শরাফত আলি খানের আজ ৭৯তম জন্মদিন। শহরের বিশিষ্ট নাগরিক ও শিল্পপতি তিনি। প্রতি বছরই জন্মদিনে বিশাল আয়োজন করেন তার বাড়িতে। সারাদিন কাঙালিভোজ ও রাতে অভিজাতদের পার্টির আয়োজনের মাধ্যমে দিনটা তিনি উদযাপন করেন। সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত শরাফত সাহেবের এক পা খোঁড়া অনেকদিন থেকেই। স্ট্ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয় তাকে। তার বিশাল অট্টালিকার আঙিনাতে কাঙালিদের খাওয়ার জন্য শামিয়ানা টানানো হয়েছে। সেখানে তিনি বরাবরের মতো এবারও কাঙালিদের থালায় খাবার তুলে দিয়ে তার জন্মদিনের কার্যক্রম শুরু করবেন।
সকাল থেকেই তার বাড়িতে কাঙালিরা এসে ভিড় করতে শুরু করল। দুপুরে জোহরের নামাজের পরে তিনি স্ট্ক্র্যাচে ভর দিয়ে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে তার সন্তান আর নাতি-নাতনিরাও। কয়েকশ' কাঙালি থালা সামনে নিয়ে লাইন দিয়ে বসে আছে। শরাফত সাহেব বাড়ির কাজের লোক রহিমের হাতে থাকা খাবারের গামলার দিকে এগিয়ে গেলেন। লাইনের শুরু থেকে খাবার দিতে শুরু করলেন। প্রথমেই বয়স আর দারিদ্র্যের ভারে ন্যুব্জ একজন বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেলেন। বৃদ্ধ মাথা নুইয়ে রাখলেও মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শরাফত সাহেব বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন। কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর দ্রুত কয়েকজনের থালায় খাবার তুলে দিয়ে রহিমকে সব খাবার বিলি করার নির্দেশ দিয়ে সন্তান আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। গিয়ে ডেকে পাঠালেন পুরনো ড্রাইভার রমজানকে। তাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে বেশকিছু নির্দেশনা দিলেন। রমজান শরাফত সাহেবের গ্রামের ছেলে ছিল। ২৫ বছর ধরে শরাফত সাহেবের খাস ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছে।
দিনের সব আয়োজন সেরে রাতে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলেন শরাফত সাহেব। কাঙালিভোজের বৃদ্ধের চেহারাটা বারবার তার সামনে ভেসে ওঠছে। তীক্ষষ্ট বুদ্ধির লোক তিনি। এক পলক দেখেই বৃদ্ধকে তিনি চিনে ফেলেছেন। হ্যাঁ, লোকটি তারই গ্রামের এককালের প্রতিবেশী আলমাস উদ্দিন। শরাফত সাহেবের মাথা গরম হতে থাকে আলমাস উদ্দিনের কথা ভাবতেই। এ আলমাস উদ্দিনের জন্যই আজ তাকে স্ট্ক্র্যাচে ভর করে হাঁটতে হয়। আলমাস উদ্দিনের গুলিতেই যে পা-টা খোঁড়া হয়েছিল তার। তিনি চোখ বুজে হারিয়ে যান ৪৫ বছর আগের স্মৃতিতে।
১৯৭১ সালের মে মাস। সারাদেশে যুদ্ধাবস্থা। পাকিস্তানি সেনারা বাঙালির ওপর চালাচ্ছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সে যুদ্ধের রেশ এসে লাগে শরাফত-আলমাসদের গ্রামেও। পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প করে তাদের স্কুলে। গ্রামে গঠিত হয় শান্তিবাহিনী। সেই শান্তিবাহিনীর প্রধান ছিলেন শরাফত আলি খানের বাবা আফসার আলি খান। গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবার আর সেই সঙ্গে বাবা আর পাকিস্তানিদের প্রভাবে শরাফত আলি সে সময় নিজেকে রাজা ভাবত, যা ইচ্ছে তা করে বেড়াত সে। পাকিস্তানিদের খেদমতে গ্রামের যুবতী-তরুণী এমনকি কিশোরীদের পর্যন্ত সে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে নিজে ধর্ষণ করত, তারপর পাকিস্তানিদের দিয়ে দিত। অকথ্য শারীরিক নির্যাতন করে মেরে ফেলা হতো সেসব নারীকে। সে গ্রামেরই কিছু যুবক দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল শরাফতের প্রতিবেশী আলমাসও। আলমাসের যুদ্ধে যাওয়া মেনে নিতে না পেরে শরাফত তার একমাত্র বোনকেও নিয়ে ধর্ষণ করে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেয়। হত্যা করে তার মা ও বাবাকে।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে আলমাসের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ চালায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। তছনছ করে দেয় পুরো ক্যাম্প, হত্যা করে সব পাকিস্তানি সেনাকে, ছিনিয়ে নেয় তাদের সব অস্ত্র। অনেক মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। অবস্থা বেগতিক দেখে শরাফত আর তার পরিবার পালিয়ে যেতে চায়। গাড়িতে উঠতে যাওয়ার সময় আলমাসের একটা গুলি এসে পায়ে লাগে শরাফতের। তারপর জ্ঞান হারায় সে এবং নিজেকে ঢাকার একটি হাসপাতালে আবিস্কার করে।
ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন শরাফত সাহেব। ড্রাইভার রমজানকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন।
পরদিন সকালে সব টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ আসে, 'রাজধানীর কড়াইল বস্তির পাশের ড্রেন থেকে উদ্ধার হলো বৃদ্ধের লাশ। লাশটি আলমাস উদ্দিন নামের একজনের। তিনি এ বস্তিতেই বাস করতেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।'
প্রকাশকালঃ দৈনিক সমকাল, ২০১৭
0 মন্তব্যসমূহ