বন্ধুমহলের মধ্যে রোমান একটু লাজুক প্রকৃতির। সবগুলো বন্ধু দুষ্টের যম হলেও রোমান ব্যতিক্রম। শুধু তাই নয়, সবসময় সে ফরমাল থাকতে পছন্দ করে। ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, শো, বেল্ট, চোখে চশমা-টশমা মিলিয়ে একেবারেই জ্ঞানী আর দার্শনিক স্টাইলে চলাফেরা করে। চুলগুলোও ছোট করে ছেঁটে রাখে। আমাদের মত একেকটা মহাদুষ্টের সাথে অধ্যাপক টাইপ এই ছেলেটার কীভাবে যে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, তা আল্লাহ মালুম। প্রতিদিন ক্যাম্পাসে আড্ডার মাঝে ওকে নিয়ে কত মজা আর দুষ্টুমি করি আমরা, তার কোনো ইয়ত্তা নেই!
কিছুদিন ধরে রোমানকে দেখে আমরা একেবারে থ হয়ে যাচ্ছি। সেই রোমান আর এই রোমানের মধ্যে কী বিস্তর ব্যবধান! সেই অধ্যাপক টাইপ ছেলেটাই আজকাল জিন্স, টি-শার্ট, স্টাইলিশ স্পঞ্জ পরে ক্যাম্পাসে আসছে। ফরমাল চশমার বদলে চোখে রোদচশমা পড়ছে। ছোট চুলগুলো জেল দিয়ে খাড়া করে রাখছে। সাথে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রোমানের এমন বদলে যাওয়া দেখে প্রতিদিন আমরা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। ও আমাদের মাঝে এসে আগের মত আড্ডাও দেয় না। শুধু আড্ডায় অ্যাটেন্ড করে একটা লাজুক মুচকি হাসি দিয়েই কাজের অজুহাত দেখিয়ে বাসায় চলে যায়। রোমানকে নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে আড্ডায়। ওর এমন বদলে যাওয়া নিয়ে একেকজন একেক মত দেয়। সবশেষে আমরা কোন সমাধানে পৌঁছাতে পারি না। শুধু সিদ্ধান্ত হয়, আমার বাসা রোমানের বাসার সবচেয়ে নিকটে হওয়ায় ওর বদলে যাওয়া রহস্যের উদঘাটনের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর।
একদিন বিকেলে ওর বাসায় যাই। আমাকে দেখেই সেই মুচকি হাসি দেয়। তারপর ওর রুমে নিয়ে বসায়। ওর রুমে গিয়ে তো আরো অবাক হই আমি। দেখি ওর ড্রেসিং টেবিলের উপর সাজানো নানাধরণের প্রসাধনী। ফেইসওয়াশ, রঙ ফর্সা করার ক্রিম, হেয়ার জেল, বডি স্প্রেসহ আরো কত কী! অবাক হয়েই ওকে বললাম, চল বন্ধু বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ
হাঁটাহাঁটি করি। তোর সাথে জরুরি কথা আছে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বলে, দোস্ত, যা বলার এখানেই বল। যা রোদ পড়েছে, চামড়ার আর কিছুই থাকবে না এখন বাইরে গেলে!
আমি স্বাভাবিক হয়েই প্রশ্নটা করি- আচ্ছা, দোস্ত তুই হঠাৎ বদলে গেলি কেন? তোর সবকিছুই তো বদলে গেছে!
না দোস্ত, এমনিতেই। কোনো কারণ নেই।
উঁহু! এটা মেনে নেয়া সম্ভব না। তুই এমনিতেই বদলে যাওয়ার পাত্র না। কাহিনিটা আজ বলতেই হবে দোস্ত। নইলে আমি কিন্তু আজ উঠছি না- বলেই ওকে চাপ দিতে লাগলাম নানাভাবে।
পরে বাধ্য হয়েই বলল, আমি বলতে পারি এক শর্তে। সেটা হলো আরিফদের এই ঘটনা বলবি না কখনোই।
ওকে, শর্তে আমি রাজি।
আচ্ছা, শোন। কিছুদিন আগে লিনা নামের এক মেয়ের সাথে ফেসবুকে আমার পরিচয় হয়েছে। মেয়েটার সাথে প্রথমে চ্যাটে কথা হত। এরপর নাম্বার আদান-প্রদান করি। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো এবং অন্যান্য ম্যাসেঞ্জার অ্যাপে নিয়মিত কথা বলতে অলতে আমরা দুজন দুজনের...
প্রেমে পড়ে গেছিস?
হু!
ওকে, তারপর বল?
দোস্ত, লিনা স্টাইলিশ ছেলেদের খুব পছন্দ করে। ফেসবুকে আমার ফরমাল ছবি দেখে খুব মাইন্ড করেছে। বলেছে তাকে পেতে হলে, তার সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে আমাকেও স্টাইলিশ হতে হবে। তাই স্টাইলিশ হওয়ার জন্য লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন পড়ে আর ইউটিউবে স্টাইল আইকনদের দেখে দেখে ওর পছন্দের পাত্র হওয়ার চেষ্টা করছি। আগামী সপ্তাহেই ওর সাথে আমি দেখা করতে যাব ঢাকার একটি পার্কে।
ওর কথা শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। চেনা নেই, জানা নেই কোথাকার এক মেয়ের জন্য ও ওর প্রিয় লাইফস্টাইলকেই চেঞ্জ করে ফেলল! অনেক কষ্টে স্বাভাবিক থেকে শুধু বললাম, বেস্ট অফ লাক বন্ধু।
ওর কথামত ওর এই ঘটনা আমি বন্ধুমহলের কাউকেই বললাম না। সবাইকে বললাম আমি অনেক চেষ্টা করেও কিছু জানতে পারিনি!
এক মাস পর হঠাৎ দেখি রোমান আগের মত ফরমাল হয়ে ক্যাম্পাসে আসছে। কিন্তু আমাদের কাছেই আসছে না। দূর থেকে শুধু হাই, হ্যালো করেই চলে যায়। আমাদের দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়। সবসময় মুখ গোমড়া হয়ে থাকে। আমরা সবাই আলোচনা করতে লাগলাম এটা নিয়েও এবং রোমানের আবার স্বরূপে ফিরে আসার রহস্য উদঘাটনের দায়িত্বও আমার উপর পড়ল। যথারীতি গেলাম ওর বাসায়। এবারও ওকে চেপে ধরলাম। কিন্তু এবার তো সে নাছোড়বান্দা, কিছুতেই বলবে না কী ঘটেছে আর কেন সে আবার আগের রূপে ফিরে এল। এরপর আগের ঘটনা সবাইকে বলে দেব বলে ব্ল্যাকমেইল করার পরই স্বীকার করল। বলা যায় স্বীকার করতে বাধ্য হলো। বলল, ও যার সাথে কথা বলত সে নাকি খুব সুন্দরী একটি মেয়ে। প্রথমদিন দেখা হওয়ার পর মেয়েটির প্রতি ওর আকর্ষণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। জীবনে প্রথম প্রেমের ছোঁয়ায় চোখে রঙিন স্বপ্ন এসে ধরা দিয়েছিল। তাই পরের সপ্তাহে আবার গেল দেখা করতে। যাওয়ার আগে মেয়েটি বললো যে ওকে নাকি মেয়েটির বাসায় নিয়ে যাবে। তাই সে যেন দামি মোবাইল, ঘড়ি, স্বর্ণের চেইন, স্বর্ণের আংটি আর বেশকিছু টাকা সাথে করে নিয়ে যায়। যাতে ওকে দেখে মেয়েটির বাসার সবাই ওকে পছন্দ করে। মেয়েটির কথামত সেদিন সন্ধ্যায় সিএনজিতে করে যাচ্ছিল মেয়েটির বাসায়। হঠাৎ একটা নির্জন চিপা গলিতে সিএনজি থেমে যায়। চার পাঁচজন লোক এসে জড়ো হয় চারদিক থেকে। মেয়েটিও যোগ দেয় ওদের সাথে। কেউ পিস্তল, কেউ ধারালো ছুরি বের করে ওর মুখের ওপর ধরে। ওর সাথে যা ছিল লুট করে নেয়, এমনকি পরনের শার্টটাও। শুধু প্যান্টটা নিতে বাকি রাখে। ওকে খালি গায়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় রেখে সবাই চলে যায় সিএনজিতে করে! অনেক কষ্টে কোনমতে সেদিন ও বাসায় আসে।
বুঝলাম, বন্ধু আমার ছিনতাইকারী দলের মহিলা সদস্যের সাথে প্রেম করছিল এতদিন! বন্ধুর প্রতি রাগও হচ্ছিল আবার খুব হাসিও পাচ্ছিল। সেসব প্রকাশ না করে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে এলাম। পরদিনও সে আমাদের দেখে এড়িয়ে যাচ্ছিল। আমি গিয়ে প্রায় জোর করে নিয়ে গেলাম আড্ডায়। ওর বদলে যাওয়া আর স্বরূপে ফিরে আসার ঘটনাটা সবাইকে বলতেই হাসির রোল পড়ে গেল। কোন উপায়ন্তর না দেখে সে নিজেও যোগ দিল আমাদের হাসির দলে।
প্রকাশিতঃ দৈনিক সমকাল-২০১২
0 মন্তব্যসমূহ