নষ্ট


১.

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই একটা ট্যাক্সি ভাড়া করল পারভেজ। গন্তব্য গুলশান। ওখানে একটা অস্ট্রেলিয়ান বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ শাখার প্রধান হিসেবে আজই জয়েন করার কথা তার। প্রায় দীর্ঘ সাত বছর পর দেশে ফিরছে সে। সেই যে স্কলারশিপ পেয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল, আর দেশে আসেনি। একেবারে পড়াশোনা শেষ করে, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে নতুন এই চাকরি নিয়েই দেশে ফিরছে। ঐ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুদিন ধরেই একজন বাংলাদশি-অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক খুঁজছিল। কারণ আগে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। কিন্তু তিনি এখানে কাজ করতে এসে নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ায় তাকে আবার অস্ট্রেলিয়ায় ফিরিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পারভেজ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেছিল। তারপর তাকে তারা ডেকেছিল ইন্টারভিউর জন্য। ওর যোগ্যতা আর স্মার্টনেস দেখে ওকে নিয়োগ দিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

ট্যাক্সিতে বসে পারভেজ চারপাশে চোখ বুলিয়ে ভাবছে ঢাকা এই সাত বছরে অনেক বদলে গেছে! সবকিছুই অচেনা লাগছে তার। রাস্তায় যানজট আগের চেয়েও বেড়েছে। দামি দামি গাড়িও প্রচুর ঢাকার রাস্তায়। আর সুউচ্চ ভবন তো আছেই।

পারভেজের মা-বাবা ও একমাত্র ছোট ভাই বগুড়ায় থাকেন। ওর বাবা ওখানে একটা গ্রোসারি শপ চালান। ছোট ভাই নয়ন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে। পারভেজ আজ দেশে আসার খবর শুনে ওনারা আসতে চেয়েছিলেন ঢাকায়। কিন্তু পারভেজ মানা করেছে। বলেছে ও ঢাকায় পৌঁছে এক সপ্তাহ শুধু অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকবে। সবকিছু বুঝে নিয়ে এক সপ্তাহ পর সে নিজেই যাবে বগুড়ায়। তারপর উনাদেরকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসবে। তাই তাদেরকে বলেছে সব কিছু গোছগাছ করে রাখার জন্য। আর বাবার গ্রোসারি শপ বিক্রি করতেও বলেছিল। গতকালই নাকি উনি সেটা বিক্রি করে দিয়েছেন। ও যে এসেছে সেই খবরটা বিমানবন্দর নেমেই মা-বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে।

পারভেজ সকাল ঠিক এগারোটায় গুলশানের অফিসের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামল। বারো তলা ভবনের দশম তলায় ওর অফিস। লিফট হয়ে সোজা চলে গেল অফিসে।

২.

টানা একসপ্তাহ অফিসের কাজে সীমাহীন ব্যস্ততায় দিন কাটল পারভেজের। আজ অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে রাত দশটা বেজে গেল। কোম্পানির গাড়িতে করে সোজা চলে গেল কোম্পানির দেয়া ফ্ল্যাটে। গিয়ে ফ্রেশ হয়েই সোজা বিছানায়। পরদিন ঘুম ভাঙল সকাল সাতটায়। শুক্রবার হওয়ায় সারাদিন আজ ফ্রি থাকবে সে। ফ্রেশ হয়ে এক মগ কফি হাতে নিয়ে দরজার সামনে থেকে দৈনিক পত্রিকাটা তুলে নিল। বারান্দায় গিয়ে ইজিচেয়ারে বসে কফির মগে চুমুক দিয়ে পত্রিকায় চোখ বুলাতে লাগল। প্রথম পাতার নিচের দিকে এসে একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল তার । সংবাদটার শিরোনাম হলো- ‘চাঞ্চল্যকর শিশু সামি হত্যা মামলার রায়ঃ একমাত্র আসামি তারেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’। সংবাদের ওপরের ছবিটা দেখে আর পুরো সংবাদটা পড়ে ঠিক বিশ্বাস হলো না ওর। এটা কী করে হয়? এই কি সেই তারেক যে আমার কলেজ জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল? ভাবতে থাকে পারভেজ। হ্যাঁ, সেই তারেকই তো! ছবি ও বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? তারেক কীভাবে একটা ছোট্র শিশুকে খুন করতে পারে? আর ভাবতে পারে না ও। মাথার মধ্যে একটা যন্ত্রণা কিলবিল করতে থাকে। স্মৃতির গভীরে হাতড়াতে থাকে পারভেজ। তারেকের স্মৃতিগুলো ভাবনায় চলে আসে। আহারে! কত মেধাবী ছিল ছেলেটা। ওর মনে পড়ে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ওরা দুজন কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারত না। দুজনেই একই মেসে থেকে পড়াশোনা করত।

তারেকের বাবা নেই। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল। রংপুরে ছিল ওদের বাড়ি। ওর মা গ্রামে বাবার রেখে যাওয়া জায়গা-জমি লোক দিয়ে চাষ-বাস করাতেন আর স্বপ্ন দেখতেন তারেককে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। ঢাকা কলেজ থেকে একসাথে ইন্টারমিডিয়েট কমপ্লিট করে স্কলারশিপ পেয়ে পারভেজ অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। তারেক ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও ইন্টারমিডিয়েটে তারেক পারভেজের চেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছিল, কিন্তু তারেক স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেনি। তারেক বলত এই দেশ আর তার মাকে দেশে রেখে সে কোথাও যাবে না। পারভেজ অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরও প্রায় একবছর তারেকের সাথে যোগাযোগ ছিল। তারপর হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ পারভেজ তারেকের মেসের ঠিকানায় বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েও জবাব না পেয়ে ভেবেছিল ও মনে হয় মেস পাল্টিয়ে ফেলেছে। তাই আর চিঠি পাঠায়নি। দেশে এসে অফিসের ঝামেলা শেষ করে মা-বাবাকে শহরে এনেই তারকের খোঁজ করবে ভেবেছিল সে। কিন্তু পত্রিকায় সংবাদটা পড়ে ওর মন এতটাই বিষন্ন হয়ে গেল যে, হতাশার গভীর সাগরে নিমজ্জিত হলো যেন আজ! সে ভেবেই পাচ্ছে না, তারেক কেন নিজেকে এভাবে নিঃশেষ করে দিল। কী সেই কারণ যে একটা শিশুকে খুন করতে হলো? অবশ্য এখানে তারেককে একটা রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার হিসেবে দেখানো হয়েছে। মানলাম তারেক ছাত্র রাজনীতিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল। মানলাম সে একাধিকবার (পত্রিকার ভাষ্যমতে) জেলও খেটেছিল। কিন্তু তাই বলে শিশুটিকে কেন সে খুন করল? পারভেজ জানে হামলা-মামলা-জেল এসব বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতিতে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু...অনেক ভেবেও কোন কূল-কিনারা পেল না সে। পারভেজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আগামি রবিবারেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তারেকের সাথে দেখা করতে যাবে। আজ-কাল দুদিন অফিস বন্ধ। সুতরাং আজই বগুড়া চলে যাবে ভাবল সে। গিয়ে মা-বাবাকে এনেই তারপর তারেকের ব্যাপারে খোঁজ-খবর শুরু করবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। এগারোটার দিকে বাসে করে বগুড়া গেল তারেক। একদিন থেকে পরের দিন সকালে সবাইকে চলে এল তার গুলশানের ফ্ল্যাটে। সারাদিন সব গোছগাছ করে রাত বারোটার দিকে বিছানায় গেল।

৩.

পরদিন সকাল নয়টায় অফিসে গিয়ে টানা দু'ঘন্টা কাজ করল পারভেজ। মোটামুটি কাজগুলো গুছিয়ে অফিসের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করে তারেকের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। যখন সাক্ষাতের সময় এল, তারেক আরো অনেকের সাথে কারাগারের সাক্ষাতের জায়গার একেবারে ডান কর্নারে এসে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল পারভেজও। লোহার ঘন শিকের ফাঁকে তারেককে দেখে হাত তুলে ডাকল পারভেজ। তারেকের চেহারার দিকে তাকিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল পারভেজের। তারেককে দেখতে একেবারে বিধ্বস্ত লাগছে!
-কেমন আছ তারেক? জোরে বলে উঠল পারভেজ। জোরে না বলেও অবশ্য উপায় নেই। কারণ অনেক কয়েদি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের কথার তোড়ে এখানে একে-অপরের কথা শোনা খুবই মুশকিল। একমাত্র জোরে বললেই শোনা যায়!
-তুমি কেন এসেছ? কাকে দেখতে এসেছ? আমি নষ্ট হয়ে গেছি পারভেজ, আমি আগের সেই তারেক নেই। তুমি যাও, চলে যাও। আমি এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। আমি খুন করেছি, তার শাস্তি আমার প্রাপ্য।
-শান্ত হও তারেক, প্লিজ শান্ত হও। তোমার কোনো খবরই জানতাম না আমি। গত সপ্তাহে মাত্র দেশে ফিরেছি ওখানকার একটা কোম্পানির বাংলাদেশ শাখার প্রধান হয়ে। গত পরশু তোমার খবরটা পত্রিকায় পড়ে একদমই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। তাই জানতে এসেছি আমার প্রিয় বন্ধুটি কীভাবে এত বদলে গেল? তোমার মেসের ঠিকানায় অনেক চিঠি পাঠিয়েছি, কিন্তু তুমি একটারও জবাব দাওনি। কিন্তু কেন তারেক, কেন?
-ওখানে থাকলে তো জবাব দেব! হঠাৎ মেসের মালিক ঘোষণা দিল মেসের জায়গায় বহুতল ভবন হবে। একসপ্তাহের মধ্যে মেস ছেড়ে দিতে হবে। তাই তাড়াহুড়া করে এক বন্ধুর মেসে গিয়ে কিছুদিন থাকলাম। তারপর সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এক নেতার সহায়তায় হলে গিয়ে উঠলাম। এরপর থেকেই জীবনটা বদলে যেতে শুরু করল। আমার মাঝে যে মনুষত্ব ছিল, সেটাকে উপড়ে ফেলে পশুত্বকে জাগিয়ে তোলা হলো!
থাক, সেসব অনেক কথা। শুনে তোমার কাজ নেই। বরং তুমি চলে যাও। এখানে আর কখনো এসো না প্লিজ। আমার যে সাজা হয়েছে সেটা আমার প্রাপ্য ছিল। আমি প্রাপ্যটা ভোগ করব।
-কিন্তু আমি যে সব শুনতে চাই তারেক। আমি জানতে চাই কীভাবে একটা ভালো ছেলে এমন খুনি হয়ে গেল? তুমি সব খুলে বল আমাকে প্লিজ?
-দেখো পারভেজ, এসব এখানে বলা সম্ভব না। অনেক লম্বা কাহিনি। তার উপর সাক্ষাতের সময়ও প্রায় শেষ। তোমার যদি একান্তই জানার আগ্রহ থাকে, তাহলে তোমাকে একটা মেসের ঠিকানা দিচ্ছি। ওখানে আমার এক বন্ধুর কাছে কিছুদিন ছিলাম। তার কাছে আমার একটা ডায়েরি আছে। যেটাতে আমার কিছু কথা লিখে রেখেছি। এই খুনের ব্যাপারেও ওখানে লিখে রেখেছি। তুমি তার কাছ থেকে ডায়েরিটা আমার কথা বলে আনবে। তারপর পড়ে ওটা পুড়িয়ে ফেলবে। এবার তোমার পকেটবুক আর কলমটা দাও, আমি লিখে দিচ্ছি।
-পারভেজ তার কলম আর পকেট বুক বের করে দিতে দিতে বলল, ‘আচ্ছা তাহলে তাই দাও’।
লোহার ঘন শিকের মধ্যে অনেক কষ্টে পকেটবুক আর কলম আদানপ্রদান করতে হলো।

কলম আর পকেটবুক পকেটে রেখে তারেকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জেলগেট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এল পারভেজ। তারেকের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী ওই মেসে গিয়ে পকেটবুকের পৃষ্ঠাটা দেখাতেই তারেকের ওই বন্ধু ডায়েরিটা বের করে দিল। ডায়েরিটা নিয়ে সোজা অফিসে চলে এল পারভেজ। অফিসের কাজ শেষ করে সন্ধ্যা সাতটায় বাসায় গেল সে। ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা খেল শুধু। তারপর ডায়েরিটা খুলে পড়তে শুরু করল।

৪.

“আমি তারেক। গ্রাম থেকে আমার মা আমাকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায় আর শত আশায় বুক বেঁধেছিলেন আমাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ বানাবেন। কিন্তু আমার মায়ের সেই আশা পূর্ণ হয়নি! এদেশের নষ্ট রাজনীতি আমাকে মানুষ হতে তো দেয়ইনি, উল্টো আমাকে একজন জঘন্য খুনি বানিয়ে দিয়েছে! আজ আমি একটা খুন করেছি। আট বছরের শিশু সামিকে ঠান্ডা মাথায় আমি খুন করে ওর লাশ বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছি। যদিও খুনটা আমি করতে চাইনি, সত্যিই করতে চাইনি। কিন্তু প্রতিশোধের নেশা আমার মাথায় এতটাই চাগিয়ে ওঠেছিল যে খুনটা না করে আমার উপায় ছিল না। নেতা নামের পিশাচ সাগর খানের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়েই তার সন্তানকে খুন করতে হলো আমাকে!

একটু পেছন থেকেই বলি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে ভর্তি হওয়ার পর অনেক স্বপ্ন ছিল মনে যে ভালোভাবে লেখাপড়া শেষ করে আমার মায়ের মুখে হাসি ফোটাব। একটা বছর ভালোই কেটেছিল আমার। মেসে থেকে শত কষ্টেও আমার পড়াশোনাটা ভালোই চলছিল। কিন্তু এক বছর পর সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের এক নেতার সহায়তায় হলে উঠলাম আমি। হলে গিয়ে ভাবলাম এবার পড়াশোনাটা আরো ভালো হবে। কিন্তু আমার সে ভাবনাটা কিছুদিন যেতে না যেতেই হতাশায় পরিণত হলো। ছাত্ররাজনীতি কতটা খারাপ হতে পারে হলে গিয়ে টের পেলাম আমি। প্রতিদিন মারামারি হানাহানি লেগেই থাকত হলগুলোতে। ক্যাম্পাস আর হলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্রনেতারা যে কোনো অপরাধ করতেও পিছপা হত না। হলভর্তি করে রাখা হত লাঠিসোটা, রামদা, হকিস্টিক, রড, পিস্তল ইত্যাদি অস্ত্রগুলো দিয়ে। যখন তখন মারামারি লেগে যেত আর এসব অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার চলত অহরহ। যে ছাত্রনেতার সহায়তায় আমি হলে ওঠেছিলাম, সে তার বন্ধুদের নিয়ে আমাকে প্রতিদিন বলত ওদের সাথে মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য। নানা ছুতোয় আমি না করে দিতাম ওদেরকে। কিন্তু একদিন আমাকে প্রায় জোর করেই নিয়ে যাওয়া হলো মিছিলে। সেই মিছিলে হঠাৎ শুরু হলো মারামারি। সে কী মারামারি! পুলিশের হস্তক্ষেপে মারামারি বন্ধ হলেও বেশ কয়েকজন আহত হলো দুপক্ষের। আমি কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। পাল্টাপাল্টি মামলা হয়ে গেল। কিন্তু কোন অপরাধ না করেই আসামির খাতায় আমার নামও ওঠে গেল! ছাত্রনেতারা আমাকে এসে বোঝালেন, যেহেতু মামলায় আমাকে ওদের দলের ক্যাডার হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেহেতু ওদের দলের সাথে আমার এখন সক্রিয় না হয়ে উপায় নেই। তা না হলে আমাকে জেলে যেতে হবে অথবা বিপক্ষে দলের হামলার শিকার হতে হবে। সেদিন রাতে অনেক কান্নাকাটি করলাম। উপায় না দেখে ওদের কথা মেনে নিতেই হলো আমাকে। তারপর থেকেই পাল্টে যেতে শুরু করল জীবনটা। পাঁচ বছর ছাত্র রাজনীতি করে হেন অপরাধ নেই যা আমি করিনি কিংবা আমাকে দিয়ে করানো হয়নি। আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা সাগর খান ছিল একজন গডফাদার। তার নির্দেশেই আমরা সব অপকর্ম করতাম। তার সাথে আমার খুব ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। আর তখনই আমার পড়ালেখা একেবারেই লাটে ওঠেছিল। বইয়ের সাথে কোন সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও সময়ে সময়ে পরীক্ষা দিতাম। ফলাফল কেমন হতো তা তো সহজেই অনুমেয়। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকতাম। মাকে কিছু টাকাও পাঠাতাম। মাকে বলতাম পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে আয় হয় আমার। কিন্তু টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করায় টাকা-পয়সা ভালোই দেয়া হতো আমাকে। সেসব নিয়ে ইচ্ছেমতো ফুর্তি করতাম। মনুষত্ব মরে গিয়ে পশুত্ব আমাকে পুরোপুরিই কাবু করে ফেলেছিল!

৫.

পাঁচ বছর পর আমাদের সরকারের পতন হলো। নির্বাচনের কারণে গ্রামে যেতে পারছিলাম না। ওদিকে মা অসুস্থ ছিলেন। নির্বাচনের আগের দিন গ্রাম থেকে খবর এল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন গ্রামে যাই। মায়ের অবস্থা নাকি খুব খারাপ! কিন্তু সাগর খান আমাকে যেতে দিল না। বলল দুদিনে কিছুই হবে না। নির্বাচনের পরের দিন যেন যাই। নির্বাচনে আমাদের দল হেরে যাওয়ায় প্রতিপক্ষ আমাদের হলে এসে হামলা চালালো। আমরাও ওদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লাম। দুপক্ষের দু’জন স্পট ডেড হয়ে গেল। পুলিশ এসে মারামারি বন্ধ করে আমাদের অনেককেই গ্রেফতার করল। আমিও জেলে গেলাম। এর আগেও আমরা অনেকেই জেলে গিয়েছিলাম। তখন সাগর খান আমাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু এবার আমাদের দল নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় সাগর খান কিছুই করতে পারল না। জেলখানায় আমাদের বেদম পেটানো হলো। জেলে থাকায় আমার আর মার খোঁজ নিতে যাওয়া হলো না। জেলে বসে বসে ভাবতে থাকলাম মা আমার একা একা কত কষ্টে অসুস্থ শরীর নিয়ে দিন গুজরান করছেন। আর মুক্তি পাওয়ার আশায় দিন কাটাতে লাগলাম। প্রায় পাঁচ মাস পরে আমাদের জামিনে মুক্ত করা হলো। জেল থেকে বেরিয়েই সোজা চলে গেলাম গ্রামে। গিয়ে শুনলাম আমার মা নাকি নির্বাচনের এক সপ্তাহ পরেই মারা গেছেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাকে ছিঃ ছিঃ করতে লাগল আর বলতে লাগল এতবড় একটা জলজ্যান্ত পুত্র থাকার পরেও আমার মা কষ্ট পেয়ে মারা গেল। মায়ের কবরের পাশে হু হু করে কাঁদতে লাগলাম আর তখনই মাথায় প্রতিশোধের নেশা চাগিয়ে উঠল। সাগর খানের জন্যই আমি আমার মাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারলাম না- শুধু এই কথাটাই মাথায় বাজতে লাগল। সেদিন যদি আমাকে বাড়ি আসতে দিত সাগর খান, তাহলে আমার মা এভাবে ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট পেয়ে মারা যেতেন না!

ঢাকায় চলে গেলাম সেদিনই। গিয়ে উঠলাম এক বন্ধুর মেসে। অনেক ভেবে-চিন্তে বুঝলাম সাগর খানকে আমার একারে পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। সে কেন্দ্রীয় নেতা। সবসময় দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম ওর একমাত্র ছেলে স্কুলে পড়ে। মনে মনে ভাবলাম ওকেই যেভাবে হোক অপহরন করে খুন করব। তক্কে তক্কে থাকলাম কিছুদিন। ছুটির সময় স্কুলের গেটের সামনে বসে থাকতাম সুযোগের আশায়। কিন্তু ছেলেটা স্কুল থেকে বেরোবার সাথে সাথেই ওর মা এসে গাড়িতে করে ওকে নিয়ে যেত। একদিন কোনো কারণে ওর মায়ের আসতে দেরি হয়ে গেল। সেদিনই সুযোগটা কাজে লাগালাম আমি। গেটের সামন থেকে ওর মুখ চেপে ওকে কোলে করে নিয়ে একটা সিএনজিতে উঠলাম। তারপর নাকে রুমাল চেপে অজ্ঞান করে নিয়ে গেলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে। যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এল তখনই ওর গলা টিপে ওকে খুন করে বুড়িগঙ্গায় লাশ ভাসিয়ে দিয়ে এলাম। রুমালে থাকা মেডিসিনের কারণে ছেলেটা খুন করার সময়ও ঘুমিয়ে ছিল। লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে সোজা চলে এলাম বন্ধুর মেসে। দুদিন পর পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম পুলিশ লাশটা খুঁজে পেয়েছে। খুনের মোটিভ আর খুনি কে সেটা জানতে তারা তদন্ত করছে। কাগজে সাগর খান আর তার বউয়ের কান্নামাখা মুখ দেখে খুব হাসলাম আমি। আর ভাবতে থাকলাম এখনই আমাকে পালাতে হবে। এখানে থাকলে যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে হবে।

ভাবছি ডায়েরিটা মেসের ওই বন্ধুর কাছে রেখে যাব। বলে যাব ও যেনো কখনো না পড়ে এটা। তবু যদি পড়ে ফেলে কোনো সমস্যা নেই আমার। কারণ ও যখন পড়বে তখন আমি অনেক দূরে চলে যাব। আজ রাতেই আমি চলে যাব অজানার উদ্দেশ্যে। আর হ্যাঁ এসব কথা ডায়েরিতে লিখে যাওয়ার উদ্দেশ্য হলো কথাগুলো ডায়েরির সাথে শেয়ার করা। কারণ কথাগুলো বুকে চেপে রাখতে খুব কষ্ট হবে আমার। কারো সাথে যে শেয়ার করব সে উপায়ও নেই। তাই ডায়েরিতেই লিখে রেখে গেলাম।"

ডায়েরিটা পড়ে অনেকক্ষণ বিমুঢ় হয়ে বসে থাকল পারভেজ। মনের অজান্তেই তার চোখ থেকে ক’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

১৪.০৪.২০০৫

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ