অশ্রুস্নাত উৎসব



বাসস্ট্যান্ডে নেমে দু'দিকে তাকাল মাসুম। কিন্তু কোনো রিকশা কিংবা ভ্যান চোখে পড়ল না। একটু অপেক্ষা করেই হাঁটা ধরল খেয়াঘাটের দিকে। খেয়াঘাটে পৌঁছেই দেখল আয়নাল মাঝি তার ডিঙি নিয়ে বসে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়।

-আসসালামু আলাইকুম আয়নাল চাচা। কেমন আছেন?

-ওয়ালাইকুম সালাম। আরে আমাগো মাসুম যে! আমি ভালাই আচি। তুমি কিরাম আচো বাবা?

-এইতো চাচা আপনাদের দোয়ায় ভালো।

-তা ম্যালাদিন পরে বাড়ির কথা মনে হইল বুঝি! যাউগগা বাইত্তে যাইবা তো? ব্যাগগুলো আমার হাতে দিয়া নৌকায় উইঠা বসো। তোমাগো বাড়ির ঘাটে তোমারে নামাইয়া দিয়া আমিও বাইত্তে যামু। ইফতারের টাইম হইয়া যাইতাছে।

আয়নাল মাঝির হাতে প্রথমে শপিং ব্যাগগুলো দিল মাসুম। তারপর সেও নৌকায় উঠে বসল। চলতে শুরু করল ডিঙি। তা চাচা, গ্রামের খবর কী?

-গ্রামের খবর ভালাই। তা বাবা তোমার খবর কও এবার। এবার গ্রামে আইলা পাঁচ মাস পরে। শুনছি, ঢাকায় নাকি বড় চাকরি পাইছ? ম্যালা ট্যাকা বেতন?

-হ্যাঁ চাচা। আপনাদের দোয়ায় ঢাকায় ভালো একটা চাকরি পেয়েছি। নতুন চাকরি তো, তাই কাজের চাপে অনেক দিন বাড়িতে আসা হয় না।

-শুইনা বহুত খুশি হইলাম বাবা। তোমার মায়ের কষ্টডা এইবার সার্থক হইছে। তোমার বাপ মইরা যাওনের পর তোমার মা কত কষ্ট কইরা তোমারে লেখাপড়া শিখাইল, সেইডা তো আমরা ভালা কইরাই জানি। আহারে! তোমাগো কী কষ্টের দিনগুলোই না গ্যাছে! এভাবে কথা বলতে বলতে ডিঙি পৌঁছে গেল মাসুমদের বাড়ির ঘাটে।

-যাও বাবা। এইবার নামো। আমি ব্যাগগুলা তোমার হাতে দিতাছি।

-মাসুম নেমে মানিব্যাগ বের করে আয়নাল মাঝির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে বাড়ির উঠোনে গিয়েই ডাক দিল- মা, রুনু, রাসেল তোমরা কোথায়? দেখ আমি এসেছি।

রুনু আর রাসেল মাসুমের ছোট দুই ভাইবোন। দু'জনে যথাক্রমে ক্লাস সিক্স আর এইটে পড়ে। তিনজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মাসুমের ডাক শুনে। ভাইয়া এসেছে, ভাইয়া এসেছে বলে রুনু আর রাসেল দৌড়ে এলো। আর কারিমা খাতুন এসেই ছেলের হাত থেকে সব ব্যাগ নিয়ে বললেন- পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো বাবা?

-না মা। তোমার দোয়ায় কোনো সমস্যা হয়নি পথে। তারপর সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর কারিমা খাতুন বললেন- যা বাবা স্নানঘরে পানি রাখা আছে। তুই গোসল করে আয়। এদিকে ইফতারের টাইমও হয়ে এলো। আমি ইফতার তৈরি করি।

গোসল করে এসে ঘরে বসার পর মা ডাকলেন মাসুমকে- মাসুম, বৈঠক ঘরে চলে আয়। ইফতার রেডি। আজানেরও সময় হয়ে এলো।

-আসছি মা বলে বৈঠক ঘরে গেল মাসুম। গিয়ে দেখল সবাই বসে আছে মাদুর বিছিয়ে ইফতার সামনে নিয়ে।

-আয় বাবা। বসে পড়।

-মাসুম বসল।

-আচ্ছা মা, কাল কি ঈদ হবে?

- আজ তো ঊনত্রিশ রমজান। তাই চাঁদ দেখা গেলেই কাল ঈদ হবে।

-শোন মা, আমি এবার তোমাদের ঢাকায় নিয়ে যাব। আমি ভালো চাকরি যেহেতু পেয়েছি এখন আর তোমাদের ছেড়ে ঢাকায় একা থাকতে পারব না। আমি একটা বাসা দেখে এসেছি তোমাদের নিয়ে যাব বলে। ওখানে গিয়ে রুনু আর রাসেলকে ভালো স্কুলে ভর্তি করে দেব।

-কিন্তু বাবা এই বাড়ি, ঘর কে দেখব? তোর বাবার কত স্মৃতি এখানে!

-মা আমরা তো একেবারে চলে যাচ্ছি না। মাঝে মাঝে আসব। আর বাড়িতে আমাদের রুবিনা ফুফুকে রেখে যাব। ওনার তো কেউ নেই আমরা ছাড়া। ওনি বাড়িঘর দেখাশোনা করবেন আর মাসে মাসে কিছু টাকাও পাঠাব ওনার জন্য।

-আচ্ছা সে দেখা যাবে। বলতেই আজান হয়ে গেল। নে বাবা, এবার ইফতার কর। আজান হয়ে গেল।

ইফতার শেষ হওয়ার পর মাসুম মা আর ছোট দুই ভাইবোনকে ঈদের জন্য কিনে আনা জামা-জুতো দিল। নতুন দামি জামা-জুতো পেয়ে সবাই খুশি হলো। এরপর রুনু আর রাসেল গেল ঈদের চাঁদ উঠেছে কি-না দেখতে। এমন সময় মাসুমের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করার পর ওপাশের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল মাসুম। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল! চিৎকার শুনে মাও ছুটে এলেন।

-কী হয়েছে বাবা। কার সঙ্গে কথা বলে চিৎকার করে উঠলি?

-না মা। আমার এক সহকর্মী অ্যাক্সিডেন্ট করেছে তো। গুরুতর অবস্থা। তাই খবরটা শুনে চিৎকার করে উঠলাম। মা, আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি।

-কেন বাবা। এই টাইমে বাজারে গিয়ে কী করবি?

-না মা এমনিতেই। অনেক দিন পর গ্রামে এলাম তো। সবার সঙ্গে দেখাটেখা করে আসি।

-আচ্ছা বাবা। সাবধানে যাস। এমন সময় রুনু আর রাসেল এসে বলল- মা, ভাইয়া ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। কাল ঈদ।

বাজার থেকে অনেক খরচাপাতি নিয়ে এল রাত ১০টায়। খরচগুলো মায়ের হাতে দিয়ে বলল মা, আমি ক্লান্ত। তাই এখন ঘুমিয়ে পড়ি।

আচ্ছা, বাবা যা ঘুমিয়ে পড়। তোর বিছানা রেডি করা আছে। সকালে উঠে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে হবে তো। এরপর বিছানায় গিয়ে পড়তেই দু'চোখ ঘুমে বুজে এলো মাসুমের।

রাত ১টা। পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল মাসুমের। অনেকক্ষণ ধরে টোকানোর ফলে ঘুম ভেঙে গেল ওর।

-কে? কে দরজায় টোকা দেয়?

-আমরা পুলিশের লোক। আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে। পুলিশ আপনার বাড়ির চারপাশ ঘিরে রেখেছে। আপনি বেরিয়ে আসুন।

যা বোঝার বুঝে গেল মাসুম। বেরিয়ে এলো দরজা খুলে। এসে দেখল পুলিশ শুধু নয়, র‌্যাবও আছে সঙ্গে।

-সেন্ট্রি, হ্যান্ডকাফ লাগাও। ওসির কথামতো কাজ করল সেন্ট্রি।

ওদিকে শব্দ শুনে কারিমা খাতুনও তার দুই ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। এসে মাসুমকে হাতকড়া পরা অবস্থায় দেখে বললেন, কী করেছে আমার মাসুম? কেন আপনারা ওকে নিয়ে যাচ্ছেন?

-আপনি কি ওর মা? জিজ্ঞেস করলেন পুলিশ অফিসার।

-হ্যাঁ, আমি ওর মা।

-আপনার ছেলে ঢাকার একজন মাদক ব্যবসায়ী। ঢাকায় আজ সন্ধ্যায় ওর সহযোগী ধরা পড়েছে। সে-ই আপনাদের ঠিকানা বলে দিয়েছে। ওকে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।

-মাসুম, বাবা আমার। ওরা কী বলছে বাবা? তুই না ঢাকায় চাকরি করিস! তাহলে ওরা তোকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন? বলেই কেঁদে ফেললেন কারিমা খাতুন। সঙ্গে কান্না শুরু করে দিল রুনু আর রাসেলও।

-মা শোনো, গরিবের চাকরি নেই এদেশে। কত ভালো রেজাল্ট করে পাস করলাম! তারপর কত জায়গায় ইন্টারভিউ দিলাম। কিন্তু ঘুষ ছাড়া কেউই চাকরি দিল না। এদিকে তোমার কষ্ট দেখে আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই- ওসি সাহেব চলুন, বলেই হাঁটা ধরল সে। পেছন পেছন হাঁটতে থাকল পুলিশের একটি বহর। তারও পেছনে অশ্রুস্নাত চোখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তিনজন মানুষ। তারা ঘটনার আকস্মিকতায় এতই নির্বাক যে শব্দ করতেও ভুলে গেছে!

প্রকাশকাল : ০৫ জুন ২০১৮ (দৈনিক সমকাল)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ