আজম খানঃ বীর যোদ্ধা থেকে পপগানের সম্রাট


"আম্মাকে বললাম, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আম্মা বললেন, যুদ্ধে যাবি ভালো কথা, তোর আব্বাকে বলে যা। আব্বা ছিলেন সরকারি চাকুরে। ভয়ে ভয়ে তাকে বললাম, যুদ্ধে যাচ্ছি। উনি বললেন, যাবি যা, তবে দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না! তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। তাকে একটা সালাম দিয়ে যুদ্ধে যাই। তখন আমার বয়স ২১ বছর।"

আজম খান, পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। ১৯৫০ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি আজিমপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান, মা জোবেদা খাতুন।

১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হোন তার দুই বন্ধু। এ সময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর-২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা।

আজম খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাত। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ-সমরে অংশ নেয়া শুরু করেন। কুমিল্লার সারদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এরপর তিনি ফিরে যান আগরতলায়। পরে তাকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ, সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত 'অপারেশান তিতাস'। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হোটেল পূর্বাণী ইত্যাদির গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য ছিল, হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে, দেশে যুদ্ধ চলছে। এই অপারেশনে তিনি বাম কানে আঘাত পান। পরবর্তীতে এই আঘাত তার শ্রবণক্ষমতায় বেশ বিঘ্ন ঘটায়। আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংঘটিত যুদ্ধে অসীম বীরত্ব দেখিয়ে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশ অভাবগ্রস্থ ছিলো। অনেকেই বিপথে চলে যান তখন। তরুণরা জড়িয়ে পড়ে মাদকসহ নানা অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজে। কিন্তু আজম খান হাতে তুলে নেন গিটার। শুরু করেন পপ-সংগীত। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে হয়ে ওঠেন বাংলার মুকুটহীন পপসম্রাট। বাংলা সংগীতে মেলোডির চাহিদা ছিলো তখন সবচেয়ে বেশি। পপ, রক, ব্যান্ডের গানেও যে বাংলা গান জনপ্রিয় হতে পারে এটা প্রমাণ করে দেন তিনি। আজকে বাংলা ব্যান্ড সংগীত যে এত জনপ্রিয়, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আজম খানের। তাকেই তাই সবাই গুরু হিসেবে মেনে নেন।

১৯৬৮ সালেই আজম খান 'ক্রান্তি' শিল্পীগোষ্ঠীর সাথে জড়িত হন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তারা রাখেন দারুণ ভূমিকা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয় যুদ্ধের পাশাপাশি গান গেয়ে অনুপ্রেরণা যোগান গেরিলাদের। শহিদ-জননী জাহানার ইমাম তার 'একাত্তরের দিনগুলি' গ্রন্থে আজম খানকে নিয়ে লিখেছেন- "২০শে আগস্ট, ১৯৭১। একটি তাঁবুতে আলো জ্বলছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর- 'হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ'। বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার ভীষণ সাহসী গেরিলা যোদ্ধা।"

মুক্তিযুদ্ধের পর আজম খানের ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ দেশব্যাপী সংগীত জগতে আলোচিত হতে থাকে। ১৯৭২ সালে বন্ধুদের নিয়ে শুরু করেন পেশাদারভাবে অনুষ্ঠানে গান গাওয়া। ঐ বছরই তার ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি বিটিভিতে প্রচার হলে চারদিক থেকে প্রশংসা শুরু হয়।

পরবর্তীতে বিটিভিতে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’ গান গেয়ে রীতিমত হইচই ফেলে দেন আজম খান। ‘আমি যারে চাইরে’, ‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘অ্যাকসিডেন্ট’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘পাপড়ি’, ‘বাধা দিও না’, ‘যে মেয়ে চোখে দেখে না’ ইত্যাদি গানগুলো গেয়ে ওঠে যান জনপ্রিয়তার শিখরে।

ওনার গানে কতটা প্রভাব রেখেছিল বাংলা পপগানের উত্থানের পেছনে, তা জানা যায় ব্যান্ড সংগীত ও গিটারের আরেক কিংবদন্তি আইয়ূব বাচ্চু কথা থেকে। তিনি বলেন- "আমার তো বটেই, আমার সমসাময়িক এবং আমার আগের একটি প্রজন্ম এবং আমার পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই এখনো আজম ভাই দ্বারা অনুপ্রাণিত। এখনো যাদের নিজের গান হয়নি, মঞ্চে তাদের এখনো আজম ভাইয়ের গান গাইতে হয়। আর আমরাও আজম ভাইয়ের গান দিয়েই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম।” আজম খানের সাদামাটা জীবনধারা নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু বলছিলেন, “লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে দেখেছি ওনাকে। আমাদের প্রতি তিনি সব সময় স্নেহপরায়ণ ছিলেন। তখন যদি আজম ভাই সালেকা-মালেকা না গাইতেন, তবে এখনো হয়তো আমাদের ইংরেজি গানই গাইতে হতো। বাংলা গান আর গাওয়া হতো না।”

দূরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধির সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ই জুন অনন্তলোকের মহাযাত্রায় পাড়ি জমান এই মহান মুক্তিযোদ্ধা আজম খান। বিনম্র শ্রদ্ধা এই কিংবদন্তির প্রতি!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ