেন। ফলে ছফার লেখা একসময় অনেক মুখোশধারীদের কাছে 'অস্বস্থি' ও আতঙ্কের অপর নাম হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই একদা তটস্থ হয়ে থাকত যে ছফা কখন কার হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেন!

আপদমস্তক প্রগতিশীল আহমদ ছফা ছিলেন সমাজের কুসংস্কার, অনাচার, অন্যায় আর অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক সাহসী কলমযোদ্ধা। জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি সমাজের কোন কোন জায়গায় সীমাবদ্ধতা, বাঙালি মুসলমানের মানস কোথায় পিছিয়ে আছে সেগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ধর্মের নামে অধর্ম ও প্রগতিশীলতার নামে ভণ্ডামি আর নীতিহীনতার নাগপাশ ছিঁড়ে ফেলতে তার জুড়ি ছিল না। তিনি বলেছিলেন- “যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।”

বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় আচরণের নামে দ্বিচারিতা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। 'বাঙালি মুসলমানের মন' গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- "বাঙালি মুসলমানসমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসাভাবে, অনেককিছুই জানার ভান করে, আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সংকুচিত।" আবার অন্য জায়গায় লিখেন- "বাঙালি মুসলমানের মন যে এখনও আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুণ তার মনের ওপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে।" বলা যায় বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে এমন গভীর পর্যবেক্ষণ হাতেগোনা দুয়েকজন বাদে ছফার মত আর কেউ করতে পারেননি।

আহমদ ছফা শুধু সাহসী, প্রতিবাদী ও দৃঢ়চেতাই ছিলেন না। ছিলেন মানবিকও। তার প্রমাণ আমরা নানা ক্ষেত্রেই পাই। শহিদ পরিবার হিসেবে পাওয়া বাড়ি থেকে হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালদের যখন উচ্ছেদ করা হয়েছিল, তিনিই প্রতিবাদ করে তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে প্রতিবাদ করতে উদ্ধত হয়েছিলেন তিনি! আবার কবি ফররুখের রাষ্ট্রীয় ভাতা বন্ধ হওয়ার পর অসুস্থ কবির জন্য তিনিই আবার চালু করিয়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষাজীবনে মুহম্মদ জাফর ইকবালের অর্থকষ্টে তাকে চাকরি পাইয়ে দেয়া, আবুল হাসানের ঢাবিতে ভর্তির জন্য নিজের বইয়ের রয়্যালিটির টাকা দিয়ে দেয়া, নির্মলেন্দু গুণকে গ্রেফতারের পর থানায় ছুটে গিয়ে ওসির সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ানো, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর চিকিৎসাকালে নিয়মিত দেখতে গিয়ে অর্থসাহায্য করা, শিহাব সরকার, অসীম সাহাসহ আরও অনেক সৃজনশীল মানুষদের অর্থকষ্ট কিংবা বিপদে সাহায্য করা তার মহান মানবতাবোধের পরিচয় দেয়। কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের সাথে তার দারুণ সম্পর্ক ছিল। সুলতানকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে নানাভাবে সহযোগিতাও করেন তিনি।

গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ-কাহিনি সব ক্ষেত্রেই নিজের সৃষ্টিশীলতা আর দারুণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। তার প্রায় প্রতিটি লেখাতেই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমসাময়িক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরার পাশাপাশি গণমানুষের কষ্ট, দুঃখ-দুর্দশা ও আকাঙ্ক্ষার ছবিও প্রতফলিত হত। ফলে পাঠকের মনে জায়গা করে নিতেন সহজেই। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। এরমকধ্যে প্রবন্ধগ্রন্থগুলো ছিল খুব পাঠকপ্রিয়। ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ (১৯৭১), ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৭২), ‘বাংলা ভাষা: রাজনীতির আলোকে’ (১৯৭৫), ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ (১৯৭৭), ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৮১), ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (১৯৮৯), ‘রাজনীতির লেখা’ (১৯৯৩), ‘নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ’ (১৯৯৫), ‘সংকটের নানা চেহারা’ (১৯৯৬), ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৯৭), ‘শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ’ (১৯৯৮), ‘বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ (২০০১), ‘আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (২০০২), ‘সেই সব লেখা’ (২০০৮) ইত্যাদি তার উল্লেখ্যযোগ্য প্রবন্ধের বই। তার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সূর্য তুমি সাথী’ (১৯৬৭), ‘উদ্ধার’ (১৯৭৫), ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’ (১৯৮৯), ‘অলাতচক্র’ (১৯৯০), ‘ওঙ্কার’ (১৯৯৩), ‘গাভীবিত্তান্ত’ (১৯৯৪), ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ (১৯৯৬), ‘পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’ (১৯৯৬) ও ‘নিহত নক্ষত্র’ (১৯৬৯)। কবিতায়ও দারুণ দক্ষতা ছিল তার। ‘জল্লাদ সময়’ ও ‘দুঃখের দিনের দোহা’ (১৯৭৫), ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’ (১৯৭৭), ‘লেনিন ঘুমোবে এবার’ (১৯৯৯), ‘আহিতাগ্নি’ (২০০১) তার কাব্যগ্রন্থ। আহমদ ছফার অন্যতম জনপ্রিয় একটি বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’, যেটি তিনি জাতীয় অধ্যাপক ও তার গুরু আব্দুর রাজ্জাক সমীপে লিখেছিলেন। এর বাইরেও তিনি ভ্রমণ-কাহিনি, কিশোর গল্প ও শিশুতোষ ছড়ার বইও লিখে গেছেন।

আহমদ ছফা ছিলেন রাজনীতি-সচেতন। নিজেও একসময় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে হাসিনা-খালেদা সবারই সমালোচনা করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। পদ-পদবী, চাকরি ও টাকার প্রতি কোনো মোহ ছিল না। ফলে কারও পদলেহন করে তাকে বাঁচতে হয়নি তাকে। এমনকি বেঁচে থাকতে তিনি অনেক পুরস্কার পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করে গেছেন। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই তাকে নানা দায়িত্ব দিতে চেয়েছেন, কিন্তু সেগুলো তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন খুব সহজেই, বিনয়ের সাথে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি অনেক লেখাই লিখেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি মূল্যায়ন। তিনি বলেছিলেন-  "আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোনো পিতা তার শিশুপুত্রকে বলবেন, জানো খোকা! আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিল যার দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন, দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্নারাতে রূপালি কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি এবং নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তার ভালোবাসা। জানো খোকা তার নাম? শেখ মুজিবুর রহমান।" তিনি বলতেন- "বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য বলাকা নয়, সোনার তরী নয়। বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’।" বঙ্গবন্ধু তাকে একটা কম্বল দিয়েছিলেন। সেই কম্বল তিনি বহুদিন দরদ দিয়ে ব্যবহার করেছেন। তার ভ্রাতুষ্পুত্র নূরুল আনোয়ার পরম আদরে সেই কম্বল সংরক্ষণ করেছেন।

একবার খালেদা জিয়া আহমদ ছফাকে ফোন করে দাওয়াত করেছিলেন। তিনি বেগম জিয়াকে বলেছিলেন, 'যেতে পারি এক শর্তে, আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে হবে। শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে রান্না করে খাইয়েছিলেন।' খালেদা জিয়ার রান্না করার সময়ও হয়নি, ছফাও যেতে পারেননি।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছফার আরেকবার ফোনালাপ হয়েছিল। উপলক্ষ্য ছিল এনজিও ব্যুরো থেকে ‘বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি’র রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে। ছফাই বেগম জিয়াকে ফোন করেছিলেন। ফোনটি ধরেছিলেন তার পিএস। ছফা বিনয়ের সঙ্গে পিএসকে বলেছিলেন, ম্যাডামকে কি একটু দেয়া যাবে? আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

পিএস সাহেব জানতে চাইলেন, আপনি কে?

ছফার জবাব, আমি আহমদ ছফা।

পিএস সাহেব ফের জানতে চাইলেন, কোন আহমদ ছফা?

পিএসের কথায় ছফা প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিলেন। তিনি রাগলে সচরাচর যে গালিটি তার মুখ দিয়ে বের হতো সেটি বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললেন, বাংলাদেশে আহমদ ছফা দু’জন আছে নাকি?

ছফা কথা না বাড়িয়ে রিসিভারটি ধপাস করে রেখে দিয়েছিলেন।

পিএস সাহেব ছফার এ অশোভন আচরণের কথা বেগম জিয়াকে জানিয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি। কিছুক্ষণ পরে বেগম জিয়া ফোন করেছিলেন। ছফার কথার ঝাল তখনও থেকে গিয়েছিল। ফোন পেয়ে তিনি বেগম জিয়াকে বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন- ম্যাডাম, কী সব অশিক্ষিত পিএস টিএস রাখেন, আহমদ ছফার নাম জানে না!

ছফার কথায় বেগম জিয়া হেসে জবাব দিয়েছিলেন, 'আমি নিজে অশিক্ষিত; শিক্ষিত মানুষ পাব কোথায়। আপনারা কেউ তো এগিয়ে আসছেন না।'

এমন দৃঢ়চেতাই ছিলেন আহমদ ছফা, যিনি বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদূত হওয়ার প্রস্তাব অকপটে ফিরিয়ে দেন, বেগম জিয়াকে ধমকের সুরে কথা বলেন।

আহমদ ছফা মুক্তভাবে চিন্তা করতেন, কিন্তু ছিল না কোনো বাড়াবাড়ি। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন- “আমার কাছে ঈশ্বর-চিন্তা আর মানুষের অমরতার চিন্তা সমার্থক। কেউ যদি আমাকে আস্তিক বলেন বিনা বাক্যে মেনে নেব। আমি আস্তিক। যদি কেউ বলেন নাস্তিক, আপত্তি করব না। আস্তিক হোন, নাস্তিক হোন, ধর্মে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি কোন বিবাদের হেতু দেখতে পাইনে। আমার অভীষ্ট বিষয় মানুষ, শুধু মানুষ। মানুষই সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মূল্যচিন্তা, সমস্ত বিজ্ঞানবুদ্ধির উৎস।”

এই ছিলেন আমাদের কিংবদন্তি আহমদ ছফা। খারাপ লাগে আজকের প্রজন্ম ওনার বই পড়া তো দূরের কথা, ওনার নামটাও জানে না। তারা ওপারের সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দুদের চেনে, কিন্তু আমাদের ছফা, শহিদুল জহির, ইলিয়াস, মাহমুদুল হকদের চেনে না। অবশ্য এখনকার জেনারেশন বরাবরই বইবিমুখ, তাদের পাঠ্যতালিকায় এখন শুধুই ফেসবুক। আজকাল শহরে পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের দোকানই দেখা যায় না। মোড়ে মোড়ে ফাস্টফুড আর আড্ডার জায়গা, বইপড়ার নয়। পাবলিক লাইব্রেরিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পাঠকের অভাবে!

১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের সাধারণ মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আহমদ ছফা ২০০১ সালের ২৮শে জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে যাওয়ার পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে মিরপুরের শহিদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তার দাফন হয়। কিন্তু সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় তাকে কবর দেয়া হয়নি, যা পুরো জাতির জন্যই লজ্জার ব্যাপার ছিল।

মৃত্যুর পর ২০০২ সালে ছফাকে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়। আজীবন পদ আর পদকবিরোধী মানুষটি মৃত্যুর পরই পান জীবনের সবচেয়ে বড় পদকটি। বাঙালির চিন্তা আর মনন গঠনের অন্যতম কারিগর, সকল অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর বিদ্রোহের প্রতীক ছফার একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি- "কাউকে জ্ঞান বিতরণের আগে জেনে নিও যে তার মধ্যে সেই জ্ঞানের পিপাসা আছে কিনা। অন্যথায় এ ধরণের জ্ঞান বিতরণ করা হবে এক ধরণের জবরদস্তি। জন্তুর সাথে জবরদস্তি করা যায়, মানুষের সাথে নয়। হিউম্যান উইল রিভল্ট।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ