চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না রিকশাচালক রহিমউদ্দিন। তার মনে এখন একটাই ভাবনা – এক সপ্তাহ পরে সে কোথায় যাবে? আর কতদিন এভাবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যাযাবরের জীবন কাটাতে হবে? তার কানে বাজছে বজলু গুণ্ডার সন্ধ্যায় দিয়ে যাওয়া সেই হুঙ্কার – ‘এক সপ্তাহের মধ্যে বস্তি খালি না করলে আগুন লাগিয়ে পুরো বস্তি পুড়িয়ে দেব’। বজলু গুন্ডা এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী। সে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সুতরাং তার কথা অমান্য করার সাধ্য এই বস্তির কারও নেই। হঠাৎই রহিমউদ্দিনের ভাবনাটা চলে যায় অবিস্মৃত অতীতে। স্মৃতি-তর্পনে তার নয়ন-সম্মুখে ভেসে ওঠে একটি সাজানো-গোছানো সুখের সংসার। মেঘনাপাড়ের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ রহিমউদ্দিনের একসময় কী ছিলো না? বারো বিঘা উর্বর ফসলি জমি, আটটি গরু যার চারটি দুধওয়ালা গাভী, বাড়ির সামনে ও পেছনে বড় দুটি পুকুর, সারা বছর যেখানে নানাধরনের মাছে কিলবিল করত, আর আঙিনাজুড়ে ছিলো হরেকরকমের শাক-সবজি। মোটকথা, রহিমউদ্দিন ছিলো একটি স্বচ্ছল পরিবারের কর্তা। যে পরিবারে অভাব বলতে কিছুই ছিলো না।
রহিমউদ্দিনের তিন সন্তান, দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলেটি বড়, নাম ফারুক, বয়েস এগারো। দুই মেয়ের নাম সাদিয়া ও তানিয়া, বয়েস যথাক্রমে সাত ও পাঁচ বছর। কত আশা, কত স্বপ্ন, কত সাধ ছিলো রহিমউদ্দিনের তার ছেলেমেয়েরা লেখাপরা শিখে দেশের সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করে মা-বাবা, গ্রাম আর দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। এইতো সেদিন ফারুক এসে বললো, বাবা আমি ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরিক্ষায় প্রথম হয়েছি। আমাদের স্যারেরা আর কমিটির লোকেরা মিলে আমাকে কাল পুরস্কার দেবে। তোমাকে কিন্তু অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। কারণ স্যারেরা বলেছেন অভিভাবকদের নিয়ে যেতে।
-আমি এসবের কী বুঝি বাবা, আমি না গেলে হতো না?
-না বাবা, তোমাকে যেতেই হবে, ছেলে জিদ ধরে বলে।
-আচ্ছা বাবা যাব। এখন ঘরে আয়, ভাত খাবে।
সেদিন অনুষ্ঠানে গিয়ে কী আনন্দটাই না লেগেছিলো। ছেলেটা যখন পুরস্কারের মেডেল নিয়ে এসেই রহিমউদ্দিনের গলায় পরালো, তখন গর্বে বুকতা ভরে গিয়েছিলো। কিন্তু নিয়তির কী খেলা, এই ফারুকই এখন ঢাকার রাস্তায় ফেরি করে ফুল বিক্রি করে বেড়ায়। হাসিখুশি, চঞ্চল ছেলেটার নীরব, থমথমে মুখতার দিকে চাইলেই কষ্ট লাগে প্রচণ্ড, হাহাকার করে ওঠে বুকের ভেতরটা।
কিন্তু কেন এমন হলো? কেন সর্বনাশা মেঘনা আমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে চুরমার করে আমাকে সর্বস্বান্ত করে দিলো? রহিমউদ্দিনের স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন মেঘনায় ভাঙন শুরু হয় তখন সে ভাবেইনি মেঘনাপাড় থেকে মাইলখানেক দূরে তার বাড়িতেও ভাঙনের রেশ এসে লাগবে। অথচ সর্বনাশা মেঘনা মাইলের পর মেইল ভেঙে এসে প্রথমে তার জমিগুলো ফসলসহ নদীগর্ভে বিলীন করলো। এরপর তার বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করলো। সবকিছু এত দ্রুতই ঘটলো যে সে কিছুই করার অবকাশ পেলো না। অনেক কষ্টে শুধু তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। এরপর থেকেই তার যাযাবর জীবন শুরু। প্রথমে সে চাঁদপুর শহরের একটি পতিত জায়গায় তাঁবু টানিয়ে বাস করতে লাগলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই ঐ জায়গার মালিক তাদেরকে অন্য পরিবারগুলোর সাথে তাড়িয়ে দিলো। এরপর ভাসমান জীবনে ঘুরতে ঘুরতে একদিন এসে পৌঁছালো এই ঢাকায়। একটি বস্তির খুপড়ি ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করতে লাগলো আর পেটের দায়ে অন্য কোনো কাজ না পেয়ে নিজে হলো রিকশাচালক ও মেধাবী ছাত্র ছেলে ফারুক হলো ফুল-বিক্রেতা। প্রতিদিন যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে দু’বেলা দু’মুঠো ডালভাত জোগাড় হয়। কিন্তু একদিন কাজে যেতে না পারলে উপোস বসে থাকতে হয়। এক সপ্তাহ পরেই রহিমউদ্দিনকে এই বস্তি ছেড়ে আবারও অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ভোর হয়ে গেলো সে বলতেই পারলো না। তার দু’চোখ দিয়ে বের হলো ক’ফোটা তপ্ত অশ্রু।
যুগান্তর-বাংলা প্রকাশ গল্প লেখা প্রতিযোগিতার সেরা একশো গল্প নিয়ে প্রকাশিত ‘একশো গল্প’ সংকলন বইয়ে প্রকাশিত। প্রকাশকালঃ একুশে বইমেলা-২০০৮।
0 মন্তব্যসমূহ