হাসপাতলের বেডে শুয়ে আদিব চিন্তা করছে, আজই তার প্রিয় বাঁ পা’টা কেটে ফেলা হবে! আর মাত্র দু’ঘন্টা পরেই অপারেশন। সে ভাবছে এই পা’টা দিয়েই তো ফুটবল মাঠে কত-শত গোল করেছে, রচনা করেছে অনেক ফুটবল কাব্য! অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এই পা’টাই আজ জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে শুধু তার জীবনটা বাঁচাতে। আদিব অবশ্য চায়নি তার প্রিয় পা’টা ছাড়া বেঁচে থাকতে। সে সবাইকে বলেছিল ‘জীবন যায় যাক, তবু আমার পা হারাতে রাজি নই। পঙ্গু জীবনে মানুষের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো’ ইত্যাদি আরও অনেক কিছুই।
কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত করার মানুষ কই? আর করবেই বা কীভাবে? কোন মা-বাবা চাইবেন যে তাদের পুত্র বিনা চিকিৎসায় এভাবে মারা যাক? কেটে ফেলা হোক পা, ছেলে পঙ্গু হলেও বেঁচে তো থাকবে! যদি কৃত্রিম পা নিয়ে কোন কাজ করতে নাও পারে, তবু দুঃখ নেই। জীবনের চাইতে পায়ের মূল্য ঢের কম। অন্তত বেঁচে থাকার প্রশ্নে তো অবশ্যই। ভীষণ অদ্ভুত বস্তু এই বেঁচে থাকা। জীবন প্রায়ই বেঁচে থাকার বড় চড়া মূল্য দাবি করে বসে আমাদের কাছে!
আদিব হঠাৎই তলিয়ে যেতে থাকে স্মৃতির গভীরে। অবিস্মৃত অতীত তাকে গ্রাস করে ফেলে। অথচ সে জোর করে মন থেকে কষ্টের স্মৃতিগুলোকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু যতই স্মৃতিগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে চায়, ততই বুঝি তারা মগজের গভীরে এসে নারকীয় উল্লাস শুরু করে। অপারেশনের আগে একা থাকাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। হয়তো সে কারণেই স্মৃতিগুলোর এত উল্লাস। অবশ্য একা থাকছে আদিব নিজের ইচ্ছেতেই। চায়নি কারো মুখোমুখি হতে, চায়নি কারো সাথে কথা বলতে। ডাক্তার-নার্স ছাড়া তার কেবিনে যেন আর কেউ প্রবেশ করতে না পারে সেটাই ছিল চাওয়া। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কেউ পাশে থাকলে তার সাথে কথা বলে স্মৃতিগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা যেত। কষ্ট তাতে কম না হোক, ক্ষণিকের জন্য ভুলে তো থাকা যেত।
আবার ভাবনায় ডুবে যায় আদিব। আহারে! ফুটবল মাঠের সেই সোনালি দিনগুলো আর ফিরে পাবে না-এই কষ্টটাই বেশি পোড়াচ্ছে তাকে।
আদিব... একুশ বছরের টগবগে, প্রাণোচ্ছল এক তরুণ। বাবা তৃতীয় শ্রেণির একজন সরকারি চাকরিজীবী। সংসারে এখন মা-বাবা আর ছোট এক বোন আদিবের। বড় বোন দুটির আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই আদিব স্বপ্ন দেখত ফুটবলার হবে। যেন তেন ফুটবলার নয়। নামি একজন, হাজার মানুষে চেনে- ঠিক এমন একজন। স্বপ্ন লক্ষ্যে হয়তো এগিয়েও চলেছিল দারুণভাবে। ১৪ বছর বয়সেই সে স্থানীয় বয়সভিত্তিক ক্লাব ফুটবলে দারুণ পারফরম্যান্স দেখায়। দু’বছর পরেই কুমিল্লা জেলা দলে চান্স পেয়ে যায়। কিন্তু সিনিয়রদের ভীড়ে একাদশে চান্স পেত না তেমন। দুই বছর জেলা দলের সাথে থেকে কঠোর অনুশীলন করে অনেক পরিণত হয় সে। এরপর থেকে নিয়মিত জেলা দলে খেলতে থাকে। তার এক বছর পর যখন অন্তঃজেলা ফুটবল লিগ হয়, তখন আদিবের অসাধারণ নৈপুণ্যে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় কুমিল্লা জেলা দল।
আর আদিব? সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয় সে। সেই ফাইনাল ম্যাচটার পরই ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরতে শুরু করে। সুযোগ পেয়ে যায় ঢাকার প্রথম বিভাগের দল ধানমন্ডি এফসিতে। সেখানে দুইবছর কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যায় অনেকদূর। দুই বছরের মাথায় তাদের দল ধানমন্ডি এফসি প্রথম বিভাগ থেকে বাংলাদেশ লিগে উন্নীত হয়। আর এসবই হয় দলের সাথে তার নৈপুণ্যের মিশেলে। নিজেকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখে সে। স্বপ্ন দেখে সে হবে বাংলাদেশের মেসি। ইউরোপে না হোক, অন্তত এশিয়ার বড় বড় ফুটবল লিগে খেলার ইচ্ছেটা তার মাঝে প্রবল হয়ে ওঠে। ধানমন্ডি এফসির হয়ে পারফরম্যান্সের কারণে দেশের অনেক বড় বড় দল থেকেও ডাক আসে তার। কিন্তু সে পুরনো ক্লাবকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে। তার আকাঙ্ক্ষা, ওই ক্লাবে খেলেই জাতীয় দলে সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশ লিগে দলের দুই ম্যাচে দুই গোল করে আদিব। এতে তার স্বপ্নগুলো ডালপালা মেলে। আত্নবিশ্বাসের পালে নতুন হাওয়া লাগে। তৃতীয় ম্যাচে খেলা যখন সত্তুর মিনিটে ছিল, তখন ওর দল এক গোলে এগিয়ে। গোলটা আদিব না করলেও ওর বানানো পাস থেকেই গোলটা হয়। এই সময় একটা বল নিয়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভেদ করে ফাঁকা পোস্টে ঢুকে পড়ে আদিব। ও চাইলে বলটা দূর থেকেই কিক নিয়ে গোল করতে পারত। কিন্তু গোলরক্ষকের সাথে বল নিয়ে একটু কারিকুরি করতে যেয়েই বিপত্তিটা ঘটাল। কারণ ওই গোলরক্ষক যখন দেখল আদিবকে কোনরকমেই আটকানো সম্ভব না, তখন আদিবের বাঁ হাঁটুতে সরাসরি এসে সে বুটের স্পাইক দিয়ে কিক মারে। ও ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে মাঠেই পড়ে যায়। গোলরক্ষক লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যায়। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে পেনাল্টি থেকে গোল করে আদিব। পুরো নব্বই মিনিটই সেদিন খেলে সে। দলও জিতে যায় তিন গোলের ব্যবধানে।
কিন্তু সেই ম্যাচের পর থেকেই বাঁ হাঁটুতে ব্যথা শুরু হয় অদ্ভুত রকমের। প্রতিদিন ব্যথানাশক খেয়ে অনুশীলনে যায়। ম্যাচও খেলে। টিম ম্যানেজমেন্টকে ব্যথাটার কথা জানতে দেয় না আদিব। ভাবে ওটা এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। আর ও চায়নি ওর উত্থানের এই সময়টাতে সামান্য ইনজুরির জন্য মাঠের বাইরে চলে যাক। কারণ ও পেশাদার ফুটবল খেলতে শুরু করার পর থেকেই তার পরিবারের অবস্থা স্বচ্ছল হতে শুরু করেছিল। সবাই ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। মিডিয়াতেও ওকে নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওখানেই সে বড় ভুলটা করে ফেলে!
প্রথমদিকে ব্যথানাশক খেয়ে ব্যথাটা দমন করে রাখলেও মাসতিনেক পর আর ব্যথানাশক দিয়েও কাজ হলো না। প্রচন্ড ব্যথায় মাঠে থাকতে খুব কষ্ট হতো। তাই বাধ্য হয়েই টিম ম্যানেজমেন্টকে জানাল ব্যাপারটা। তারা শুনে বলল, ভালো একজন চিকিৎসককে দেখাতে। তাদের কথামত দেখায়ও একজন হাড় বিশেষজ্ঞকে। তিনি কয়েকটা টেস্ট করতে বলেন। টেস্ট করানোর পর রিপোর্ট দেখে ডাক্তার ওকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। কারণ উনি ওর হাঁটুর সমস্যাটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চান। এজন্য ছোট্র একটা অপারেশনের মাধ্যমে হাঁটু থেকে এক টুকরো হাড় নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। বাধ্য হয়েই মা-বাবাকে জানায় সে। উনারা দেরি না করে চলে আসেন ঢাকায়। একটা ছোট্র বাসা ভাড়া করে থাকেন সেখানে আর আদিবকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। এ ক’দিনে তার হাঁটুতে ব্যথা আরো বাড়তে থাকে। ঠিকমত হাঁটতেও পারে না। কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটে। যথাসময়ে অপারেশন হয়। রিপোর্ট দেখে যা বোঝার বুঝে যান ডাক্তার। রিপোর্টে হাঁটুর হাড়ে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ক্যান্সার বিষেষজ্ঞ ডাক্তাররা পরামর্শ দেন বাঁ পা’টা কেটে ফেলতে হবে উরু পর্যন্ত। নইলে ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।
যা হবার তাই হয়। কান্নার রোল ওঠে জীবনে। সবাই কাঁদতে থাকে। টিম ম্যানেজমেন্টের অনেকেই তাকে দেখতে আসেন। সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আদিব কারো সাথে কথাই বলে না ঠিকমত। শুধু কান্না আসে তার! সে ভাবতে থাকে যে এটা কী স্বপ্ন নাকী সত্যি? কেন তার জীবনটা এভাবে বদলে গেল! যে জীবনটা মাত্রই শুরু হয়েছিল, তা এভাবে শেষ হয়ে গেল? যে স্বপ্নবৃক্ষটা মাত্রই শাখা-প্রশাখা ছড়াতে শুরু করেছিল তা হঠাৎ এভাবে কেন মৃতবৃক্ষে পরিণত হলো? মাথায় অনেক প্রশ্ন জমা হতে থাকে আদিবের। কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ জানে না। কেউ না!
প্রকাশকালঃ এপ্রিল-২০১৩
0 মন্তব্যসমূহ