আশ্রয়



যাত্রী নিয়ে যথারীতি ছুটে চলেছে পঞ্চাশোর্ধ্ব জামাল উদ্দিনের রিকশাহঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে চমকে উঠল সেসাথে সাথে রিকশা থামিয়ে দিলোরাস্তার বাঁ-পাশে নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবনের দিকে অনেকক্ষণ থাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটি ভিজে ওঠল তারসম্বিত ফিরে এলো যাত্রীর ধমকে-
-ওই মিয়া, রিকশা থামিয়ে কী দেখেন? যান তাড়াতাড়িআমার সময় নেই
-যাইতাছি স্যার, বলে সে আবারও রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করলযাত্রীকে তার গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এলো ঐ জায়গায়রাস্তার পাশে বড় একটি কৃঞ্চচূড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আবারও থাকিয়ে থাকল নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের দিকেতার চোখে দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য মনে হলোতার একমাত্র ছেলে সগিরকে লেবারের কাজ করতে দেখে তার মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে না তো!
কিন্তু এই ভরদুপুরে যা দেখছে তা তো স্বপ্ন হতে পারে না, অবশ্যই বাস্তবতাহলে এটা কীভাবে হলো? সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল নারিকশা নিয়ে সোজা চলে গেল কলোনিতে

গিরের মা, ও সগিরের মা! কই তুমি? সজোরে হাঁক পাড়ে জামাল উদ্দিন।
-কী হইছেগিরের বাপ? এইভাবে চিৎকার কইরা ডাকাডাকি করতেছেন ক্যা? বলেই বেরিয়ে এলো আমেনা বেগমকলোনির ঘরের বারান্দায় মাদুর পাতিয়ে দিয়ে বলল - বসেন
বসল জামাল উদ্দিনতারপর বলল, ইজ কি দেইখ্যা আইলাম জানো সগিরের মা?
-আপনে না কইলে আমি জানুম ক্যামনে?
-ও তাই তো! চ্ছা শোনো, কা দেখলাম আমাগোগির একটা বিল্ডিংয়ে লেবারের কাম করতেছেপ্রথমবার দেইখ্যা তো আমার বিশ্বাস হইতেছিল নাতারপর আবার যখন দেখলাম তখন আর অবিশ্বাস করতে পারলাম নাকিন্তু ক্যান সগিরের মা? হে ক্যান ঢাকা শহরে লেবারের কা করবো? হের তো এখন সুখে থাকার কথাবাড়িঘর, ছয় বিঘা ফসলি জমি আর আমার মুদি দোকান- সবই তো হের নামে দিয়া আইলামতাইলে ক্যান হে ঢাকা শহরে আইস্যা লেবারের কা করব? বলেই কেঁদে দিলো জামাল উদ্দিনকাঁদতে কাঁদতে বলল,ইগুলান হের পাপের প্রায়শ্চিত্ত সগিরের মাহেরে কত শখ কইরা দুই বিঘা জমি বেইচ্যা বিদেশ পাঠাইছিলাকিন্তু অবৈধ কামে ধরা খাইয়াইলা আইল দ্যাশেতারপর হের সুখের লাইগ্যা আমার মুদি দোকানডাও হেরে দিয়া দিলামআমি আমার বাকি ছয় বিঘা জমি চাষ করতেছিলামএরপর হেরে বিয়া দিলাম হের পছন্দ করা মাইয়ার লগেকিন্তু বিনিময়ে হে কী দিলো আমাগো? বউয়ের কথা তোমার লগে খারাপ ব্যবহার করতো। কিন্তু তুমি মুখ বুইজ্যা তা সহ্য করতাহে বউয়ের পরামর্শেই ষড়যন্ত্র কইরা আমার কাছ থিকা টিপ সই লইয়্যা আমার সবকিছু নিজের নামে নিয়া নিলোআর আমাগো অপমান কইরা বাইত্তোন তাড়াইয়া দিলআমরা ঘরবাড়ি হারাইয়া ঘুরতে ঘুরতে এই ঢাকা শহরে আইস্যা একটু মাথাগুজার ঠাঁই পাইলামআর এই বুইড়া বয়সে আমি হইলাম রিকশাওয়ালা!
-সব কষ্টের কথা মনে কইরা ক্যান কানতেছেন সগিরের বাপ? আমি আপনেরে ভাত বাইড়া দিতাছি আপনে খাইয়া ল

খাওয়ার পর আমেনা বেগম বলল- একখান কথা কমু রাগ করবেন না তো সগিরের বাপ?
-কও, আমি রাগ করুম না
-আমি আপনের লগে একটা ব্যাপার লুকাইছিলামভাবতেছিলাম কমু নাকিন্তু আইজকা না কইয়াও পারতেছি নাআপনে অভয় দিলে কইবার পারি
-আরে বাবা, কী কইবে কইয়া ফালাও না?
-আসলে গ্যালো কয়দিন আগে সগির তার বউ আর বাচ্চারে লইয়াহানে আইছিলআইসা দুজনে আমার পা জড়াইয়া মাফ চাইলআমি কিচ্ছু কইনিশুধু কইলাম তোরা চইল্যা যাআর কুনুদিন এইহানে আইবি নাকিন্তু সগির কানতে কানতে কইতেছিল- তার বাড়িঘর, জমি আর দোকানডা নাকি নদী ভাইঙ্গা লইয়া গেছেতাই হে একটু আশ্রয়ের খোঁজে এই ঢাকা শহরে আইসা উঠছেএকটা বস্তিতে নাকি ওরা থাকে এখন!
আমাগো গ্রামের জমির ভাই, যে আমগো এই কলোনিতে থাকে, তালগে দেখা হওয়ায় হে নাকি আমাগো ঠিকানা ওরে দিছেজানেন, আমগো নাতিটা দেখতে খুব সুন্দর হইছেআমি কই কী সগীরের বাপ, ও তো ওর পাপের শাস্তি পাইয়া গেছে, তাই...
-থামো! বলে জোরে একটা ধমক দিয়ে উঠল জামাল উদ্দিনআর একটা কথাও কইবা না তুমিওসব কুনুদিন মুখে আনবা নাযে ছেলে মা বাবারে ভিটেমাডি ছাড়া কইরা দিতে পারে, হে আমার কাছে ক্যান, আল্লাহর কাছেও আশ্রয় পাইব নাহের কথা আর কুনুদিন কইবা না আমার সামনেহে যেদিন আমাগো বাড়ি থিকা বার কইরা দিছে আমি হেইদিনই ধইরা লইছি আমাগো পোলা মইরা গ্যাছে। এহন থিক্যা হেইডা তুমিও ভাববা- বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জামাল উদ্দিনরিকশা নিয়ে ছুটে চলল দ্রুত বেগে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ