১.
“হিমুরে! এই হিমু!
কী বাবা?
এত বেলা করে ঘুমুচ্ছিস কেন? আজকাল কি তুই অলস হয়ে যাচ্ছিস?
খুব ঠাণ্ডা বাবা পড়েছে বাবা। এই ঠাণ্ডার মধ্যে কম্বলের ভেতর থেকে বের হতেই ইচ্ছে করে না!
জানি। এই বছর নাকি বাংলাদেশে পয়তাল্লিশ বছরের বছরের মধ্যে সবচে’ বেশি ঠাণ্ডা!
তুমি জানলে কেমন করে বাবা?
যেখানে আছি সেখান থেকে সব জানা যায়রে হিমু! আচ্ছা, তুই তো মহাপুরুষ হবি। তুই এসব ঠাণ্ডা-ফাণ্ডাকে পাত্তা দিচ্ছিস কেন? মহাপুরুষদের শীত, খরা, রোদ, বৃষ্টি এসবকে পাত্তা দিতে নেই!
জানি বাবা। কিন্তু কী করব? এই হিমের মধ্যে খালি পায়ে হেঁটে বেড়ানো যে খুব কষ্টের!
হোক কষ্টের। কষ্ট না করলে তুই মহাপুরুষ হবে কীভাবে? এক্ষুণি ওঠে পড় হিমু! আর ঘুমিয়ে থাকিস না!”
২.
হিমু ভাই, ও হিমু ভাই! আর কত ঘুমুবেন? একটু দরকার আছে, ওঠেন।
ঘুম এবং স্বপ্ন দুটোই ভেঙে গেল আবুল কাসেমের ডাকে। আবুল কাসেম আমাদের মেসে নতুন এসেছে। গতকালই এসে উঠেছে।
চোখ বুজে রেখেই বললাম, কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন কাসেম ভাই?
আপনার ঘরে কি দুটো আলু ও একটি ডিম হবে? বাজার করা হয় নাই। চাল ঘরে থাকায় চুলোয় বসিয়ে এসেছি। কিন্তু খালি ভাত তো আর খাওয়া যাবে না। তাই দুটো আলু আর ডিম হলে আজকের দুপুরের খাওয়াটা চালিয়ে দিতাম। বিকেলে বাজার করে আপনার ডিম আর আলু ফেরত দিয়ে দিতাম।
আমার ঘরে কিছুই নাই কাসেম ভাই। হিমুদের ঘরে কখনো চুলো জ্বলে না, জ্বলা উচিতও না। টেবিলের ওপর দেখেন বিস্কুটের বড় একটা বক্স আছে। চাইলে এখান থেকে বিস্কুট নিয়ে যান।
বিস্কুট দিয়ে কি দুপুরের খাওয়া হয় হিমু ভাই? আপনিই বলেন?
তাহলে আর কী করার? অন্য কোথাও দেখেন গিয়ে।
অন্য আর কারো সাথে পরিচয়ই হয়নি এখনো। এই মেসে একমাত্র আপনার সাথেই পরিচয় হয়েছে। পরিচয়ের আগেই কারো কাছে ধার চাইতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আচ্ছা, হিমু ভাই আপনি কোথায় লাঞ্চ করবেন? হোটেলে?
ঠিক নেই। হোটেলেও করতে পারি, কোনো বস্তিতে কিংবা রাজপ্রাসাদেও করতে পারি। আবার লাঞ্চ নাও করতে পারি।
ও!
আপনি এক কাজ করেন। চুলোটুলো নিভিয়ে আজ চলুন আমার সাথে লাঞ্চ করবেন। দেখি আপনার লাঞ্চভাগ্য কেমন!
ঠিক আছে হিমু ভাই। আমি রেডি হয়ে আসছি। আপনিও রেডি হয়ে নিন।
৩.
তড়িৎগতিতে ওঠে ফ্রেশ হয়ে একটা শাল গায়ে জড়িয়ে আবুল কাসেমকে নিয়ে বের হলাম। এই ভয়ানক শীতের মধ্যে শালটা যদিও তেমন আরাম দিতে পারছে না, তবুও শালটায় কেমন যেন উষ্ণতা জড়িয়ে আছে। কারণ শালটা রুপা দিয়েছে আমাকে। গতকাল রুপা মেসে এসেছিল। আমি তখন বাইরে ছিলাম। আমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে এই শাল আর এক বক্স বিস্কুট রেখে গেছে। সাথে একটা চিরকুট- ‘আজও তোমাকে পেলাম না। পাওয়ার আশাও করিনি অবশ্য। যে শীত পড়েছে তাতে চিন্তা হচ্ছিল যে এত শীতের মধ্যে শুধু একটা পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে কীভাবে হেঁটে বেড়াবে। তুমি তো মহাপুরুষ মানুষ, জ্যাকেট-ব্লেজার পড়বে না। তাই এই শালটাই রেখে গেলাম। এটা কাশ্মিরী শাল। আমার এক মামা এনেছিলেন আমার জন্য। আমি তো আর মহানারী নই যে সোয়েটার-টুয়েটার পরতে পারব না! তাই শালটা তুমিই পরো। আর বিস্কুটগুলোও খেও মনে করে’। ইতি- রুপা।
মেস থেকে বেরিয়েই আবুল কাসেম ভাইকে নিয়ে গেলাম নয়নের চায়ের দোকানে। উদ্দেশ্য আবুল কাসেম ভাইকে নিয়ে দুকাপ চা খেয়ে শরীরটা চাঙা করে তারপর বেরোব। দোকানে গিয়ে বসতেই নয়ন বলল হিমু ভাই, আজকে এত দেরি কেন? দেখেন দোকানে কত কাস্টমার, কিন্তু একজনকেও চা খাওয়াই নাই। আপনে আগে চা না খেলে আমি কাউকে চা খাওয়াই না, এটা জানেন না?
এটা ঠিক না নয়ন। তোমার কাস্টমার নষ্ট হবে এরকম করলে।
হোক কাস্টমার নষ্ট। আগে তো দোকানে কাস্টমার ছিলই না। সেই যে একদিন প্রথম চা’টা আপনাকে খাওয়ালাম, তারপর থেকে তো কাস্টমার ঠেলেই সরাতে পারি না। আপনার জন্যই এই ব্যবসা করে দুটো ডালভাত খেতে পারছি!
কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি দুকাপ চা দাও। আমাদেরকে একটু বেরোতে হবে।
এই পিচ্চি, হিমু ভাই আর তার মেহমানকে ভালো করে আগে দুকাপ চা দে। তারপর বাকি সবাইরে দিতে থাক।
৪.
চা খেয়ে হাঁটা ধরলাম শাহবাগের দিকে। আবুল কাসেম ভাইকে বললাম চলেন, আজ শাহবাগ থেকে ঘুরে আসি। শুনেছি কয়েকদিন ধরে শাহবাগে দেশের তরুণ প্রজন্ম কাদের মোল্লা নামের এক ভয়ঙ্কর রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে একত্রিত হয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। গিয়ে দেখে আসি কী অবস্থা?
চলেন হিমু ভাই। আমিও যাইনি কখনো। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। আজ আপনার সাথেই যাই। আচ্ছা হিমু ভাই, এই রাজাকারগুলোর জন্য ফাঁসি কি পর্যাপ্ত শাস্তি?
মোটেই না কাসেম ভাই। এই নরপশুগুলোকে ফাঁসি না দিয়ে তরুণদের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। শাহবাগে ওদেরকে তরুণরাই উচিত শাস্তিটি দিত। ওরা একাত্তরে যে অপরাধ করেছে তার জন্য পৃথিবীতে পর্যাপ্ত কোনো শাস্তি নেই। ওদের উচিত শাস্তি একমাত্র ঈশ্বর দিতে পারেন। আমার জন্ম একাত্তরের পরে। কিন্তু আমার এক ফুপু ও এক চাচাকে একাত্তরে এই নরপশুগুলোর সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনি হত্যা করেছে। তাই ওদের জন্য আমার পক্ষ থেকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই।
হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ চলে গেলাম। হিমুদের আপ্লুত হতে নেই যদিও তবুও তরুণদের চেতনা আমাকে খুবই আপ্লুত করল। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয় ওঠেছে শাহবাগ চত্বর। সবার মুখে একই কথা- ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’। মহাপুরুষদের মুখে যদিও শ্লোগান মানায় না, তবু আজ অনেকক্ষণ শ্লোগান দিলাম। ক্রোধ আর প্রতিবাদের ভাষাও যে এত সুন্দর তা শাহবাগে না এলে বুঝতে পারতাম না। বিকেল তিনটা বাজতেই ক্ষুধা টের পেলাম। লজ্জিত হলাম মনে মনে। কারণ আবুল কাসেম ভাইকে লাঞ্চ করানোর কথা বলে বেরিয়ে এসেছিলাম। যাই দেখি আবুল কাসেম ভাইকে নিয়ে কোথাও লাঞ্চ করা যায় কী না!
৫.
শাহবাগ থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। এমন সময় পেছন থেকে ডাক শুনলাম, হিমু ভাই দাঁড়ান। হিমু ভাই, হিমু ভাই...
দেখে চিনতে পারলাম না। কাছে আসার পর বলল, হিমু ভাই, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি মন্টু, ব্লেড মন্টু! সেই যে র্যাবের ক্রসফায়ার থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন মনে নাই?
কী খবর ব্লেড মন্টু? ব্লেড দিয়ে কারিকুরি কেমন চলছে?
ভাই, আর লজ্জা দিয়েন না। জীবনে ব্লেড দিয়ে কত মানুষের পকেট কেটেছি, কতজনের হাত-পা কেটেছি। কিন্তু সেদিন র্যাবের কাছ থেকে আপনার ওসিলায় নতুন জীবন পেয়ে ওসব ছেড়ে দিয়েছি।
হু!
এখন আমি আমার দুই শীষ্যকে নিয়ে একটা হোটেল দিয়েছি। ভাতের হোটেল। হালাল টাকায় যে এত সুখ তা আগে জানতাম না হিমু ভাই। জানলে কখনোই ব্লেড মন্টু হতাম না! তবে আমার একটা ইচ্ছে জীবনে আর একবার ব্লেড দিয়ে কাটাকাটি করব। অবশ্য কোনো ভালো মানুষদের কাটব না। ঐ যে শাহবাগে যাদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে সেই কুত্তার বাচ্চাগুলোকে মনের সুখে যদি ব্লেড দিয়ে কাটাকাটি করতে পারতাম, ওদের চামড়াগুলো ছিলে আলাদা করে সারা গায়ে লবন মিশিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে ব্লেড মন্টু নামটা সার্থক হত হিমু ভাই!
ধুর খালি বকবকই করে যাচ্ছি। হিমু ভাই, সেদিনের পর থেকে আপনাকে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। আজকে যখন পেয়েছি আমার ভাতের হোটেলে আপনাকে আজকের লাঞ্চটা করতেই হবে। আপনি আপত্তি করলেও শুনব না। হোটেল বেশি দূরে না। এইতো সামনেই। চলেন যাই।
বুঝলাম ব্লেড মন্টুর হাত থেকে আজ মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। তাছাড়া আমি আর আবুল কাসেম ভাই দুজনেই ক্ষুধার্ত। এই মুহূর্তে ব্লেড মন্টুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। আবুল কাসেম ভাইকে নিয়ে চললাম ব্লেড মন্টুর ভাতের হোটেলের দিকে।
(হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্র নিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা প্যারোডি)
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি-২০১৩
0 মন্তব্যসমূহ