হিমুর বসন্ত


হিমু, এই হিমু!
-কী হয়েছে রূপা? ডাকছ কেন?
-এই অবেলায় এভাবে শুয়ে আছ কেন? ওঠো তাড়াতাড়ি!
-আরেকটু ঘুমাই রূপা। ঠাণ্ডা লাগছে খুব। আরেকটু ঘুমুতে দাও প্লিজ!
-তুমি উঠবে না আমি চলে যাব?
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো মাথার মধ্যে। রূপা চলে যাচ্ছে,চলে যাচ্ছে,চলে যাচ্ছে... ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। যেও না রূপা। যেও না...
-ওকে যাব না। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো। দুজনে মিলে আজকে সারা বিকেল ঘুরব। আজ বসন্তের প্রথম দিন। এই দেখো আমি বাসন্তি রঙের শাড়ি পরে এসেছি। তুমি এই নতুন বাসন্তি পাঞ্জাবিটা পরে চলো বেরিয়ে পড়ি।
-আজ বসন্ত নাকি? শুভ বসন্ত রূপা!
-থ্যাঙ্কস। তোমাকেও বসন্তের শুভেচ্ছা।
-কিন্তু রূপা আমি বাসন্তি পাঞ্জাবি তো পড়তে পারব না। তুমি জানো না আমি হলুদ ছাড়া আর কোনো কালারের পাঞ্জাবি পড়ি না!
-জানি তো। কিন্তু বাসন্তি আর হলুদ তো প্রায় সেম। একদিন বাসন্তিটা পড়লে কিছু হবে না। পরে নাও প্লিজ!
-কিন্তু আমি পকেটওয়ালা পাঞ্জাবি পরি না যে।
-জানি হিমু। এই দেখো এটারও পকেট নেই। কেনার পরই পকেটগুলো সেলাই করিয়ে এনেছি।
-থ্যাঙ্কস রূপা। তুমি বসো আমি চায়ের কথা বলে আসি। চা খেয়েই বেরোব দুজনে।

২. 

আগামসি লেনের মেস থেকে রূপার সাথে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় এসে দেখা হয়ে গেল বড়খালুর সাথে। দেখলাম খালু হন্তদন্ত হয়ে আমার মেসের দিকে ছুটে আসছেন। রূপাকে বললাম তুমি গাড়িতে বসো, আমি আসছি।
-কী হয়েছে খালু?
-আর বলিস না বাবা। তোর খালা আমার লাইফটা হেল করে দিচ্ছে!
-কী হয়েছে? আবার বড়খালার সাথে ঝগড়া করেছ?
-ঝগড়া না ঠিক। তুই তো জানিস রিটায়ারমেন্টের পর থেকে আমি বই নিয়েই পড়ে থাকি। তাছাড়া আমার ড্রিঙ্কসের অভ্যেসের কথা তো তুই জানিসই। মদ না খেলে আমার শরীর-মন কিছুই কাজ করে না। কিন্তু তোর খালা তো আমাকে বই-মদ কিছুই ছুঁতে দিচ্ছে না। বলেছে মদ না খেলে বই পড়তে দেবে। কিন্তু মদ ছাড়া আমি কীভাবে বই পড়ব বল? দীর্ঘদিনের অভ্যেস বাদ দেয়া কি সহজ?
-হুঁ! খালা আর কী বলেছে?
-বলেছে মদ না খেয়ে ইয়ে খেতে!
-ইয়ে কী বড়খালু?
-ইয়ে মানে তুই বুঝিস না!
-হুঁ বুঝেছি। ঠিক আছে আজ রাতে আমি আপনাদের বাসায় আসছি। খালাকে বুঝিয়ে যেভাবে পারি বলব তোমার মদ আর বই যাতে একসাথে চলে। এখন যাই বড়খালু। রূপা গাড়িতে বসে আছে। তাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাব। আজ বসন্ত তো, তাই।
-আজ বসন্ত? অথচ দেখ আজকের দিনটাতেও তোর খালা আমার সাথে এমন ব্যবহার করল!
-ঠিক আছে খালু আমি এসে সব ঠিক করে দেব- বলেই খালুকে দাঁড় করিয়ে রেখে সোজা রূপার গাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম। ইচ্ছে ছিল বড়খালুকে আজ ইচ্ছেমত রাগাব। কিন্তু রূপা বসে আছে বলে সেটা করলাম না।

৩. 

টিএসসি আর ছবির হাটে গিয়ে রূপাকে নিয়ে অনেক ঘুরাঘুরি করলাম। টিএসসির টঙগুলোতে চা খেলাম অনেকবার। অনেক ছেলেমেয়ে আজ বাসন্তি শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে ঘুরাঘুরি করছে। দারুণ ভালো লাগছে। কিন্তু রূপার সাথে আমাকে দেখে অনেকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। হয়তো ভাবছে এত সুন্দরী একটা মেয়ের সাথে খালি পায়ে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ির এই অর্ধপাগল ছেলেটা ঘুরছে কীভাবে! এই সমস্যা অবশ্য নতুন নয়। আমি রূপাকে নিয়ে যত জায়গায় গিয়েছি সবখানেই এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। রূপাকে বললাম চলো রূপা এই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কিছুক্ষণ বসি। বসার পর বললাম বাদাম খাবে?
-না খাব না। তোমার পাশে বসে থাকি।
-আচ্ছা রূপা তুমি তো তোমার হাজব্যান্ডের সাথে সুইজারল্যান্ড চলে গিয়েছিলে। এলে কীভাবে?
-তোমাকে ছাড়া আমি আর কোথায় যাব হিমু? সুইজারল্যান্ড কেন আমাকে যদি কেউ কুমেরুতেও রেখে আসে সেখান থেকেও আমি তোমার কাছে চলে আসব।
-আমি জানি রূপা। কিন্তু তুমি তো এখন আরেকজনের ঘরণী। তুমি এভাবে চলে আসবে কেন?
-ছিলাম। এখন আর নেই। ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলে এসেছি। এখন থেকে হিমু যেখানে রূপাও সেখানে।
-সত্যি, তুমি থাকবে তো আমার সাথে সারাজীবন?
-হ্যাঁ থাকব।
হঠাৎ দেখি বাবা কোত্থেকে চলে এসেছেন আমার সামনে। এসেই বলছেন হিমু, তোকে আমি মহাপুরুষ বানানোর জন্য এত কষ্ট করলাম। আর তুই এখন নারীর মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছিস? তুই জানিস না মহাপুরুষদের নারীর সাথে জড়াতে নেই। মহাপুরুষেরা কোনো ধরনের মায়ায় জড়ায় না!
বাবার কথাগুলো শুনে ইচ্ছে করছে দূরে কোথায় দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতে। এমন কোথাও যেখানে বাবা নেই, নেই বাবার মহাপুরুষ বানানোর স্কুলও। কিন্তু এ কি! আমার পা নড়ছে না কেন? অনেক চেষ্টায়ও পা নড়াতে পারছি না আমি। বহু কষ্টে অবশেষে পারলাম উঠে দাঁড়াতে। দাঁড়িয়েই দিলাম ভোঁ দৌড়। এমন সময় মেসের ম্যানেজার মফিজ ভাইয়ের ডাক কানে এলো। হিমু ভাই, কই যান? দৌড়ান কেন?
দেখলাম মফিজ ভাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার পথ আটকেছেন।
-আপনি এভাবে রুম থেকে দৌড়ে কই যান হিমু ভাই?
বুঝে ফেললাম এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। দুঃস্বপ্নেই বাবার তাড়া খেয়ে দৌড় দিয়েছিলাম। হেসে দিলাম আমি। আমার হাসি দেখে মফিজ ভাই মনে মনে কী বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে গেলেন।

(হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত চরিত্র হিমু অবলম্বনে প্যারোডি গল্প)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ