বিপন্ন স্বপ্ন


মিলি পুরান ঢাকার মেয়ে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় মিলি তার চেয়ে বেশি। স্মার্ট, ফ্যাশনেবল, আকর্ষণীয় ফিগার সবই আছে মিলির। রুপচর্চা, মেকাপ-গেটাপের ব্যাপারেও খুব সচেতন সে। পড়াশোনায় এতটা ভালো না হলেও খুব খারাপও না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত একটা কলেজে অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছে। উচ্চ মধ্যবিত্ত বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় পরিবার থেকেও খুব আদরের মধ্যে থাকে।

মিলির শোবিজ জগতের বাসিন্দা হওয়ার খুব শখ। এজন্য ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখছে । ছোটদের নাচের প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কারও পেয়েছিল সে। এখন মডেল হওয়ার খুব ইচ্ছে। পর্দার মডেলদের ঝলমলে জীবন দেখে মডেল হওয়ার এই ইচ্ছেটা জেগেছে তার মনে। এজন্যই সে নিজেকে সবসময় ফিট রাখে।

মিলি এমনিতেই সুন্দর। তার উপর সবসময় সেজেগোজে থাকে। সুন্দরী হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই সে অনেক প্রেমের প্রস্তাব পেয়ে আসছে। তরুণী হওয়ার পর কতজন যে তার মনের দরজায় কড়া নাড়তে চেয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই! কিন্তু মিলি কাউকেই পাত্তা দেয়নি। সে যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে, অনেক ছেলেই তার দিকে হাঁ করে থাকিয়ে থাকে। সে সবাইকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়েই তার পথে চলে যায়। এইতো আজ যখন তার বান্ধবী স্নেহার সাথে বাসায় ফিরছিল তখন একটা ছেলে তার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন তাকে গিলে খাবে! সে শুধু একটা মিষ্টি হাসি দিল ছেলেটির উদ্দেশে। কিন্তু তার বান্ধবী স্নেহা গেল রেগে। বলল, কীরে ছেলেটা তোর দিকে তাকিয়ে আছে হাঁ করে আর তুই তার দিকে তাকিয়ে হাসছিস! মিলি আবারো হেসে দিল আর বলল, হাসলাম কী আর সাধে? ছেলেটার এমন হাবার মত তাকানো দেখেই তো আমার হাসি এসে গেল।
-কিন্তু তোর হাসি দেখে যদি ও ভাবে যে তুই তার প্রেমে পড়ে গেছিস?
-ওর যা ইচ্ছা ভাবুক, তাতে আমার কী? বলেই আবারো খিলখিল করে হেসে দিল মিলি।
-তোর এই হাসিটাই একদিন তোর কাল হবে-বলেই তার পথে চলে গেল স্নেহা।

আজ সকাল থেকেই মিলির মনে অসম্ভব আনন্দ। কারণ তার এতদিনের স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। কাল বিকেলে তার কাছে কুরিয়ারে একটা চিঠি এসেছে। সে দেশের বিখ্যাত একটা প্রোডাকশন হাউসে ছবি পাঠিয়েছিল। চিঠিটা ওখান থেকেই এসেছে। তার ছবি বিখ্যাত বিজ্ঞাপন নির্মাতা শামীম খানের পছন্দ হয়েছে। তাই তারা তাকে অডিশনের জন্য ডেকেছে। আজ বিকেল পাঁচটায় অডিশন। মা বাবাকে চিঠিটা দেখানোর পর তারাও খুশি মনে রাজি হয়েছেন অডিশনে যাওয়ার জন্য। মিলি ভাবল স্নেহাকে নিয়ে যাবে অডিশনে। যেই ভাবা সেই কাজ। মিলি আর স্নেহা পাঁচটার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে প্রোডাকশন হাউসের অফিসে গিয়ে পৌঁছল। অফিসটা উত্তরার বারো তলা একটি ভবনের পঞ্চম তলায়। অফিসের ভেতরে গিয়ে  মিলির মনটা আরো ভালো হয়ে গেল। সাজানো-গোছানো সুন্দর একটা অফিস। রিসিপশনিস্টের কাছে গিয়ে ইনভাইট কার্ড দেখাল। রিসিপশনিস্ট মেয়েটা ম্যানেজারের রুম দেখিয়ে দিল। আর স্নেহাকে চেয়ার দেখিয়ে দিল বসার জন্য। স্নেহাকে বসিয়ে রেখে দুরু দুরু বক্ষে ম্যানেজারের রুমে গেল মিলি। রুমে ঢুকে দেখল বিশাল ডেস্ক সামনে নিয়ে একজন মানুষ বসে আছে। যাকে দেখল, এখানে তাকে কল্পনাও করতে পারেনি! মনে মনে শিউরে উঠল সে!

তাদেরই পাড়ার ছেলে রাসেলকে দেখে নড়াচড়ার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলল মিলি। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠল। সে ভাবল, এই তো সেই রাসেল যে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে একটা এসএমএস করেছিল। সেই এসএমএসটা মিলি দেখিয়েছিল তার বাবাকে। তারপর রাসেলকে আর পাড়ায় দেখেনি মিলি। আজ একবছর পর রাসেলকে এখানে, এই অবস্থায় দেখে মিলি ভয়ে পুরোপুরি অস্থির হয়ে গেল।

কী ভাবছ মিলি? ভয় পেয়েছ? গম্ভীর গলায় বলল রাসেল। তারপর আর কি খবর? ভালো আছ তো? অবশ্য তোমার তো সবসময় ভালো থাকারই কথা। কী দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস? ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই। কী খাবে বল? চা না কফি? এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামল রাসেল। মিলির দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল!
-কী হলো মিলি কিছু বলছ না কেন? আবারো বলল সে।
-শামীম স্যার কোথায়? কাঁপা গলায় শুধু একটি কথাই জিজ্ঞেস করল মিলি।
-তিনি গতকালকেই দু’সপ্তাহের জন্য ব্যাংককে গেলেন। শ্যূটিংয়ের কাজে। অবশ্য উনি থাকার দরকারও নেই। আজ তোমার অডিশন শুধুই আমার সাথে। বলেই অট্রহাসিতে ফেটে পড়ল রাসেল।
রাসেলের হাসিতে আরো ভয় পেয়ে গেল মিলি। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সামনে পা বাড়াল।
-দাঁড়াও মিলি। তোমার ভয় নেই। শুধু আমার কিছু কথা শুনে যাও।
-কী কথা? ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল মিলি।
-আগে বসো তারপর বলি?
-মনে অনেক শঙ্কা নিয়েও একটা চেয়ারে বসল মিলি।
-একটু গলা খাকারি দিয়ে শুরু করল রাসেল - মিলি মনে আছে আমার অনার্স কমপ্লিট হওয়ার পর আমি তখন পুরোপুরি ফ্রি ছিলাম। তাই সময় কাটানোর জন্য আমাদের পাড়ায় রাস্তার গলির মোড়ের চায়ের দোকানটাতে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম রোজ। হঠাৎ একদিন রাস্তা দিয়ে তোমাকে আসতে দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিলাম যে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তোমার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম। আমার তাকানো দেখে তুমিও মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়েছিলে। তখন আমার মুগ্ধতা আরো বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে প্রতিদিন আমি গলির মোড়ের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে শুধু তোমার অপেক্ষা করতাম। কিন্তু তোমার দেখা পেতাম কালেভদ্রে। তারপর ভাবলাম এভাবে হবে না। তোমাকে আরো ভালোভাবে পেতে হবে আমার। কারণ তোমাকে নিয়ে ইতোমধ্যেই আমি স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছিলাম। বন্ধুদের দিয়ে খোঁজ লাগিয়ে তোমার সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারলাম। সাথে তোমার মোবাইল নাম্বার যোগাড় করলাম। তারপর একদিন রাতে তোমাকে কলও দিলাম। দিয়ে সেদিনের মুগ্ধতার কথা বললাম। কিন্তু তুমি আমাকে পাত্তাই দিলে না। উলটো বললে তোমাকে যেন আর ডিস্টার্ব না করি! তারপর সেই যে কলটা কাটলে, এরপর থেকে আমার কোনো কলই রিসিভ করলে না তুমি। তাই বাধ্য হয়ে আমার ভালোলাগার কথা, ভালোবাসার কথা জানিয়ে এসএমএস করলাম তোমাকে। কিন্তু তুমি কী করলে? সোজা তোমার বাবাকে জানিয়ে দিলে আমার এসএমএসের কথা।

উনি আমাকে কোন ওয়ার্নিং না দিয়েই সরাসরি আমার বাবাকে গিয়ে বললেন আমি নাকি তোমাকে কু-প্রস্তাব দিয়েছি! সাথে আমার সম্পর্কে আরো অনেক বাজে কথাও বললেন। শুনে তো আমার নীতিবান একরোখা বাবা গেলেন খেপে। সেদিন রাতে বাসায় ফেরার পর আমাকে খুব অপদস্ত হতে হয়েছিল বাবার কাছে। আমি বাবাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারিনি যে আসল ঘটনাটা কী ছিলো! তাই বাবার উপর অভিমান করে সেই যে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম আজ পর্যন্ত আর বাসায় যাইনি। আমার বাবা এত শক্ত মানুষ যে এখন পর্যন্ত আমার খোঁজই করেননি তিনি। যদিও শৈশবে আমার মা মারা যাওয়ার পর বাবাই আমাকে মানুষ করেছিলেন। আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছিল এটা ভেবে যে তোমার বাবা কীভাবে আমার বাবাকে এতগুলো জ্বলন্ত মিথ্যে কথা বলতে পারলেন? পরে ভাবলাম, ওনার হয়তো কোন দোষ নেই। কারণ যেকোনো বাবাই তার মেয়ের ভালোর জন্য ওরকম কিছু মিথ্যে বা ছলনার আশ্রয় নিতেই পারে। কিন্তু তোমার বাবা তোমার ভালো চিন্তা করতে গিয়ে আমার মতো একটা নিরপরাধ ছেলের জীবনটা প্রায় নষ্টই করে দিলেন। কথাগুলো বলে একটু থামল রাসেল।

এবার আসি আসল কথায়। আবারও বলতে শুরু করল রাসেল। জানো মিলি, বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পর কী যে দুঃসময় গেছে আমার তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। সারাদিন খেয়ে না খেয়ে পথে পথে ঘুরতাম আর রাত হলে এক বন্ধুর মেসে গিয়ে মাথা গুঁজতাম। ছয়টা মাস আমি অনেক কষ্ট করেছি। তারপর এক বন্ধুর মামার সহায়তায় এই প্রোডাকশন হাউসের ম্যানেজারের দায়িত্বটা পেয়েছি। ঐ ছয়টা মাসের কথা আমি কখনোই ভুলব না। সেসব কথা এখন থাক। যেকথা বলার জন্য তোমাকে এখানে বসিয়ে রেখেছি সেটা হল- তুমি যখন এখানে ছবি পাঠালে তখন তোমার ছবিগুলো পেয়েই আমার মনে প্রতিশোধের একটা নেশা মাথাচারা দিয়ে উঠল। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাকে ব্ল্যাকমেল করে তোমার কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করব। কিন্তু এই চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিলাম। কারণ জোর করে আর যাই হোক ভালোবাসা আদায় করা যায় না। তারপর ভাবলাম একটা ঘন্টা হলেও তোমার দেহটাকে নিয়ে খেলে প্রতিশোধ নেব। কিন্তু এই ভাবনাটাও বাদ দিয়ে দিলাম। কারণ আমি প্রতিশোধ নিতে চাই ঠিকই, কিন্তু পশু হতে চাই না। আমি তো অমানুষ না। শেষে যেটা ভাবলাম, প্রতিশোধের জন্য সেটার চেয়ে ভালো কোন অপশন আর হতে পারে না। একী! তোমার চোখে জল কেন মিলি? এখন না কেঁদে আমার কথাটা শুনে তারপরই না হয় কেঁদো।
-আপনি বলুন। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মিলি।
-মিলি তুমি সুন্দরী মেয়ে। ভালো নাচও জানো। শোবিজ জগতের তারকা হওয়ার মত সব গুণই তোমার আছে। আমি জানি যেকোনো প্রোডাকশন হাউজই তোমার মত মেয়েকে লুফে নেবে। আরো জানি তোমার স্বপ্ন, সাধনা সবই শোবিজ তারকা হওয়াকে ঘিরে। আমার প্রতিশোধের অপশনটাই হলো তোমার ঐ স্বপ্ন। তুমি যেভাবে আমাকে গৃহহারা করে আমার জীবনের সব স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছ, আমিও ঠিক তেমনিভাবে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেব। এই প্রতিষ্ঠানে তোমার তো কোন চান্স নেই-ই, আমি চাই তুমি আর কোন প্রোডাকশন হাউস কিংবা অন্য কোনোভাবেই শোবিজ জগতের পথে পা বাড়াবে না। যদি বাড়াও তাহলে আমি কী করবো জানো?
-কী? মিনমিন গলায় বলল মিলি। চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ছে তার।
-তুমি যে ছবিগুলো এখানে পাঠিয়েছ সেগুলো আমার কাছে থাকবে আজীবন। তুমি শোবিজের পথে পা বাড়ালেই আমি ঐ ছবিগুলোকে ফটোশপে পুরোপুরি ন্যুড করে অনলাইন দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেব। সারা বিশ্ব জানবে তুমি একজন চরিত্রহীনা। সুতরাং সাবধান! যেটা বললাম মনে থাকে যেন। আরেকটা কথা, এখন আমি যা বললাম সেগুলো কিংবা আমার কাছে তোমার ছবিগুলো যে আছে সেসব কথা কাউকে বলবে না। বললে কী করব তা তো জানোই।

চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পার। নিয়ে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমি কোনো প্রমাণ রাখিনি। আর জানোই তো প্রমাণ ছাড়া আইনের হাত সবসময় শিকলে বাঁধা। এবার তুমি যেতে পারো। বলেই চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ফেলল রাসেল। আর মিলি স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় হু হু করে কেঁদে উঠল। মাতালের মত টলতে টলতে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে থামল স্নেহার কাছে।
-মিলি তুমি কাঁদছ কেন? কী হয়েছ? আমাকে বল?
কিন্তু মিলি কিছু বলল না। সোজা হাঁটা ধরল লিফটের দিকে। মিলি দাঁড়াও, মিলি, মিলি বলতে বলতে স্নেহাও হাঁটতে শুরু করল তার পেছন পেছন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ