দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে!/চোখ ফেটে এল জল/এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? -(কুলি-মজুর)
কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার মূল ভাষ্যকে সত্যি প্রমাণ করার জন্যই বোধহয় সেদিন ঢাকার কড়াইল বস্তিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হলো! মাত্র দুইদিনের নোটিশে তিনলাখ মানুষকে আশ্রয়হীন করে দিল রাষ্ট্রীয় কিছু হায়েনা। মে দিবস এলেই আবার এই হায়েনাগুলো শ্রমিকের অধিকার নিয়ে, খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার নিয়ে সুদীর্ঘ বক্তৃতায় মঞ্চ কাঁপায়! ঐ রাষ্ট্রীয় হায়েনারা কি জানে না বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকাকে এইসব খেটে খাওয়া বস্তিবাসী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সচল রাখে? ওরা কি জানে না দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় খাত গার্মেন্টের শ্রমিকেরা, বস্ত্র-বালিকাদের বেশিরভাগ এই বস্তিতেই জীবনযাপন করে? এই যে শহরের রিক্সাচালক, মুটে, কুলি, রাজমিস্ত্রী, ওয়ার্কসপের মিস্ত্রী, সুইপারসহ আরো অনেক খেটেখাওয়া মানুষ বস্তিতে চরম দরিদ্রাবস্তায় বাস করেও আমাদের আরাম আয়েসের ব্যবস্থা করে দেয়, তারাই যদি শেষ আশ্রস্থলটুকু হারিয়ে ফেলে রাষ্ট্রীয় দানবের আঘাতে, তাহলে আমাদের কি অধিকার আছে মে দিবস পালন করার?
১৮৮৬ সালের পহেলা মে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে, শ্রমঘন্টা কমানোর লক্ষ্যে আমেরিকার শিকাগোতে আন্দোলনরত অবস্থায় কিছু মানুষ প্রাণ বিসর্জন দেন। তাদের সন্মানে পৃথিবীর অনেক দেশেই মে দিবস পালন করা হয় শ্রমিকের অধিকারের স্বার্থে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এই দিবসে ছুটি থাকে (যদিও স্বয়ং আমেরিকায় এই মে দিবসের কোনো ছুটি থাকে না)। এই মে দিবস এলেই শ্রমিকের অধিকার নিয়ে সবাই কথা বলে। কিন্তু শিকাগোর ঘটনার একশো চৌত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রশ্ন জাগে- শ্রমিক কি আদৌ তার অধিকার পেয়েছে? পৃথিবীর কোথায় শ্রমিক নিগৃহীত, বঞ্চিত নয়? ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্য- সবখানেই শ্রমিক অধিকারহারা, বাস্তুহারা। আটঘন্টা কাজের দাবিতে যে এতগুলো মানুষ প্রাণ দিল, তাতে কী লাভ হলো? বিশ্বের কোথাও কি খেটেখাওয়া নিম্নবিত্ত শ্রমিকেরা আটঘন্টা কাজ করতে পারছে? পারছে না।
সারাবিশ্বের কথা বাদ দিয়ে আমার দেশের কথাই চিন্তা করি না কেন? আমাদের দেশে মে দিবসকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়। সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় প্রতি বছর মে দিবসে। পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত মে দিবসকে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। মে দিবস এলে আমাদের নেতা-নেত্রীরা শ্রমিকের অধিকার নিয়ে বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু আমাদের দেশের মেহনতি মানুষেরা কি ভালো আছেন? নেই, মোটেই ভালো নেই ওরা। দেশের প্রধান অর্থনৈতিক খাতগুলোকে যারা দিনরাত পরিশ্রমের মাধ্যমে সচল রাখছেন, তাদের মত অসহায়, আর সুবধাবঞ্চিত মানুষ এদেশে নেই! গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথাই ধরি। ভোর হতে রাত পর্যন্ত ১২/১৪ ঘন্টা একটানা পরিশ্রম করে বস্ত্রবালিকারা যা পায়, তা দিয়ে একটা বাসা ভাড়া করেও থাকতে পারে না। বস্তিতে থাকতে হয় তাদের। খাওয়া, পরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে নাইবা বললাম। কারণ এসব বলতে গেলে লেখাটা কোথায় গিয়ে থামবে তার ঠিক নেই। মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলেও রাষ্ট্র সেটা দিতে পারেনি। অবৈধ দখলের অজুহাতে উল্টো ঐসব খেটেখাওয়া মানুষগুলোকে বাস্তুহারা করতেও রাষ্ট্র দ্বিধান্বিত হয় না! অথচ রাষ্ট্রের পুঁজিপতিরা রাষ্ট্রের অনেক খাসজমি দখল করে রাখলেও এতে রাষ্ট্র নিশ্চূপ! যাই হোক, বলছিলাম গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নের কথা। গার্মেন্ট মালিকেরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছুদিন পর পর নানা সুবিধা আদায় করে নিলেও শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে চায় না কখনোই। সরকারকেও কখনো কখনো এক্ষেত্রে অসহায় মনে হয়। এরপর চা শ্রমিক, কল কারখানার শ্রমিক, ইটভাটার শ্রমিক, মোটর শ্রমিকেরা আমাদের দেশে কত যে মানবেতর জীবনযাপন করে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কর্মঘন্টার চেয়েও অনেক বেশি সময় কাজ করেও ন্যায্য মুজুরি পান না কোনো শ্রমিকই। দেশের বাইরে যেসব প্রবাসী শ্রমিকেরা আছেন, তারাও অবহেলিত নানা দিক দিয়ে। বিদেশে গিয়ে যারা দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখেন, তাদের কোনো সমস্যায় এদেশের সরকারগুলো এগিয়ে যেতে চায় না কখনোই! এদেশে শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য আর অবহেলা এত, এত বেশি করা হয় যে তা লিখতে গেলে শেষ হওয়ার নয়।
ভাবতে অবাক লাগে, যে শ্রমিকেরা আমাদের সুবিশাল অট্টলিকা গড়ে দেয়, তাদেরকে আমরা মানুষই মনে করি না! যারা সারাদিন রিক্সা চালিয়ে আমাদের জীবনযাত্রাকে সচল রাখে তাদেরকে ন্যায্য ভাড়াটা দিতে কুন্ঠাবোধ করি, যখন ইচ্ছে তাদের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলি! যাদের পরিশ্রমে আমাদের বস্ত্রের চাহিদা মেটে, তাদেরকে এই সমাজ ‘নষ্টা’ বলতেও দ্বিধা করে না! যারা আমাদের জন্য যোগাযোগের বাহন তৈরি করে দেয়, তাদেরকেই আমরা পিষ্ট করি দরিদ্র নামক চাকার নিচে!
পৃথিবীতে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে অনেকেই ধাপ্পাবাজি করেছে। অনেকেই মেহনতি মানুষকে মুক্তি দিতে অনেক বিপ্লব আর আন্দোলন করেছে। শ্রমিকেরা যখন পৃথিবীজুড়ে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তখন কার্ল মার্কস, লেলিন, স্টালিনরা এল। মানুষকে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাল। শ্রমিকদের মুক্তি দিতে আন্দোলনে নামাল সমাজবাদীরা। রক্তে লাল হলো রাজপথ। দেশে দেশে প্রতিষ্ঠা হলো সমাজতন্ত্র। কিন্তু আখেরে লাভটা কী হলো? শ্রমিকের মুক্তি কি দিতে পেরেছে সেই সমাজতন্ত্র? মানুষ বুঝে ফেলল সমাজতন্ত্রের কপটতা। সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়তে লাগল তাসের ঘরের মত। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো সমাজতন্ত্র আছে, কিন্তু সেগুলো শুধুই প্রতীকী সমাজতন্ত্র। আধা গণতন্ত্র আর আধা রাজতন্ত্রের মিশেলে এখন সমাজতন্ত্র চলছে পৃথিবীতে।
সভ্যতার ধ্বজাধারী আমেরিকায় যখন দাস কেনাবেচা চলত, তখন আব্রাহাম লিঙ্কন নামে একজন এসে দাসপ্রথাকে উচ্ছেদ করলেন। গণতন্ত্র নামের এক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখালেন মানুষকে। বোঝালেন ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা শাসিত পদ্ধতির নাম হলো গণতন্ত্র’। শ্রমিকেরা আশায় বুক বাঁধল। এবার বুঝি জনগণ মুক্তি পাবে, খেটে খাওয়া মানুষেরা অধিকার পাবে। কিন্তু গণতন্ত্রের পিঠে সওয়ার হলো পুঁজিবাদ। যে পুঁজিবাদ গরিবকে আরো গরিব আর ধনীকে ক্রমশ ধনী বানাতে লাগল। পৃথিবীজুড়ে গণতন্ত্র যতই প্রচার পেতে লাগল, ততই মেহনতি মানুষের কষ্ট বাড়তে লাগল। তারসাথে এসে যোগ হলো সাম্রাজ্যবাদ আর বিশ্বায়ন। সাম্রাজ্যবাদ গরিবকে গোলাম বানিয়ে রাখতে শুরু করল আর বিশ্বায়ন মানুষকে অলীক স্বপ্নে আচ্ছন্ন করে সাম্রাজ্যবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট করতে থাকল অবিরত।
আসলে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, বাস্তুবাদ আর সমাজবাদ পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষদের মুক্তি দিতে পারেনি। পারার কথাও না অবশ্য। কারণ মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ শ্রমনীতি প্রনয়ণ হয়েছে ১৪শ’ বছর আগে। সেই শ্রমনীতির প্রণেতা হযরত মুহাম্মদ (স.) শ্রমিকের শ্রমের মর্যাদা যেমন দিয়েছেন তেমনি তাদের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর গজব যাদের ওপর প্রবল হবে তাদের মধ্যে রয়েছে যারা শ্রমিকের দ্বারা পুরোপুরি কাজ করায় অথচ তার ন্যায্য মজুরি প্রদান করে না’। তিনি আরো বলেন ‘তোমরা যাকে চাকর বল আসলে সে তোমার ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমার অধীনস্থ ভাইকে তুমি যা খাবে তাকে সেটাই খেতে দেবে, তুমি যা পরিধান করবে তাকে সেটাই পরিধান করতে দেবে এবং তার ওপর এমন কোন কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না যা তার পক্ষে করা কঠিন হয়’ -(বুখারি শরিফ)। ইসলামের নবি যথাসময়ে শ্রমিকের মজুরি দেয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন ‘শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাবার পূর্বেই তার ন্যায্য মজুরি দিয়ে দেবে’ -(ইবনে মাজাহ)। হাদিসে কুদসিতে আছে যে, আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন ‘কিয়ামতের দিন আমি যে তিন ধরনের লোকের বিপক্ষ তারা হচ্ছে আমার নামে ওয়াদা করার পর যে লোক তা ভঙ্গ করে, যে লোক স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে এবং যে লোক শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে তার দ্বারা নিজের কাজ আদায় করে নিয়ে তার পরিশ্রমিক দেয় না’।
মে দিবসকে অর্থবহ করে তুলতে হলে এমন চমৎকার শ্রমনীতির অনুসরণ করা চাই। তাহলে বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সকল মেহনতি মানুষের জয় অনিবার্য।
প্রকাশকালঃ মে-২০১২
0 মন্তব্যসমূহ