অপরাজিতা, তোমার জন্য


অপরাজিতা, কেমন আছো এই প্রশ্নটা আর করতে ইচ্ছে করে না। জানি সুখের নতুন ঠিকানায় ভালো আছো। পত্রহীন বৃক্ষে নতুন সবুজ পাতার মত তোমার হৃদয়েও লেগেছে নতুনের ছোঁয়া। আমি কেমন আছি, সেটাও বলব না আজ। আমার ভালো থাকার সব অধিকার তো সেদিনই শেষ হলো, যেদিন বিদায় বলে তোমাকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম জীবনের সকল বন্ধন থেকে। আমি তো সেদিনই পরাজিত হয়ে গেছি, যেদিন জেনেছি সুখ মানে টাকা-পয়সা আর প্রাচুর্যে ভরা জীবন।

অপরাজিতা, অনেক না বলা কথা মনে জমা হয়ে আছে, হৃদয়ের গহীনে জমে আছে কবিতার অজস্র কষ্টার্ত শব্দমালা। অবাঞ্চিত জীবনের অনাদৃত আকাঙ্ক্ষার এক এপিটাফ হিসেবে আজ কথাগুলো না লিখলেই নয়। ভেবেছিলাম জীবন তো চলেই যাবে, শূন্যতাটাও পূরণ হয়ে যাবে জগতের নিয়মে। কিন্তু সব শূন্যতা যে পূরণ হয় না তার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আজ আমি বেঁচে আছি; কষ্টের কালিতে তাই লিখতে বসেছি কালের গর্ভে বিলীন হওয়া স্বপ্নের কথামালা।

অপরাজিতা, শৈশবের প্রাকৃতিক কান্নার পর আমি জীবনে প্রথম কবে কেঁদেছিলাম মনে আছে? হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম তোমার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু একবারও ফিরে চাওনি, আমার কান্নার শব্দ কি তবে হারিয়ে গিয়েছিল রাজপথে ঝড় তোলা তোমার হাই-হিলের শব্দে? আজও কাঁদি আমি অপরাজিতা। কেউ দেখতে পায় না, কেউ শুনতেও পায় না। শুধু বিষণ্ণ মুখটা দেখে কেউ কেউ করুণা দেখিয়ে জানতে চায়, মন খারাপ কেন? এই করুণাগুলোও আজকাল খুব অসহ্য লাগে, অনাহূত এক যন্ত্রণায় ভেতরটা কুড়ে কুড়ে শেষ করে দেয় মানুষের দয়ার্ত চাহনিগুলো!

অপরাজিতা, ফাঁসির আসামিও তো জানতে পারে তার অপরাধ কী, যথেষ্ট সুযোগ পায় আত্মপক্ষ সমর্থনেরও। অথচ আমার অপরাধটা কী ছিলো আজও জানতেই পারলাম না! হৃদয়ের গভীরতম জায়গা থেকে কাউকে ভালোবাসাটা যে জঘন্য কোনো অপরাধের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, সেটা আইনশাস্ত্রে নিতান্তই অজ্ঞ, অর্বাচীন এই আমি কীভাবে জানব বলতে পারো? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ভালোবাসার অপরাধেরও যে বিচার হয় সেটাই বা কে জানত। স্বপ্নের সীমানায় রোজ হানা দিয়ে আমার জীবনটাকে দুঃস্বপ্নের দাবানলে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে একটুও বুক কাঁপল না তোমার? কাঁচের ঘরের মত হৃদয়টাকে টুকরো টুকরো করে দিতে একটুও বিবেকে বাধেনি তোমার? এত বিবেকহীনা কীভাবে হতে পারলে অপরাজিতা!

অপরাজিতা, চলে গেছ দুঃখ নেই। যাওয়ার আগে রঙিন ঐ স্বপ্নটা দেখিয়ে না গেলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত? আপাদমস্ত যে আমি একদা বাউণ্ডুলেপনায় ডুবে থাকতাম, জীবনকে খুব সরলরেখার মত করে ভাবতাম, সেই আমাকে জীবনের রূপ, রস, রঙ সব দেখিয়ে, চিনিয়ে কেন হঠাৎ করেই অনন্ত এক আক্ষেপের গল্প হয়ে গেলে? আমার এই বেঁচে থাকাটাকে কেন বেদনার এক অসমাপ্ত কবিতায় পরিণত করে দিলে?

জীবন নাকি জীবনের নিয়মে চলে যায়। কিন্তু আমার জীবনটা যে আটকে আছে তোমার সেই প্রস্থানের দিনটিতেই। আমি জীবনের হিসেব মেলাতে গিয়ে যখন দেখি সেখানে সবচেয়ে বড় গরমিলটার নাম শুধুই তুমি, তখনই নিস্তব্দ, নিথর হয়ে জীবনের বালুকাবেলায় পড়ে থাকি প্রাণহীন এক জড় পদার্থের মত। যে পদার্থের কোনো রঙ, রূপ নেই। যে পদার্থ এতই বিবর্ণ, ধুসর যে তাকে বরং অপদার্থ বলাই শ্রেয়। দুঃস্বপ্নের অতল চোরাবালিতে ডুবে গিয়েও আজও তাই একের পর এক প্রহর গুনি অনন্ত অপেক্ষায় শুধু তোমারই জন্য অপরাজিতা। শুধুই তোমার জন্য।

ইতি
তোমারই মেঘনীল কিংবা আমার অসমাপ্ত কবিতা

প্রকাশকালঃ দৈনিক সমকাল, ১১ই ফেব্রুয়ারি-২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ