দুঃস্বপ্ন


সিটি বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে শাহিন বারবার মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ইশ, আজও নির্ঘাত অফিস লেট এবং আজও যথারীতি বসের ঝাড়ি খেতে হবে। এই মেস জীবন আমার লাইফটাই হেল করে দিলো! শালার বাসও আসছে না এতক্ষণ ধরে! এসব ভাবতে ভাবতেই চলে এল সিটি বাস। বাসে উঠে জানালার পাশের একটা সিটে বসল সে। সব যাত্রী ওঠার পরই ছাড়ল বাসটি।

শাহিন মতিঝিলে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জুনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করছে। নতুন চাকরি। এগারো মাস হয়েছে মাত্র। জুনিয়র হওয়ায় তার ওপর কাজের চাপ অনেক বেশি। নিজের কাজ তো করতেই হয়ই, সাথে সিনিয়র অফিসারদের অনেক ফাইলও দেখে দিতে হয় তাকে। ফলে অফিস টাইম পরেও তাকে আরো অনেকক্ষণ অফিসে থেকে কাজ শেষ করে আসতে হয়।

শাহিন একটা মেসে থাকে। কারণ ঢাকায় তার আত্মীয়-স্বজন কেউ থাকে না। তার মা-বাবা ও দুটি ছোট ভাই-বোন গ্রামে থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। মেস জীবনটা ওর কাছে একদম ভালো লাগে না। কিন্তু তবুও বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। কারণ ঢাকা শহরে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া সোনার হরিণের চেয়ে বড় কিছু। তাছাড়া সে পরিবারের সবাইকে যে ঢাকা নিয়ে আসবে সে সামর্থ্যও তার এখনো হয়নি। সে যে মেসে থাকে সেখানে মেসে আরও অনেক ব্যাচেলর থাকে। পুরো মেসে একটা মাত্র বাথরুম হওয়ায় প্রতিদিন লাইন ধরে বাথরুমে যেতে হয়। এজন্য প্রায়ই ওর অফিসে আসতে লেট হয়ে যায়।

আজও আধঘন্টা লেট করে শাহিন অফিসে গেল। কিন্তু আজ আর বসের ঝাড়ি খেতে হলো না। কারণ গিয়ে দেখল এখনো বসই আসেননি অফিসে! যদিও বসের আসতে কখনোই লেট হয় না, কিন্তু আজ বসের কেন লেট হচ্ছে কেউ জানে না। কারণ যাই হোক, বস না আসায় সে স্বস্থিই পেল মনে। এসে এক কাপ চা খেয়েই কাজ শুরু করে দিলো। মাঝখানে লাঞ্চ বাদে সারাদিন একনাগাড়ে কাজ করল সে। অফিস ছুটির পরও বস আরও একগাদা ফাইল পাঠালেন ওর কাছে। বললেন ওগুলো শেষ করে যাওয়ার জন্য। কারণ কাল-পরশু দুই দিন হরতাল। তারপর শুক্র-শনি এমনিতেই অফিস বন্ধ। তাই চারদিনের ছুটি। ছুটির কথা ভেবে সে কাজ শেষ করেও সাড়ে সাতটায় প্রশান্তির সাথে অফিস থেকে বের হলো।

একটা হোটেলে গিয়ে হালকা নাস্তা করল শাহিন। তারপর বাসে উঠল এবং যথারীতি জানালার পাশের একটা সিটে বসল। দুই দিন হরতালের জন্য সে মনে মনে বিরোধী দলকে একটা ধন্যবাদ দিল। কারণ ঈদ ছাড়া এরকম ছুটির উপলক্ষ খুব কম পাওয়া যায়। সে মনে মনে পরিকল্পনা করে ফেলল আজ রাতেই গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। কাজের চাপে অনেকদিন যাওয়া হয় না গ্রামে। মা-বাবাকে দেখার জন্য তার মন ছটফট করছিল। সুযোগ পেয়ে আর মিস করতে চাইল না। ভাবল মেসে গিয়ে ব্যাগ গোছগাছ করেই সোজা বাড়ির বাস ধরবে।

শাহিনের বাড়িতে যাওয়ার আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে। সেটা হলো সেদিন মা বলছিলেন তার জন্য একটা মেয়েকে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। এখন তার পছন্দ হলেই তারা চূড়ান্ত কথাবার্তা বলবেন। মা অবশ্য অনেকদিন ধরেই বিয়ের চাপ দিচ্ছেন তাকে। কিন্তু সে এতদিন রাজি হয়নি। বলেছিল, নতুন চাকরি, আগে কিছুটা গুছিয়ে নিই, তারপরই বিয়ে। এবার বোধহয় সে আর মা বাবাকে নিষেধ করতে পারবে না। আর সেও ভেবেছে বিয়েটা করা দরকার তার। কারণ ঢাকা শহরে ছোট্র একটা বাসা নিয়ে বউকে নিয়ে থাকলে অন্তত মেসের চেয়ে আরামে থাকা যাবে।

বিয়ের কথা মনে হওয়ায় অদ্ভুত এক ভালো লাগায় তার মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। হঠাৎ ঘুৎ ঘুৎ শব্দ তুলে পুরোনো বাসের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। শাহিন ভাবনায় এতই মগ্ন ছিল যে বুঝতে পারল না বাসটা যে থেমে গেছে! বুঝতে পারল যাত্রীদের হইচই শুনে। সে দেখল সব যাত্রী দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাস থেকে নেমে পালাচ্ছে। ড্রাইভার, কন্ডাক্টার আর হেলপার আগেই হাওয়া! বুঝতে পারল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। সামনে তাকাতেই দেখল অনেকগুলো মাস্তান টাইপের লোক হাতে লাটি-সোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবল ওরা পিকেটার। কিন্তু হরতাল তো কাল। আজ এখানে ওরা কী করছে! শাহীন বাস থেকে নামতে গিয়ে দেখল বাসের সব যাত্রীই তার আগে নেমে গেছে। এতে তার মেজাজটা গেল বিগড়ে। যত্তসব ভীতুর দল বলে সেও নেমে এল বাস থেকে। এসেই পড়ল পিকেটারদের সামনে।
ভাই, এখানে কী হচ্ছে বলতে পারেন? পিকেটারদের উদ্দেশ্য করে জানতে চাইল শাহিন।
দেখেন না মিয়া কী হচ্ছে? এই বাসটা এখন জ্বালানো হবে, বলল এক পিকেটার।
কেন ভাই, আজ তো হরতাল না?
আরে মোর জ্বালা! ওই মিয়া হরতালের আগে যে মহড়া হয় সেটা জানেন না? এখন হলো মহড়ার টাইম।
শুনেই ওর মেজাজ আবারো বিগড়ে গেল। বেশ ঝাঁঝের সাথেই বলল, আপনারা মগের মুল্লুক পেয়েছেন নাকি যে অন্যায়ভাবে মানুষের ক্ষতি করবেন?
ওই ব্যাটা তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে আমাদের কাজের?
অবশ্যই দিতে হবে। তোরা যা ইচ্ছে তাই করবি আর আমরা মুখ বুঝে সব সহ্য করব? দাঁড়াও এখনই আমি পুলিশের কাছে ফোন করছি- বলেই মোবাইল বের করল শাহিন। কিন্তু নাম্বার ডায়াল করার আগেই একজন ছোঁ মেরে তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে গেল। তারপর ওদের লিডার যে, সে বলল এই তোরা শালাকে বেঁধে বাসে তোল। বাসের সাথে ওকেও জ্বালিয়ে দেব। আজ মাথায় খুনের নেশা চেপে গেছে।
লিডারের নির্দেশের পরই তিন-চারজন মিলে শাহীনের হাতে পায়ে বেঁধে মুখে কাপড় গুজে দিলো। এরপর ওকে বাসে ফেলে রেখে বাসের গেট লক করে বাসে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো। আগুনের উত্তাপ এসে যখন ওর গায়ে লাগল, তখন সে 'ও মাগো' বলে জোরে চিৎকার করে ওঠল। চিৎকার শুনে শাহিনের মেসের রুমমেট রুবেল জেগে ওঠে শাহিনের পাশে বসল- কী হয়েছে শাহিন ভাই? আপনি চিৎকার করলেন কেন? আর এত কাঁদছেনই বা কেন? দেখেন চোখের পানিতে আপনার বালিশটা ভিজে গেছে!
না রুবেল, আমার কিছু হয়নি। বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখেছি-মিন মিন করে জবাব দিলো সে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ