জীবনের রঙ


ইরা স্বামী রেজওয়ানকে অফিসে বিদায় করে দিয়ে প্রতিদিনের অভ্যেসমত কফির মগে চুমুক দিতে দিতে দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নিল। প্রথম পাতার শিরোনামগুলোতে চোখ বুলিয়ে গেল শেষ পাতায়। শেষ পাতায় গিয়েই চমকে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখল ছবিটা। হ্যাঁ, এটা তো শানেরই ছবি। কোনো সন্দেহই নেই তার। সে শেষের পাতার ডানকোনায় বক্স আকারে ছাপা হওয়া খবরটি পড়ল- ‘সার্চ ইঞ্জিন গুগলের প্রোগ্রামার হলেন বাংলাদেশের শান’। পুরো প্রতিবেদনটা মনোযোগের সাথে পড়ল। পড়ে আনন্দে, বিস্ময়ে তার মুখে হাসি আর চোখে জল ঝিলিক দিয়ে ওঠল। সে ভাবতে লাগল এই তো সেই শান যাকে সে একদিন নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসত, যার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে সে প্রস্তুত ছিল। শুধু মধ্যবিত্ত পরিবারের চাকরিহীন বেকার ছেলে হওয়ায় তার বাবা শানের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেননি। সে অভিভূত শানের এই উন্নতি দেখে। সে নিজেই কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রী ছিল। সে জানে গুগলে চাকরি পাওয়া কতবড় ব্যাপার। শুধু ব্যক্তির জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য সম্মানের ব্যাপার। ইরার এখন ইচ্ছে করছে তার বাবাকে চিৎকার করে বলবে যে বাবা দেখো যে মধ্যবিত্ত বেকার ছেলেটিকে তুমি অবহেলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলে সে এখন কোথায় চাকরি করবে, সে এখন তোমার ব্যবসার আয়ের চেয়ে বেশি স্যালারিই পাবে। কিন্তু ইরার সে আশা পূরণ হবার নয়। কারণ তারা বাবা দু বছর আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

২. 

শান যখন অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র তখনই শানের বাবা মারা যান। শানের বাবা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। হাইস্কুল শিক্ষিকা মা শান আর তার ছোট দুই ভাইবোনকে নিয়ে কষ্টে সংসার চালান। শান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় পড়ত। কিন্তু চারুকলায় পড়লেও তার কম্পিউটারের নানা ধরনের প্রোগ্রামগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার শখ ছিল। সে চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পরপরই বাবা তাকে একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলেন। মূলত তখন থেকেই তার কম্পিউটারে আগ্রহ ছিল। শান ভালোবাসত ইরাকে। ইরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। সে বিভাগ একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আসে একটা ইন্টারনেট প্রতিযোগিতার আয়োজন নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল ঢাবির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইন্টারনেট সচেতনতা বাড়ানো। সেই প্রতিযোগিতায় শান অংশ নিয়েছিল এবং সে ফার্স্ট হয়েছিল। একজন চারুকলার ছাত্র হয়েও ইন্টারনেটের প্রতিটি বিষয়ের ওপর শানের জ্ঞান দেখে ইরা অবাক হয়েছিল। অবাক হয়েছিলেন ইরার শিক্ষকেরাও। তখনই সে শানের সাথে পরিচিত হয়। সেই পরিচয়ের পর ইরা প্রায়ই শানের সাথে দেখা করতে চলে আসত টিএসসিতে। টিএসসির টঙ দোকানগুলোতে চা খেতে খেতে দুজন কম্পিউটার আর ইন্টারনেট সম্পর্কিত আলাপ করতে করতে একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। একদিন দুজন দুজনকে ভালোও বেসে ফেলে।

৩. 

শানের বাবা মারা যাওয়ার পরের বছরই সে চারুকলা থেকে পাস করে বের হয়। মায়ের কষ্ট লাঘব করতে একটা চাকরি খোঁজে। চাকরি হয় না তার। অনেক জায়গায় ধর্না দেয়। ওদিকে ইরারও পড়াশোনা শেষ হলে ইরার বাবা তাকে বিয়ে দিতে চাপ দেয়। ইরা রাজি হয় না। সে বলে চাকরি করবে। কিন্তু ইরার বাবা নাছোড়বান্দা। উচ্চমধ্যবিত্ত বাবার একমাত্র সন্তান ইরা। বাবা তাকে বলেন ইরার কোনো পছন্দ থাকলে বলতে। ইরা বলে শানের কথা। শানের সাথে দেখা করতে চান ইরার বাবা। শান সেটা শুনে রাজি হয় না। কারণ একজন বেকারের কাছে পৃথিবীর কোনো বাবাই মেয়ে বিয়ে দেবেন না সেটা শান ভালো করেই জানে। কিন্তু ইরা তাকে বোঝায় যে আজীবন সে বেকার থাকবে না। তাছাড়া তার বাবা নিজেই শানের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। ফলে শান যেতে বাধ্য হয় ইরার বাবার সামনে।

৪. 

পরিবহন ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ আহমেদ ড্রয়িংরুমে শানকে আগে একনজর দেখে নেন। অতিভদ্রভাবে শানের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। একসাথে চা খান। এরপর সরাসরিই মূল কথায় চলে যান। ‘দেখো বাবা তোমার সম্পর্কে যা জানলাম তাতে আমারও মনে হচ্ছে একদিন তুমি অনেক বড় হবে। কিন্তু সেই একদিনের আশায় আমি কীভাবে আমার একমাত্র মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিই। তুমি শিক্ষিত, মার্জিত ও বাস্তববাদী একটা ছেলে। আমিও জানি, তুমিও জানো জীবনটা সিনেমা কিংবা টিভি সিরিয়াল নয়। জীবন নানা সময়ে রঙ পাল্টায়। আমার জায়গায় তুমি নিজেকে একবার কল্পনা করো। দেখো তো আমার জায়গায় তুমি হলে কী করতে? দিতে তোমার একমাত্র মেয়েকে একজন বেকারের হাতে তুলে? দিতে পারতে অনিশ্চয়তায় ভরা একটা জীবনে ঠেলে? পারতে না। পারব না আমিও। তাই আমি তোমাকে বিনীত অনুরোধ করছি তুমি ইরাকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দাও। সেও ভালো থাকুক, তুমিও ভালো থেকো। আমি তোমাদের দুজনেরই মঙ্গল চাই।’

কথাগুলো শুনে শানের মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগল। এত ভদ্রভাষায়ও যে মানুষকে এভাবে অপমান করা যায় তা শানের জানা ছিল না। সে সোজা বেরিয়ে চলে এল। টিএসসিতে পরদিন এল ইরা। বাবার কথাগুলো সে আড়াল থেকে শুনেছিল। কিন্তু বাবা বাসায় থাকায় সেদিন কিছু বলতে পারেনি। এসেই দেখল শান মূর্তির মত বসে আছে। একের পর এক চা খেয়েই যাচ্ছে। ইরা বলল, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে তোমার। আমি আর বাবার কাছে ফিরে যাব না। তুমি চাইলে যেকোনো জায়গায় আমি পালিয়েও যেতে পারি। আমি তোমাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না, পারবও না কখনও’।
‘ইরা চলে যাও তুমি’ গর্জে ওঠে শানের কন্ঠ। তোমাকে কে ভালোবাসে? আমি তোমাকে ভালোবাসি না, কখনও বাসিওনি। আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও, নিজেও সুখে থাকো। তোমাকে ছাড়া আমি অনেক ভালো থাকব। যাও চলে যাও!

খুব কষ্ট পেয়েছিল ইরা। অভিমান হয় প্রচণ্ড শানের ওপর। শানের কঠিন ও ব্যাঙ্গাত্মক কথাগুলো শুনে নিজের ওপর, শানের ওপর রাগ ও ঘৃণা হয় তার। ফলে বাসায় চলে গিয়ে সেই যে শানের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছিল আর কখনই করেনি। বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে সে।

৫. 

শান অনেকদিন টিএসসির টঙ দোকানগুলোতে বসে থাকত ইরার অপেক্ষায়। রাগের মাথায় ইরাকে যা বলেছিল তার জন্য নিজের ওপরই প্রচণ্ড রাগ হয়। রাত-বিরাতে কখন ঘরে ফিরত তার ঠিক ছিল না। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরও ইরা ফেরে না। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন শানের মা। মায়ের অসুস্থতায় মুষড়ে পড়ে সে। দুই ছোট ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনকে নতুনভাবে শুরু করে। এক বন্ধুর সহায়তায় একটা প্রকাশনী সংস্থায় প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে পার্টটাইম কাজ করে। কাজ না থাকলে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে। ইন্টারনেট থেকে প্রোগ্রামিং’র ওপর ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে শিখতে চেষ্টা করে। বছরখানেক পরে কিছু কাজ শিখে অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোতে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করে। আয় হতে থাকে মোটামুটি। সেই সাথে কাজও শিখতে থাকে। প্রকাশনী সংস্থার চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। ২ বছরের মধ্যে একজন দক্ষ প্রোগ্রামার হয়ে যায় সে। প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজগুলোকে আয়ত্ব করে এগিয়ে যায় সফলতার দিকে। মাসে ২/৩ লাখ টাকা অনায়াসেই আয় হয় তার। মাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে। একজন অভিজ্ঞ প্রোগ্রামার হয়ে যায় আরও বছর দুয়েকের মধ্যেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনলাইনে আয়-বিষয়ক সেমিনারে তাকে অতিথি করা হয়। তার বক্তব্য শুনে নতুন প্রোগ্রামাররা অনুপ্রাণিত হয়। সার্চ ইঞ্জিন গুগল থেকেও একদিন অফার আসে। চারুকলা থেকে পাস করা এক যুবকের জীবনের রঙ পালটে যায়। সে যাত্রা শুরু করে গুগলের স্বপ্নযাত্রায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ