রমজান মাস। খাঁ খাঁ রোদ্দুর। রেলস্টেশনে ট্রেনেরঅপেক্ষায় বসে আছি। অফিসের একটা জরুরি কাজে যাব যশোর। গরমে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ। দরদর করে বেয়ে পড়ছে ঘাম। ন্যাপকিন দিয়ে বারবার মুখ আর গলার ঘাম মুছছি। হঠাৎ একটা ছোট্ট মেয়ে পেছন থেকে এসে বলল, ভাই পাঁচটা টেকা দ্যান? পেছনে তাকাতেই দেখলাম সাত আট বছরের একটা মেয়ে। পরনে মলিন একটা ফ্রক। নিচের দিকে অনেকটা ছেঁড়া। যাই হোক, আমি জানতে চাইলাম পাঁচ টাকা দিয়ে কী করবি?
একটা পাউরুটি কিইনা খামু।
তোর নাম কী? থাকিস কই?
আমার নাম দীনা। থাকি ঐ বস্তিতে- বলেই মেয়েটা রেললাইনের পাশের একটা বস্তি হাত তুলে দেখাল।
দেখলাম রেললাইনের পাশে বেশ কয়েকটি খুপড়ি ঘর। তারপর জানতে চাইলাম, তোর মা-বাবা নেই?
মা ছোটবেলায়ই মইরা গ্যাছে। বাবা আছে, কিন্তু হেয় আমারে ঠিকমত খাওন দেয় না। কী সব খাইয়া আবুলের দোকনে সারাদিন পইড়া থাকে।
এমন সময় ট্রেন চলে এলো। আচ্ছা ঠিক আছে। এই নে বিশ টাকা, কিছু কিনে খাস- বলেই বিশ টাকার একটা নোট মেয়েটির হাতে দিয়ে ট্রেনে ওঠে পড়লাম।
ট্রেনে সিটটা জানালার পাশেই পড়েছে। জানালা খুলে দিয়ে শরীরটাকে সিটের সাথে এলিয়ে দিলাম। ট্রেন চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে শরীরটাও ঠান্ডা হয়ে এলো। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কিছুক্ষণ আগের দেখা মেয়েটার কথা। ভাবনাগুলো এলোমেলো হতে লাগল। এই সুন্দর ছোট্ট মেয়েটার জন্য কেমন জানি মায়া হতে লাগল। যে মেয়েটার এই বয়সে লেখাপড়া করার কথা, সে এখন মানুষের কাছে হাত পাতে খাবারের জন্য! মেয়েটার বাবার প্রতিও ঘৃণা হতে লাগল। সে কি বাবা? নাকি বাবা নামের কলঙ্ক? আরো ভাবলাম, ঢাকায় ফিরেই যাব মেয়েটার বস্তিতে। ওর বাবার সাথে কথা বলে দেখব কেন মেয়েটার প্রতি যত্ন নেয় না! এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারব না। যখন ঘুম ভাঙল, দেখি ট্রেন যশোরের কাছাকাছি এসে গেছে।
বাব্বাহ, ঘুম তো ভালোই হলো। অবশ্য হওয়ারই কথা। কারণ সারারাত জেগে থাকা আর দিনের এই অসহ্য গরমে এমনিতেই ক্লান্ত ছিলাম। যাই হোক, ট্রেন থেকে নেমে সোজা একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। কারণ ইফতারের আর বেশি বাকি নেই। ইফতার করে হোটেলে উঠব। এরপর কালকে সারাদিন কাজ সেরে রাতেই ঢাকায় রওনা হব।
ঢাকায় ফেরার পরেরদিন অফিস শেষ করে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম দীনাদের বস্তিতে। গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, দীনাদের ঘর কোনটা? আমাকে দেখিয়ে দিল লোকটা। ঘরের সামনে গিয়ে ডাকলাম, দীনা আছ নাকি ঘরে? আমার ডাক শুনে মেয়েটা বাইরে বেরিয়ে এলো। এসেই অবাক! আরে আপনি এখানে! আমাগো মতো গরিবের বস্তিতে আপনি ক্যান আইছেন ভাইজান?
এসেছি তোমার বাবার কাছে। সে কোথায়? তার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।
হেয় তো আবুলের দোকানে।
যাও তাকে নিয়ে এসো।
আচ্ছা, আপনি বসেন, আমি তারে নিয়া আইতাছি- বলেই মেয়েটা তাদের ঘরের বাইরে একটা মাদুর বিছিয়ে দিলো। আমাকে বসিয়ে রেখে দীনা তার বাবাকে নিয়ে এলো। লোকটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম বয়স বেশি হয়নি। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। কিন্তু চেহারা দেখলে বোঝা যায় অনেক বয়স। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে পাক ধরেছে। আমার কাছে এলে আমি তাকে বললাম, ভাই কেমন আছেন?
আমাগো আর থাকা না থাকা। আপনি আমার কাছে ক্যান আইছেন হেইডা কন?
আপনি কী করেন?
কিছু করি না। সারাদিন আবুলের দোকানে গিয়া তাস খেলি। দিনমজুরের কাম পেলে করি মাঝে-মইধ্যে।
ওর কথা শুনে আমার মাথায় রাগ চাগিয়ে উঠল। বেশ রাগের সঙ্গে বলতে শুরু করলাম- আপনার এই মেয়েটা যে মানুষের কাছে হাত পাতে আপনি জানেন? আপনি সামর্থ্যবান বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে ভিক্ষা করতে পাঠান আপনার লজ্জা করে না! এমন বাবা থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই তো ভালো। আপনি জানেন এই মেয়েটার এখন লেখাপড়া করার বয়স? আপনি একটু কষ্ট করলেই তো আপনার মেয়েটা লেখাপড়া করতে পারে। আপনি তা না করে গাঁজা খান আর তাস খেলে সময় কাটান। এসব কি ঠিক? গাঁজা খাওয়া যে ক্ষতিকর এবং আইনত অপরাধ আপনি জানেন না?
এখনো সময় আছে, আপনি ভালো হয়ে যান। সময় থাকতে মেয়েটার দিকে একটু নজর দিন। নইলে পরে কিন্তু পস্তাবেন। আর এই নিন, পাঁচশো টাকা। মেয়েটাকে একটা জামা কিনে দেবেন। ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়ে থাকে মেয়েটা। দেখতে খারাপ লাগে।
আমার কথাগুলো শুনে লোকটা কেন যেন কোনো রিঅ্যাক্ট করল না। এই টাইপের লোকেরা এসব কথা শুনলে ভয়াবহ রিঅ্যাক্ট করে থাকে সাধারণত। শুধু অঝোরে সে চোখের পানি ফেলতে লাগল। চলি দীনা, ভালো থেকো- বলেই আমি সেদিন সেখান থেকে চলে এলাম।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। থামার কোন লক্ষণ নেই। আমার পাসপোর্ট রিনিউ করতে দিয়েছিলাম। আজ ডেলিভারির তারিখ। তাই অফিস থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এলাম। অনেক কষ্টে একটা রিকশা পেয়ে পাসপোর্ট অফিসে গেলাম। পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেই পড়লাম বিপদে। এই বৃষ্টির মধ্যে কোন রিকশাই খালি পাওয়া যাচ্ছে না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বেশকিছু দূর। গন্তব্য বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডও বেশ দূরে, এই বৃষ্টিতে হেঁটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে একটা ছাউনিমতো জায়গায় আবার দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ একটা সিএনজি এসে সামনে থামল।
স্যার, উডেন আর কন কই যাইবেন?
আরে আপনি? লোকটাকে দেখেই চিনে ফেললাম আমি। এতো দীনার বাবা! আপনি সিএনজি চালান! আমি অবাক।
স্যার, সবই আপনার দোয়া। আপনারে অনেক খুঁজছি , কিন্তু পাইনাই। আজ পাইছি যখন আগে সিএনজিতে উডেন, তারপর কথা কইমু।
উঠে পড়লাম সিএনজিতে। বসার পর লোকটা বলতে শুরু করল, স্যার হেইদিন আপনি চইলা যাওনের পর বেশ কয়েক রাইতে ঘুমাইতে পারি নাই। অনেক খুঁজছি আপনেরে। প্রথমে আপনের উপ্রে খুব রাগ হইলেও পরে ভাবসি আপনি তো ঠিক কথাই কইছিলেন। আসলেই তো আমি আমার মা-মরা মাইয়াডার উপ্রে অবিচার করতেছিলাম। আমি হেইদিনই বুঝতে পারলাম আমি ভুল করতেছি। তাই এখন আমি বদলায়া ফেলাইছি নিজেরে। গাঞ্জা খাই না, তাসও খেলি না। দুইমাস হলো আমি সিএনজি চালাই। ওই বস্তি থেইকাও চইলা আইছি। একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়া দীনারে লইয়া থাকতাছি। ভাবতাছি সামনের বছর ওরে ইশকুলে ভর্তি কইরা দিমু।
আমি ভাবতেও পারিনি একটা লোক আমার কয়েকটা কথায় এভাবে বদলে যাবে! আমার খুব ভালো লাগল তার ওই বদলে যাওয়া দেখে। তার এমন অসাধারণ পালাবদল দেখে খুব শান্তিও লাগছে। লোকটাকে বললাম, আপনার এই পরিবর্তনে আমি খুব খুশি। আমি চাই আপনার মেয়েটাকে আপনি মানুষের মত মানুষ করেন। ভালো করে লেখাপড়া শেখান।
আপনি দোয়া কইরেন স্যার।
অবশ্যই করবো।
জানেন স্যার আমরা কিন্তু ঢাকার মানুষ না। রাক্ষুসী নদী সব নিয়া নিছে, তাই নিঃস্ব হইয়া ঢাকায় আইসা ঐ বস্তিতে উঠছিলাম। দীনা সে সময় দুই বছরের। ঐখানে যাওনের দুই বছর পর টাইফয়েড জ্বর হইয়া বিনা চিকিৎসায় দীনার মা মইরা গেল। হেরপর থেইকাই আমি খারাপ হয়া গেছিলাম। কিন্তু আমার মাইয়াটার লাইগা আমি আবারও বদলাইয়া গেছি। আমার হগল চিন্তা এখন আমার মাইয়াটারে লইয়া।
ওর কথা শুনে ভাবতে লাগলাম, মানুষের জীবনে পালাবদল হতে বেশি সময় লাগে না। শুধু তাদের ভেতরের বোধটাকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই হলো। যাই হোক, আমার গন্তব্যে এসে আমি নেমে গেলাম। লোকটাকে ভাড়ার টাকা কিছুতেই দিতে পারলাম না। আমার একটা কার্ড বের করে দিলাম। বললাম, কোনো দরকার হলে আমার অফিসে আসবেন।
অবশ্যই আইমু স্যার, বলেই লোকটা সিএনজি নিয়ে চলে গেলো।
0 মন্তব্যসমূহ