লাল হরফের মিছিল


২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। রাত নয়টা। ফাল্গুন চলে এলেও শীত শীত ভাবটা যায়নি এখনও। বরং রাতের বেলায় বেশ ভালোই শীত পড়ে। আদনান তার হলের রুমে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। রুমমেট নেই, বাড়িতে গেছে। তাই একা একা মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল বইটা। সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা, সেজন্য ভালো প্রস্তুতিও নেয়া দরকার। কিছুক্ষণ আগে সে রেডিও শুনে এসেছে হলের রেডিও রুম থেকে। দেশের থমথমে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতেই মূলত গিয়েছিল। সেখানে গিয়েই আগামীকাল মিছিল-মিটিংয়ের ওপর ১৪৪ ধারা জারির খবরটা শুনে এসেছে। যদিও সে জানে এসব ধারা টারা দিয়ে ছাত্রদের আটকে রাখা মুশকিল হবে, তবু শঙ্কাও কাজ করছে ভেতরে ভেতরে তার। এসব ভাবনা দূরে সরিয়ে রাখতেই বই পড়ছিল সে। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। কে আসতে পারে ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দিলো। দেখল, সাগির এসেছে। সাগির একজন হকার, বয়স ১৫/১৬ হবে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পত্রিকা ফেরি করে। আদনান তার কাছ থেকে নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা কেনে, তাই তার সাথে ভালো খাতির। আদনানকে সে অনেক সম্মানও করে।
-আরে সাগির তুমি? এত রাতে কী মনে করে?
-আদনান ভাই, খবর তো খারাপ। আশপাশের পুরো এলাকাসহ ঢাকা শহরের অনেক জায়গাতেই দেখলাম পুলিশ পাহারায় আছে। কালকে তো মনে হয় ছাত্রদের ঘর থেকেই বের হতে দেবে না। আপনাকে জানাতে এলাম, যাতে আপনারা নিরাপদে থাকতে পারেন।
-শোন সাগির, তোর কি মনে হয় যে ছাত্রদের এভাবে আটকে রাখা যাবে? মায়ের ভাষাকে মুক্ত করার যে আন্দোলন চলছে এটা কি এত সহজে দমিয়ে ফেলবে? আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেবে আর আমরা চুপ করে থাকব এটা কীভাবে হয়?
-জানি আদনান ভাই, ছাত্ররা বসে থাকবে না। তবু আপনাকে জানানো দায়িত্ব মনে করলাম।
-বুঝেছি সাগির। রাত অনেক হয়েছে, বাসায় যা এবার। নইলে বিপদে পড়বি। কাল সকালে পেপার নিয়ে আসলে কথা হবে।
আদনানকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় সাগির।

সাগির চলে যাওয়ার পর আর পড়তে ইচ্ছে হয় না আদনানের। তার মনে অনেক অজানা ঝড় বয়ে যায়। জিন্নাহর সেই ঘোষণাটা নিজকানে শুনেছিল সে। তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলো, রক্ত টগবগে এক তরুণ। একজন উর্দু না জানা লোক জিন্নাহ যখন ইংরেজিতে ঘোষণ দিয়েছিলো 'উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দ্য অনলি স্টেইট ল্যাঙ্গুয়েজ অফ পাকিস্তান', তখনই তার মাথায় রক্ত ওঠে গিয়েছিল। মাত্র ৮ভাগ লোকের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে আর ৫৬ভাগ লোকের ভাষা থাকবে অবহেলিত? মায়ের ভাষা অবহেলিত থাকবে এটা কোনো সুসন্তান মেনে নিতে পারে না! এই চার বছরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। ক্রমশ চাঙা হয়েছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন ও দাবি। এখন আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলার সময়, অথচ পুলিশ, সরকার আর প্রশাসন এভাবে অন্যায় করবে এটা মেনে নেয়া মুশকিল!

আদনান বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। সকালে উঠবে, মিছিলের জন্য স্লোগান লিখতে হবে তাই ঘুমুনোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুম তো আসে না তার। মাথায় হঠাৎ গ্রামের চিত্রায়ন শুরু হয়। বাড়িতে রেখে আসা মা, বাবা ও দুই ছোটবোনের কথাও মাথায় আসে। দুইমাস আগে বাড়িতে গিয়েছিল। পড়াশোনার চাপে ও আন্দোনলের অস্থিরতায় আর যেতে পারেনি। বাবার কাশি, মায়ের বাতের ব্যথা কমল কী না, দুই বোনের পড়াশোনা কেমন চলছে এসব জানতে চেয়ে চিঠি লিখেছিল প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। এখনো কোনো জবাব আসেনি। অথচ পরিবারের সবার কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে আজ। দেখতে ইচ্ছে করছে সবাইকেই। আরেকজনের কথাও তার মনে আসছে আজ। বিপাশা। যাকে খুব পছন্দ করে আদনান। একটি বাসায় টিউশনি করাতে গিয়ে যার সাথে পরিচয় হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী বিপাশাকে নিয়েও কত রঙিন স্বপ্ন দেখে সে। ভাবে, অনার্স শেষ করে একটা চাকরি নেবে আগে। তারপর মাস্টার্স করবে এবং বিপাশার বাসায় বিয়ের প্রস্তাবও পাঠাবে। বাবা-মাকে রাজি করাতে যদিও বেগ পেতে হবে, তবু তার বিশ্বাস একমাত্র ছেলের পছন্দকে ফেলতে পারবেন না তারা। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে আদনান বলতে পারবে না।

ঘুম ভাঙে আজানের শব্দে। পাশের মসজিদগুলো থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের সুললিত সুর শুনে ঘুম থেকে ওঠেপড়ে আদনান। ভোরের আবছা আলোয় সে চলে যায় ক্যাম্পাসের নির্দিষ্ট জায়গায়। গিয়ে দেখে আরও অনেকে চলে এসেছে। সবাই মিলে স্লোগান তৈরি করে সেগুলো বড় কাগজে লিখে মিছিলের সব যোগাড়যন্ত্র করে ফেলে। সিদ্ধান্ত হয় সকাল দশটায় তারা মিছিল বের করবে। ১৪৪ ধারা ভেঙে ফেলবে। প্রাণ গেলে যাক, মাতৃভাষার সম্মানের সাথে কোনো আপস নয়। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথম মিছিলটা বের হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, ইত্যাদি স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত মিছিলটা ক্যাম্পাস পেরিয়ে রাজপথে নামে। কিছুদূর যাওয়ার পর পুলিশ বাধা দেয়া শুরু করে৷ প্রথমে লাটিচার্জ ও টিয়ারশেল চালিয়ে মিছিলটা ছত্রভঙ্গ করে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু এতে ব্যর্থ হয়ে একসময় ফাঁকা গুলি চালায়। এতে জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। একসময় গুলি চালাতে শুরু করে। অনেকেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে যায়। আদনানের হাতেও একটা গুলি লাগে। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার আগে দেখে সেই পত্রিকা হকার সাগির মিছিলের মাঝখানে নিথর হয়ে পড়ে আছে। হাতে তার অনেকগুলো দৈনিক পত্রিকা। কিন্তু রক্তে রক্তে পত্রিকাগুলো ভিজে লাল হয়ে গেছে। সবার ওপরে থাকা পত্রিকাটির প্রধান শিরোনামটার হরফগুলো এতটাই লাল হয়ে গেছে যে কোন রঙে সেটা ছাপা হয়েছিল আন্দাজ করতে পারে না। ফাগুনের পলাশ-কৃষ্ণচূড়ায় যতটা লাল আছে, তারচেয়ে বেশি লাল রক্তে রঞ্জিত রাজপথটাও। অজ্ঞান, চেতনাহীন হয়ে পড়ে থাকে সে।

জ্ঞান ফেরার পর আদনান নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করে। হাতের যে জায়গাটায় গুলি লেগে বেরিয়ে গিয়েছিল সেখানে একটা ক্ষত তৈরি হয়। আস্তে আস্তে সেটি শুকোয়ও। পনের দিন পর অনেকটা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে হলে ফিরে আসে। কিন্তু এসে জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই সেদিনের মিছিলে মাতৃভাষার জন্য নিজের জীবন দিয়ে শহিদ হয়েছেন। সাথে সাগিরের মৃত্যু-সংবাদও শুনে। তার খুব কান্না আসে, বিশেষ করে সাগিরের জন্য। পত্রিকা ফেরি করা সাগির নামের কিশোর ছেলেটাও এখন শহিদ, ভাষাশহিদ। যে শাহাদাত গৌরবের, আনন্দের ও সম্মানের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ